Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চরম সঙ্কটে বরিশাল মহানগরীর নাগরিক পরিষেবা

সুপেয় পানির হাহাকার

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ৭ এপ্রিল, ২০১৮, ১২:০০ এএম

বিশুদ্ধ পানির স্তর এক হাজার ফুটেরও গভীরে নেমে গেছে//
নদ-নদী আর খাল-বিলের দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণ কেন্দ্র বরিশালে সুপেয় পানির সঙ্কট ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। প্রতি বছরই সুপেয় পানির স্তর ক্রমশ নিচে নামার ফলে তার প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে উঠছে। সুপেয় পানির প্রাপ্যতা বরিশালের নগরজীবনে সুস্থ্য নগরিক ব্যবস্থার জন্য চরম হুমকি হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যে। এখন হাজার ফুটর ওপরে বরিশাল মহানগরীতে সুপেয় পানি মিলছে না। পাঁচ লক্ষাধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ নগরীতে চাহিদার অর্ধেক বিশুদ্ধ পানিও সরবরাহ করতে পারছে না বরিশাল সিটি করপোরেশন। সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি তহবিলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফ্তর প্রায় ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে মহানগরীতে পানি সরবরাহ প্রকল্পের কাজ আরো বছরখানেক আগে শেষ করলেও সিটি করপোরেশন এখনো তা চালু করতে পারেনি। প্রকল্পের আওতায় দুটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণ করা হলেও চালু হবার আগেই তার একটি কীর্তনখোলা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। ট্রিটমেন্ট প্লান্টটিসহ সংলগ্ন প্রায় সোয়া ৪ কিলোমিটার এলাকা নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প-প্রস্তাবনা মাস চারেক আগে একনেক-এর অনুমোদন পেলেও পদ্ধতিগত নানা জটিলতায় বাস্তবায়ন কাজ বিলম্বিত হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই শুষ্ক মৌসুমে শুরু হওয়া পানির হাহাকার বর্ষা মৌসুমের বেশীরভাগ সময় ধরেই অব্যাহত থাকছে। এর পেছনে মূল কারণটিই হচ্ছে পানির স্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়া। একই কারণে সুপেয় পানির স্তরও নিচে নামছে। বরিশাল মহানগরীর ৪২ সহ¯্রাধিক হোল্ডিং-এ বৈধ পানির সংযোগ রয়েছে ১৭ হাজারের কিছু বেশী। কিন্তু এসব বৈধ গ্রাহকের মত অবৈধ গ্রাহকগণও চাহিদা মাফিক নিয়মিত পানি না পাওয়ায় গত কুড়ি বছরে গোটা নগরীতে হাজার-হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে। সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত এসব গভীর নলকূপ নগরীর মাটির তলার পানি প্রতিনিয়ত শুষে নেয়ায় এখন ভয়াবহ সঙ্কটে এ নগরীর সুস্থ্য সমাজ ব্যবস্থা। ফলে নগরীর পানির স্তর নামতে নামতে এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতিবছরই পানির স্তর নামছে। গতবছর যেখানে ভূগর্ভের ১.০৪ মিটারে পানির অবস্থান ছিল, এবছর তা ১.১৮ মিটারে নেমে গেছে। তবে সুপেয় পানির স্তর এখন ৩শ’ মিটারেরও নিচে। ফলে মধ্যরাতের আগে প্রায় হাজার ফুট গভীরে থাকা নলকূপের পাইপেও কোন পানি উঠছে না। তবে এ অবস্থাতেও ‘সাবমার্সিবল পাম্প’ সহ শক্তিশালী মোটর লাগিয়ে ভূগর্ভের পানি শুষে নেয়ার প্রতিযোগীতাও চলছে নগরী জুড়ে। ফলে মধ্যরাতের আগে নগরীর বেশীরভাগ গভীর নলকূপেও এখন কোন পানি উঠছে না। গত তিন বছরে পানির স্তর আশংকাজনক হারে নিচে নেমে গেছে ।
ফলে গোটা নগরী জুড়েই বিশুদ্ধ পানির হাহাকার চলছে। এমনকি নগরীতে অবৈধ নলকূপগুলোকে বৈধতা দিতে বরিশাল সিটি করপোরেশন নীতিমালাও তৈরী করেছে। নগর পরিষদের অনুমোদন লাভ করা ঐ নীতিমালায় নলকূপের পাইপের ব্যাসার্ধের প্রকার ভেদে ২৫ হাজার টাকা থেকে লক্ষাধিক টাকা জামানত দিলেই বাড়ীর মালিকগন যেকোন স্থানে গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন পাচ্ছেন। এভাবেই ইতোমধ্যে দেড় ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ২সহস্রাধিক গভীর নলকূপ স্থাপনকে বৈধতা দিয়েছে নগর ভবন। তবে নগর ভবনের এ নীতিমালা প্রনয়নের আগে ও পড়ে অবৈধভাবেও বিপুল সংখ্যক গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে গোটা নগরী জুড়ে। অবৈধ নলকূপের সঠিক কোন পরিসংখ্যন নগর ভবনের কাছে না থাকলেও তার সংখ্যাও নুন্যতম ৫ হাজার হতে পারে বলে একাধিক সূত্রে বলা হয়েছে। ফলে প্রতিনিয়ত কয়েক হাজার গভীর নলকূপ এ নগরীর তলা থেকে পানি শুষে ওপরে আনছে। নগরীর মাটির তলার পানি ক্রমশ শুষে নেয়ার প্রবণতায় অবধারিত সঙ্কটের দিকে এগুচ্ছে এককালের ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বরিশাল মহানগরী।
অথচ নিকট অতীতেও বরিশাল মহানগরী জুড়ে বেশ কিছু খালে জোয়ার-ভাটা আসা যাওয়া করত। সেখানে নৌকাও চলত। যার বেশীরভাগ খালই বুজিয়ে পাকা আচ্ছাদিত ড্রেনসহ রাস্তাও নির্মাণ করা হয়েছে। গত দুই দশকে এ নগরীর বেশীরভাগ খাল ও ড্রেনগুলোকে অরসিসি ঢালাই করে আটকে দেয়া হয়েছে পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে। এসব ড্রেনের তলদেশ আরসিসি ঢালাই করে আটকে দেয়ায় ভূ-উপরিস্থিত কোন পানি ভূতলে প্রবেশ করছে না। অথচ ভূতলের পানি নলকূপ দিয়ে প্রতিনিয়ত ওপরে তুলে আনা হচ্ছে। একাধিক নির্মাণ বিশেষজ্ঞর মতে, জনস্বার্থেই খাল বন্ধ করা সম্পূর্ণ অনুচিত। ড্রেন পাকা করলেও তার নির্মাণ নকশায় প্রতি ১৫-৩০ ফুট অন্তর কয়েকটি করে বড় ধরনের ছিদ্র বা গর্ত রাখা উচিত। যার মুখ ব্যাটস দিয়ে ভড়াট করে রাখলে আরসিসি ঢালাই অটুট থাকার পাশাপাশি ঐ সব গর্ত দিয়ে ওপরের পানি ভূগর্ভে প্রবেশ বাঁধা প্রাপ্ত হবে না। ফলে ভূগর্ভে পানির স্তর কিছুটা হলেও স্থতিশীল রাখতে সহায়ক হবে। নগরীর নবগ্রাম রোডের চৌমুহনী থেকে বটতলা এবং পুরো বগুড়া রোডের ধারের কাঁচা ড্রেনসহ সদর রোডের এক সময়ের কাঁচা ড্রেনগুলো গত দুই দশকে বুজিয়ে ছাউনিযূক্ত আরসিসি ড্রেন সহ ফুটপাথ নির্মাণকালে ভূ-উপরিস্থিত পানি ভূগর্ভে প্রবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি নগর ভবনের প্রকৌশলীগন। বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার সোয়া ৩শ’ কিলোমিটার ড্রেনের প্রায় ১৯০ কিলোমিটারই ইতোমধ্যে অরসিসি ও ইটের গাথুনি দিয়ে পাকা করে নির্মান করা হয়েছে। পাশাপাশি গত দুই দশকে এ নগরীর তিন-চতুর্থাংশ পুকুর ও ডোবা বুজিয়ে ফেলা হয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে বরিশাল মহানগরীর পানির সঙ্কট ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পরিবেশবিদগন। এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের কোন মাথাব্যথা নেই নগর ভবন কর্তৃপক্ষেরও।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি করপোরেশনের পানি সরবরাহ বিভাগের একাধিক প্রকৌশলী সাথে আলাপ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানান, ‘ড্রেন ও খালগুলোকে আরসিসি ড্রেনে রূপান্তরের আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের আরো ভাবা উচিত ছিল’। এ ব্যাপারে একজন দায়িত্বশীল প্রকৌশলী একটি বিদেশী প্রশিক্ষনে তার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘বিশ্বের বহু দেশেই আরসিসি ড্রেনের তলায় নির্দিষ্ট এলাকা পরপর বড় মাপের হোল বা গর্ত রেখে তা ব্যাটস দিয়ে ভড়াট করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে।’ এত করে ‘ভূ উপরিস্থিত পানি ভূগর্ভে প্রবেশের সুযোগ থাকে বলে জানিয়ে ভূগর্ভে পানির স্তরে একটি সমতা সৃষ্টি হয়’ বলেও জানান তিনি। বিদেশী ঐ প্রশিক্ষনের আলোকে বরিশাল মহানগরীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পানির হাহাকার
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ