হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে বাংলাদেশের মানুষ কখনো এমন গণতন্ত্র দেখেনি। অনেক দেশের সামরিক স্বৈরশাসকদের অধীনেও নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে। মাত্র চার মাস আগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থি নেতা অং সান সুচির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সামরিক শাসন চলার মধ্য দিয়ে শাসনতন্ত্রে সামরিকতন্ত্র ও সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কায়েম করার পর এই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এক ধরনের শঙ্কা ছিল। অবশেষে বেসামরিক ব্যক্তি থিন কিউ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্র নিয়ে আশঙ্কার মেঘ অনেকটা কেটে গেছে। তবে নির্বাচনই গণতন্ত্রের শেষ কথা নয়। জনগণের অবাধ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ মাত্র। এ কারণেই মিয়ানমারের নতুন প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশনের প্রথম ভাষণে তার দেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। এ জন্য তিনি মিয়ানমারের জনগণকে আরো কিছু দিন ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণীত হওয়ার মধ্য দিয়ে শাসকশ্রেণীর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাম্যনীতি প্রতিষ্ঠিত না হলে সেখানকার রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং সব মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চরম দুর্দশা, এথনিক ক্লিনজিং এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের একমাত্র সমাধান হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের অধীনে সুশাসন এবং সামাজিক রাজনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।
মিয়ানমার যখন গণতন্ত্রের পথে তার নবযাত্রা শুরু করেছে, বাংলাদেশের মানুষ তখন গণতন্ত্রের একটি ভগ্নপ্রায় কাঠামোর ওপর নির্বাচন ব্যবস্থার করুণ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে। আগেই উল্লেখ করেছি, নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল স্পিরিটই ছিল গণতন্ত্র। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসির এক পর্যায়ে বাঙালিদের সম্ভাব্য প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে দিতে পঁচিশে মার্চের রাতে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করে। এর জবাবেই শেষ পর্যন্ত এ জাতি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার ডাক, ঘোষণা ও নেতৃত্ব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতই বিভেদ-মতপার্থক্য থাকুক, এ দেশের স্বাধীনতার মূল শক্তি ছিল দেশের সাধারণ জনগণ। অভাবনীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মাত্র সাত বছরের মাথায় র্পূব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং ১৯৭০ সালে স্বায়ত্তশাসনের চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেও সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৎকালীন সরকার এবং নির্বাচনব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এসব নির্বাচনের আগে যদি অধ্যাদেশ জারি করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথকে রুদ্ধ করা হতো, তাহলে নিশ্চয়ই তৎকালীন সরকারবিরোধী নির্বাচনী জোটের নির্বাচনে জয়লাভের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও তখন দেশে গণতন্ত্র ছিল, শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ছিল এমনটা দাবি করা যায় না। তৎকালীন শাসকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা থাকলে সম্ভবত এ দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হতো না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর আমাদের গণতন্ত্র এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক মারছেন বর্তমান শাসকরা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে নির্বাচনকে একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে আখ্যায়িত করে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে শীঘ্রই আরেকটি নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেছিলেন। তবে সমঝোতা কখনো একপক্ষীয় হয় না, এটা হয় দ্বিপক্ষীয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয়। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবে কোনো একটি শক্তিশালী পক্ষের একগুঁয়েমি বা আধিপত্যবাদী নীতির কারণে যে কোনো সমঝোতা প্রয়াস ভেঙে যেতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য শাসকশ্রেণীর অগণতান্ত্রিক মনোভাবই মূলত দায়ী। বিতর্কিত ও ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শাসক দল দেশের নির্বাচনব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়ার যে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এখন তৃণমূল পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও সেই অপতৎপরতার ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় ব্যানার ও প্রতীকে অনুষ্ঠিত প্রথম দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সারাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত ৪০ জন নিহত এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হওয়া ছাড়াও ব্যাপক সংঘাত ও হানাহানির খবর পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিরোধী দলের অংশগ্রহণ রুখতে সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রহসনের ইউপি নির্বাচনে দেশের গ্রামীণ জনপদের সমাজব্যবস্থা এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের পরিবেশও যেন ভেঙে পড়ছে। দেশে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা সব সময়ই ছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল, দাড়িপাল্লা ও কাস্তে-হাতুড়ির রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ গ্রামীণ জনপদের সামাজিক ঐক্য ও মূল্যবোধের ভিত্তিগুলো কখনো ধসিয়ে দিতে পারেনি। এবার দলীয় প্রতীকে ইউপি ইলেকশনের মধ্য দিয়ে সামাজিক বন্ধনের সেই শেষ আশ্রয়টুকুও ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।
এরশাদ সরকারের আমলে (সম্ভবত : ১৯৮৬) এক নির্বাচনের কথা মনে পড়ে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে শিল্পপতি এম এ সাত্তার সাহেব লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। বক্তাবলী থেকে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা নারায়ণগঞ্জ শহরের মাসদাইরে সাত্তার সাহেবের বাসায় গিয়েছিলেন নির্বাচনী বিষয়ে পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে। সেখানে উপস্থিত নেতা-কর্মীদেরকে সাত্তার সাহেব নাকি বলেছিলেন, তোমাদের এত কষ্ট করার দরকার নেই। তোমরা ভোট দিলেও আমি পাস, না দিলেও পাস। শুধু ইলেকশনের দিন লাঙ্গল কান্দে লইয়া আমার বাসায় চইলা আইস। যথারীতি ইলেকশনের দিন ভোটের নামে সিল মারার উৎসব হলো। কোনো একটি কেন্দ্রে ব্যালটে সিল মারার সময় এক যুবক ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে ধরা পড়ে গেলে তাকে লোকদেখানো অ্যারেস্ট করা হয়। সে সময় মোবাইল ফোন না থাকায় ম্যাজিস্ট্রেটকে এমপি সাহেবের ধমক খেতে হয়নি। জাতীয় পার্টির সেই কথিত নেতাকে নাকি বিশেষ পুরস্কারসহ সম্মানীত করা হয়েছিল। এটি ছিল স্বৈরাচার আমলের একটি সংসদ নির্বাচনের চিত্র। এর প্রায় চার দশক পরে এসে আমরা ভোটারবিহীন, প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংসদ নির্বাচন দেখতে পেলাম ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগেও দেশের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে এবং এসব নির্বাচনের বেশির ভাগেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের জয়লাভ করতে দেখা গেছে। মূলত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের অনাস্থা তৈরি হয়েছিল। নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণকে আস্থাহীন করে তোলার মানে হচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আবারো প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সাথে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। এখন যেমন সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা জাতিকে অধিক উন্নয়ন ও সীমিত গণতন্ত্রের বটিকা গেলাতে চাইছেন, পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক আইয়ুব খানও মৌলিক গণতন্ত্র চালু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচনের তরিকা চালু করেছিলেন। বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেলে ভরে অথবা হুলিয়া জারি করে ফেরারি বানিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ৮০ হাজার স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় ভিন্ন চেহারায় পাকিস্তানি সামরিক শাসকের তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের অনুরূপ সীমিত গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক মামলাসহ নানাবিধ হুমকির মুখে দেশের সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের বেশির ভাগেই বিরোধী দলের যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীরা দাঁড়াতেই পারছেন না। যেখানে বিএনপি প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে সরকারি দলের প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচ্ছে সেখানেই অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি ঘটিয়ে ভোটারদের সন্ত্রস্ত করে ভোটকেন্দ্র দখল এবং ব্যালটে সিল মেরে নৌকার প্রার্থীদের পাস করিয়ে নেয়ার ‘মওকা মওকা’ ইলেকশন হচ্ছে। আর যেসব এলাকা বিএনপি অধ্যুষিত হিসেবে চিহ্নিত, সেখানকার বেশির ভাগ বিএনপি প্রার্থীর মনোনয়নপত্র জমায় বাধা দেয়া হয়েছে অথবা সন্ত্রাসী ক্যাডার দিয়ে মনোনয়নপত্র ছিনিয়ে নিয়ে সরকার সমর্থিতদের জন্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা ও কারসাজির সাথে সরকারের সুবিধাভোগী একশ্রেণীর বিএনপি নেতাকে নেপথ্য ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এ জাতীয় বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সাধারণ নেতা-কর্মীদের সোচ্চার হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সরকারি দলের স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধও এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রকট আকারে ধরা পড়েছে। কোথাও কোথাও দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে ২০-৫০ লাখ টাকা থেকে কোটি টাকায় মনোনয়ন বাণিজ্য করারও অভিযোগ উঠেছে। এতদিন দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য হতে দেখা গেছে, এবার দলীয় ব্যানারে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলের এমপি এবং স্থানীয় নেতারাও তৃণমূলে মনোনয়ন বাণিজ্যের সুযোগের সদ্ব্যবহার করছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী দলের থানা ও জেলা কমিটির বিরুদ্ধেও অনুরূপ মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠতে দেখা যাচ্ছে।
একদিকে তথাকথিত উন্নয়নের ফানুস অন্যদিকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছে বাংলাদেশের জনগণ। শেয়ারবাজার কারসাজি ও সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেয়ার পরও যখন রাঘববোয়াল লুটেরাদের কিছুই হয় না তখন এরই ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও ইতিমধ্যে শত শত কোটি টাকা গায়েব হয়ে গেছে। এসব লুটপাট ও চুরির টাকা উদ্ধার, সঠিক তদন্ত এবং প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আইনি প্রক্রিয়া বা স্বচ্ছতা নিয়েও এখন জনমনে সংশয় দানা বেঁধেছে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, আইনের শাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা, ভোটের রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সবকিছুই একযোগে আস্থার সংকটে পতিত হলে সে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য। দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা, ভোটকেন্দ্র দখল ও এবং প্রকাশ্যে সিল মারার মহোৎসব দেখে নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা দেশের সার্বিক নির্বাচনব্যবস্থার নি¤œমুখিতা অব্যাহত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনে আগে কখনো এমন চিত্র দেখা যায়নি। এভাবে নির্বাচনের প্রথাগত সংস্কৃতিই বিনষ্ট করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সে হয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের কাছে অসহায়, অথবা সরকারি দলের রাজনৈতিক ইচ্ছা বাস্তবায়নে বেশি তৎপর। দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত-সংঘর্ষে প্রায় অর্ধশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ এবং নানাভাবে আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এখন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়ে দায় এড়ানোর প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। দলীয় মনোনয়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের আয়ত্তে রাখতে সারাদেশে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা যেসব সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তাকে ‘গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক’ হিসেবে দেখছেন বিরোধী প্লাটফর্মের রাজনীতিকরা। শুধু কি গণতন্ত্রের কফিনের শেষ পেরেক, নাকি দেশের গ্রামীণ জনপদের সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহাবস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তার বন্ধনের ওপর মরণ কামড়? দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বেশ কয়েক দিন আগে। এখন প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজয়ী ও পরাজিত প্রার্থীর সমর্থক, ক্যাডারদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের শিরোনাম ছিল, ‘পাঁচ পুলিশকে পেটালো আওয়ামী লীগ কর্মীরা, সহিংসতায় নিহত ২’। গ্রামে গ্রামে নির্বাচনী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার রক্তাক্ত চিত্র আতঙ্কজনক, আঁতকে ওঠার মতো। বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রতিযোগিতার বাইরে রেখে সরকারি দল মনোনীত এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যকার সংঘাত সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে পরিণত হওয়ায় পুলিশকে অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। যে পুলিশ বিরোধী দলের কর্মীদের ন্যায্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে রাজপথে দাঁড়াতেই দেয় না, নিরস্ত্র রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করতেও দ্বিধা করে না। সেখানে পুলিশকে পেটানোর পরও আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে বা লাঠিচার্জ করতেও পুলিশ ভয় পায়। এভাবেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে সহিংসতার বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমন গণতন্ত্র, এমন নির্বাচন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য লাখো প্রাণের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছিল! দেশের বিবেকবান গণতন্ত্রকামী মানুষের চেতনায় এই প্রশ্ন এখন ক্রমাগত কষাঘাত হানছে। এমন উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের এমন অভিযাত্রা থেকে দেশের মানুষ পরিত্রাণ চায়।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।