Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নেছারাবাদে হারিয়ে গেছে দুই শতাধিক খাল

প্রকাশের সময় : ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ হাবিবুল্লাহ, নেছারাবাদ থেকে : স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছরেও পিরোজপুরের নেছারাবাদের ছড়িয়ে ছিটেয়ে থাকা খালগুলো দিয়ে চলাচল করত টাবুরে নাও, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ও মালবাহী ছোট-খাট নৌকা। প্রকৃতির নিয়মে নদীর জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হত এসব খালে। প্রতিনিয়ত ওই সকল খালে মশারি জাল, ঝাঁকি জাল দ্বারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত এলাকার নানান জনেরা। কম খরচে ছোট খাট মালামাল পরিবহনে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল সন্ধ্যার শাখা উপশাখার খাল। কালের প্রবাহে গত দেড় থেকে দুই যুগে দখলবাজদের অবৈধ খাল দখল আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রহস্যজনক নীরবতায় উপজেলার ৮২ টি মৌজার আনুমানিক ৪১০ টি খালের চিত্র হারিয়ে গেছে অর্ধেকেরও বেশি। আবার কোন খাল হয়ে গেছে একেবারেই উধাও। এখন সরেজমিনে দখলকৃত ওইসব খালের সন্ধান মেলা দুস্কর হলেও কালের স্বাক্ষী হয়ে খালগুলো বেঁচে আছে সরকারের জরিফকৃত নকশা পর্চায়। এমতবস্থায় বিশেষকরে উপজেলার পৌরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রভাবশালীদের অবৈধ খাল দখলে আংশিক বেঁচে খালগুলোতে মিলছেনা জোয়ার ভাটা। ব্যবহারের পানির জন্য চলছে হাহাকার অবস্থা। তবুও বিধিনিষেধ মানবতা উপেক্ষা করে পৌরসভায় বেড়েই চলছে খাল দখলের প্রতিযোগিতা। সম্প্রতি গত কয়েক বছরে খালের উপর দখলবাজদের অত্যাচারের মাত্রা এতই বেড়েছে যে, খোদ উপজেলার স্বরূপকাঠি পৌরসভা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ১০ টি খাল। এসব খালের কোনটি মরনাপন্ন আবার কোনটি মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে দাড়িয়েছে। দখলকৃত পৌরসভার খালগুলো হল ১ ও ৩নং ওয়ার্ডের আশ্চর্য বাড়ীর খাল, দক্ষিণ স্বরূপকাঠি খাল, উপজেলা সদর খাল, ফায়ার সার্ভিস খাল, পুরাতন তহসিল অফিস খাল, কামারকাঠি সীমানা খাল, পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের তাতেরবাড়ীর খাল এবং মোদাচ্ছের মিস্ত্রি বাড়ী সংলগ্ন খাল, সরদারবাড়ী খাল। উল্লিখিত এ খালগুলোর বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঁসখুটা দিয়ে দখল করে কেউ কেউ বাড়াচ্ছেন বসতবাড়ীর পরিধি ও নানা স্থাপনা। আর এ অবৈধ খাল দখলে বর্ষায় বেড়ে চলে পৌরসভায় জলবদ্ধতা শুস্ক মৌসুমে দেখা দেয় গোসল ও প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহারে হাহাকার। আর খাল দখলবাজদের অধিকাংশই প্রভাবশালী হওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখেও না দেখার বনিতা করছেন বলে অভিযোগ এলাকার সুধিজনদের। এলাকার বিশিষ্টজনদের মতে অচিরেই দখলবাজদের কব্জা থেকে খাল উদ্বার করে পুনঃখননের ব্যবস্থা না করলে ভবিৎষতে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়তে পারে এ উপজেলা।
স্বরূপকাঠি পৌরসভায় এভাবে অবাধে খাল দখলের ব্যাপারে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী অমল কৃষ্ম ভদ্র বলেন, তিনি এ পৌরসভায় নুতন যোগদান করেছেন। সরকারী খাল দখলের ব্যাপারে অবগত নন। অবশ্য পরে তিনি আরো বলেন, খাল উদ্ধারের ব্যাপারের বিষয়টি জেলা পরিষদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড এর দপ্তরের কাজ।
সরেজমিনে উপজেলার মৃত গাফ্ফার মিয়ার ছেলে শরীফ আহম্মেদ পৌরসভার তেতুল তলার আচার্য্যবাড়ীর সরকারি খাল ও রাস্তা দখল করে খালের মোহনায় গড়ে তুলেছেন পাকা স্থাপনা। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে কেউ কেউ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবগত করেন। উপজেলা ভূমি অফিস ও পৌরসভা থেকে সেখানে কর্মকর্তারা গিয়ে স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেন। পরে কয়েকদিন কাজ বন্ধ থাকলেও হঠাৎ করে অজ্ঞাত কারণেই গড়ে ওঠে অসমাপ্ত পাকা স্থাপনাটি। এমনকি খালটির ভিতকার থেকেও অবৈধ দখল নিয়ে বাস্তবে মুছে ফেলা হয়েছে খালের আসল রূপরেখা। পৌরসভার সদরে উপজেলা পরিষদের প্রধান সড়ক ঘেষে বয়ে যাওয়া খালটি এখন মারাত্মক দূষণ কবলে। খালের দখল নিয়ে প্রভাবশালী আমেরিকা প্রবাসী মোঃ ফিরোজ আহম্মেদ গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন। সুষ্ঠু পরিবেশের তোয়াক্কা না করে সে খালের ভিতরে ছেড়ে দিয়েছেন লেট্রিনে সেপ্টি ট্যাঙ্ক। এখন সে খালেও দেখা যাচ্ছেনা জোয়ার ভাটা। খালে ভাসছে ময়লা আর্বজনা, ছড়াচ্ছে দুর্ঘন্ধ। ঠিক একই খালের অন্য পার্শ্বে সম্প্রতি এক প্রভাবশালী শিল্পপতি মাঝপ্রান্ত দখল করে দেওয়াল দিয়ে দখলে নিয়েছেন। উপজেলা সদরের খাল দখলের এ চিত্রটি উপজেলা ভূমি অফিস থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সবার নজরে আসলেও বিন্দুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদের কৌতহল রাখেনা কেহ। এদিকে কোন রকমের বাধা বিপত্তি ছাড়া প্রভাবশালীদের যত্রতত্র খাল দখলে পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের দখল হওয়া তিনটি খালে ঠিকমত জোয়ারভাটা প্রভাহিত না হওয়ায় শুস্ক এই মৌসুমে গোসল ও প্রয়োজনীয় পানি ব্যবহারের অভাবে ভুগছে ওই এলাকার সাধারণজনেরা। পানি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জোয়ার ভাটা প্রভাহিত হচ্ছেনা ৭নং ওয়ার্ডের তাতেরবাড়ী সংলগ্ন দখলকৃত খালে। যে কারণে চরম পানি সংকটে ওই ওয়ার্ডবাসী। ওয়ার্ডের তাতেরবাড়ী পুলেরপাড় সংলগ্ন নকসায় উল্লেখ করা ৩৫ ফুটের খালটি কোন কোন জায়গা দিয়ে নেই ১০ ফুটও। শুকনা মৌসুমে খালের স্ব-স্ব জনেরা বাঁস, স্থানীয় ভাষায় গরজা দিয়ে দখল করে প্রতি বছর সঙ্কুচিত করে ফেলছে সে খাল। ৭নং ওয়ার্ডের সরদারবাড়ী খালের মোহনা থেকে শুরু করে প্রবাহিত হওয়া খালটি অবৈধ দখলের কবলে পতিত হয়ে কয়েক হাজার ফুট আজ মৃতপ্রায় অবস্থা হয়ে দাড়িয়েছে। সরদারবাড়ীর ওই খালের রেজিষ্ট্রি অফিস সংলগ্ন পশ্চিম পাড় থেকে খালের কতক অশং দখল করে জনৈক এক শিক্ষক গড়ে তুলেছেন মার্কেট। এছাড়াও ওই খালের পাশ থেকে দখল নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী গয়ে তুলছেন বসতবাড়ী ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান। সে সময়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে কয়েকজন অবৈধ খাল দখলের ব্যপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান-এর কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও অজ্ঞাত কারণে নেওয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। এভাবে শুধু আশ্চর্য বাড়ীর খাল, দক্ষিণ স্বরূপকাঠি খাল, উপজেলা সদর খাল, ফায়ারসার্ভিস খাল, পুরাতণ তহসিল অফিস খাল, কামারকাঠি সীমানা খাল, পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের তাতেরবাড়ীর খাল এবং মোদাচ্ছের মিস্ত্রি বাড়ী সংলগ্ন খাল, সরদারবাড়ী খালই নয়; পৌরসভার ৩ ও ৪নং ওয়ার্ডের ভূঁইয়া বাড়ীর সরকারি খাল দখল নিয়ে জনসম্মুখে রাস্তার পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কয়েকটি দোকানপাট। খাল দখল নিয়ে দোকান উঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে এক দখলবাজ বলেন, শুধু তিনিই নন খাল দখল করে ওখানে আরো দোকানঘর উঠেছে। বিষয়টি সবারই জানা। আর এভাবে উপজেলার পৌরসভার সরকারী খালগুলি দখল নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ায় ওইসব খালের যৌবন। খালে দেখা যাচ্ছেনা আগের মত জোয়ারভাটা। আবার দখলের কবলে পতিত হয়ে মরে গেছে খালগুলোর রূপরেখা। অবাধ এ খাল দখলে হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। পিরোজপুর জেলা প্রশাসক এ কে এম শামিমুল হক ছিদ্দিকী বলেন, অবৈধ খাল দখলবাজদের বিরুদ্ধে তারা অভিযান চালাবে। দখলবাজ যেই হোক, উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে খাল দখলবাজদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন এবং তিনি জেলা পরিষদ বরাবরে অবৈধ খাল দখলের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দিতে অনুরোধ করেন এ প্রতিবেদককে।
উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন স্কুল শিক্ষক বলেন, এভাবে আর মাত্র কয়েক বছর প্রভাবশালী দখলবাজদের খাল দখল অব্যাহত থাকলে পয়নিস্কাষনসহ বৃষ্টি বাদলে জলবদ্ধতা নিরসনে কঠিন সমস্যায় পড়বে স্বরূপকাঠি পৌরসভা। হারাবে নদী খাল বিদৌত নেছারাবাদ উপজেলার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নেছারাবাদে হারিয়ে গেছে দুই শতাধিক খাল
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ