Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অস্তিত্ব সঙ্কটে মৌলভীবাজারের নদী ছড়া খাল

হুমকির মুখে জলজ প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য

| প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

এস এম উমেদ আলী মৌলভীবাজার থেকে : মৌলভীবাজার জেলায় অনতম ৫টি নদী হচ্ছে মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই ও জুড়ী নদী। অন্যদিকে শাখা নদী বরাক, বিলাস, লাংলী, গোপলা ও আন ফানাই নদী ও খালসহ রয়েছে অসংখ্য ছড়া। দিন দিন বিলিন হচ্ছে জেলার এ নদী, খাল ও ছড়া গুলো। কোন রকম যেগুলো ঠিকে আছে তাও রয়েছে মহা হুমকিতে। মানচিত্রে নদী ও ছড়া থাকলেও বাস্তবে অনেক স্থানে এখন অস্থিত নেই। এক সময়ের খরস্রোতা ঐতিহ্যবাহী এ নদী এখন মৃত। বর্তমানে নেই সেই পূর্বের জৌলস। নাব্য হ্রাসে এখন নিজেদের পরিচিতি পড়েছে সঙ্কটে। তাই খড়স্রোতা নদী নিয়ে শৈশবের স্মৃতির সাথে বিস্তর ফারাক হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের।
এখন ধারণ ক্ষমতা না থাকাতে বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ পানিবদ্ধতা। আর শুষ্ক মৌসুমে মরুভূমি। স্থানীয় নদী গুলোর এমন বেহাল দশায় বিরুপ প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদ। নদীর এমন মুমূর্ষ অবস্থা হলেও দেখার কেউ নেই।
নাব্য হাড়ানো নদী পাড়ের একাধিক স্থানীয়রা বলছেন, এমন দূর্দশা চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যেই দৈন্য দশায় নদীগুলো নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে তাও বিলিন হয়ে যাবে। তারা জানালেন প্রতিবছরই পলি জমে ভরাট হচ্ছে নদী। আর এই সুযোগে চলছে দখল উৎসব। যে যার মত প্রভাব খাটিয়ে চালাচ্ছেন দখলদারিত্ব। এ কারনে ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে দৃশ্যপট। নদী ও ছড়া মানুষের দখলে গিয়ে রুপ বদলাচ্ছে। ভরাট হওয়া অংশে গড়ে ওঠছে ঘরবাড়ি কিংবা ক্ষেতের ভূমি।
এখন এমন বেহাল দশায় মৌলভীবাজারের ৫টি নদী ও অসংখ্য ছড়া। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে যেমন বন্যা হয়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ পানিবদ্ধতা। তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ।
জেলার অন্যতম নদী মনু, ধলাই, ফানাই, সোনাই ও জুড়ীর এখন বেহালদশা। অন্যদিকে শাখা নদী বরাক, বিলাস, লাংলী, গোপলা ও আন ফানাই নদীর অস্তিত্বই বোঝার উপায় থাকে না শুষ্ক মৌসুমে। নাব্য হ্রাসের কারনে বর্ষা মৌসুমে পানির ধারন ক্ষমতা না থাকায় নদীগুলোর দু’তীর ভেঙে প্লাবিত হয় আশপাশের গ্রাম। পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষতিহয় ঘরবাড়ি ও চাষাবাদের। ওল্টো চিত্র শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোতে পানি না থাকায় চাষাবাদ নিয়ে বিপাকে পড়েন তীরবর্তী এলাকার চাষীরা।
নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা জানান মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর, কুলাউড়া উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মনু নদীর বিভিন্ন স্থানে শুষ্ক মৌসুমে চর জেগে ওঠে। কুলাউড়ায় ফানাই, কমলগঞ্জে ধলাই ও জুড়ী উপজেলা জুড়ী ও সোনাই নদীর একই অবস্থা।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামের পাশে কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা বরাক নাম ধারণ করে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শীতকালে বরাক একেবারে পানিশূন্য হয়ে পড়ে। গরু, ছাগল, মেষ চড়ানোসহ সবজী চাষ হচ্ছে নদীর বুকে।
শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট দিয়ে প্রবাহিত লাংলী নদী হেতিমগঞ্জ নামক স্থানে বিলাস নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসা এ নদীর রূপরেখা খালে পরিণত হয়েছে।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানান শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গোপলা নদী তার ঐতিহ্য হারিয়েছে শুধুমাত্র পলির কারণে ভরাট হয়ে।
কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়ের বাসিন্দারা জানান আন ফানান একসময় খর¯্রােতা থাকলেও এখন নানা কারনে ভরাট হয়ে যাওয়াতে নেই সেই জৌলস। সিন্দুরখান এলাকার বাসিন্দারা জানান, লাংলী নদীর বিভিন্ন অঙ্ক বালুমহাল হিসেবে ইজারা দেওয়া হয়। স্থানীয়দের কাছে লাংলী নদী নয় এখন তা কালেঙ্গি ছড়া হিসেবে পরিচিত। শীতকালে নদীর বুকে চাষাবাদ হয় শাকসবজি, চড়ানো হয় গরু ও ছাগল।
অন্যদিকে মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা নদীর অংশের তলদেশ পলি জমে ভরাট হওয়ায় দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি সমান্তরাল হয়ে গেছে। এতে হাওর দু’টি পানি নিষ্কাশন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণে বর্ষা মৌসুমে পানিবদ্ধতা হাওর দুটির নিত্যসঙ্গী। তাই আমন ও বোরো চাষাবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন স্থানীয় কৃষকরা।
অন্যদিকে পলি জমে কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে হাওরের সংযোগ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। এই নদীগুলোর সাথে খাল ও গুলোর সংযোগ নাব্য হ্রাসের কারনে বিলুপ্ত হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদন।
হাকালুকি হাওরের ভুকশিমইল এলাকার স্থানীয় চাষী নজরুল মিয়া, ইব্রাহিম আলীসহ আরো কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন থেকে ভরাট হওয়া নদী ও খাল পুনঃখনন না হওয়াতে বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুমে আগের মত তারা চাষাবাদ করতে পারছেন না। শীতকালে আগে কৃষকরা সেচ সুবিধা পেয়েছিল। তখন কৃষিক্ষেত্রে এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য। এই নদীগুলো দিয়ে একসময় বড় লঞ্চ, নৌকা চলাচল করত। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল নৌপথকে ঘিরে। অথচ এখন শুষ্ক মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে এই নদীগুলো পার হতে হয়। কালের প্রবাহে এই নদী গুলো ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে খালে পরিনত হয়েছে।
সদর উপজেলার মিরপুর এলাকার মৎস্যজীবী সত্তর উর্ধো জমসেদ আলী জানান, প্রায় ৫০ বছর পূর্বে তিনিসহ এলাকার আরো কয়েকজন বছরের অধিকাংশ সময় মনু নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা অর্জন করতেন। বর্তমানে নদীতে চর জেগে উঠায় ও নাব্য হ্রাস পাওয়ায় জাল ফেলার পানিটুকু নেই নদীতে। তারা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে গেছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ. স. ম ছালেহ সুহেল বলেন নদী ও খালগুলো ভরাট হয়ে অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছসহ জলজপ্রাণি ও উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভরাট হওয়া এজেলার স্থানীয় নদী ,ছড়া ও খালগুলো পরিকল্পিত ভাবে দ্রæত খননের প্রয়োজন। এগুলো পুনঃখনন হলে তখন অবৈধ দখলও থাকবেনা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল কুদ্দুছ আখন্দ বলেন, নাব্য হ্রাসের কারনে দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী এখন মহা সঙ্কটে। নাব্য হ্রাসে মাছের যেমন প্রজনন সমস্যা হয় তেমনি মাছের বংশ বিস্তারেও বিরুপ প্রভাব পড়ে। আর শুস্ক মৌসুমে পানি না থাকাতে মাছের আবাসস্থলই বিলুপ্ত হয়। মাছ বেঁচে থাকার জন্য কমপক্ষে ৪ ফুট আর প্রজননের জন্য কমপক্ষে ১ ফুট গভীরতার প্রয়োজন। কিন্তু দিন ভরাট হচ্ছে পানির এসকল উৎসস্থল তাই গুলো দ্রæত সংস্কারের প্রয়োজন। দেশী প্রজাতির মাছ বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাদের নিরাপদ আবাসস্থলও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নাব্য হ্রাসের কারনে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ায় নদী ও খাল নির্ভর জীবিকা নির্ভর মৎস্যজীবীরাও এখন বিপাকে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোহাম্মদ শাহজান বলেন পানির উৎস্থলগুলোর নাব্য হ্রাসে কারনে মারাতœক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন কৃষিজীবী লোকজন। এ সকল উৎসস্থল গুলোর পানির ধারন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বন্যা, আগামা বন্যা বা অতিরিক্ত বৃষ্টিতে কৃষকের লাগানো ফসল বার বার নষ্ট হয়। তেমনি নাব্য হ্রাসের কারনে বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘ পানিবদ্ধতায় কৃষি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতিহয়। আর শুস্ক মৌসুমে ওইসকল উৎস্থলে পানি না থাকায় মৌসুমি ফসল চাষ করাও সম্ভবপর হয়না।
জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সোরাব উদ্দিন আহমদ বলেন, নদী, হাওরসহ জলাধারগুলোর নাব্য হ্রাসের কারনে ভূ গর্বস্থ পানির স্তর দিন দিন নীচে নেমে যাচ্ছে। এতে মারাতœক বির্পযয় ঘটছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের। সরকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পানির এ সকল উৎসস্থলগুলো বাঁচিয়ে রাখতে উদ্দ্যোগী হচ্ছেন। নদী, হাওর পুঃন খনন ছাড়াও ঘন বসতি ও পতিত জায়গায় পুকুর ও জলাশয় তৈরী করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সময় উপযোগি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তী জানান, জেলায় ৫টি নদী ও আড়াই শতাধিক ছড়া রয়েছে। এগুলোর উৎপত্তি স্থল ভারত। বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে পলি নিয়ে আসে এবং নদীগুলোর বাঁকে বাঁধা পেয়ে পলি ভরাট হয়ে নাব্য হ্রাস পাচ্ছে। বন্যা ও খরা থেকে জলজপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় ভরাট হয়ে যাওয়া নদী গুলো খননের প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় স্থানীয় নদী গুলো খনন ও স্থায়ী সুরক্ষায় একটি প্রস্থাবনা ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এবিষয়ে সরকারের পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি বলেন হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ নিষ্কাশন ও উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন সরকার। এই প্রকল্পে অতি জরুরী কাজ গুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হবে। তিনি আরো জানান জেলার সোনাই নদীর ৮ কিলোমিটার খনন কাজ শিগগিরই শুরু হবে এতে ১৮ কোটি ৭৯ লাখ প্রাকল্লিত ব্যয় ধরা হয়েছে। আর জুড়ী নদীর ১০ কিলোমিটার খননে প্রাকল্লিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এই কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। ৮ মার্চ টেন্ডার ওপেনিং হবে। কাজও শুরু হবে খুবই দ্রæত।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ