Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অস্তিত্ব সঙ্কটে ১৬ নদী

কুড়িগ্রামে ভারতের গজলডোবা আর গিরিধারী বাঁধের প্রভাব

| প্রকাশের সময় : ১৯ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর বিশাল জলরাশি এখন নেই। হারিয়ে গেছে এ অঞ্চলের চকচকে কাজলী মাছ আর আব্বাস উদ্দিনের চিলমারীর বন্দর। ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি চিলমারীর বন্দরে.......। এটি এখন গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বয়ে যাওয়া নদী গুলো এখন প্রায় পানি শূন্য। যেদিকে তাকানো যায় শুধু বালি আর বালি। সব নদীর চিত্র একইরকম। কুড়িগ্রামের নদী তীরবর্তী এলাকায় নদীর পানি শন্য হয়ে পড়ার বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের উজান থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন মেট্রিক টন পলি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তার মধ্যে ৮০ ভাগ পলি কুড়িগ্রামের বিভিন্ন নদী দিয়ে আসে। ফলে নদী গুলো দ্রæত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে শিশু, মেহগনি, বাবলা সহ নানা জাতের বড় বড় গাছ অকালে মরে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় জীব বৈচিত্র এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
চোখের সামনে কুড়িগ্রাম জেলাজুড়ে জালের মত বিছিয়ে থাকা সব নদী একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। যে নদীর বুকে আগে প্রবল ঢেউ আর ঢেউয়ের দোলা ছিল সেসব নদীর শুষ্ক বুকে এখন বালি আর বালি। পানির অভাবে নদী মরে যাচ্ছে, যা কুড়িগ্রামকে স্থায়ী মরুকরণের পথে নিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকমোরসহ ১৬টি নদ-নদীর পরিণত হয়েছে শুকনো খালে। ভারতের উজানের পানি প্রবাহ ভয়াবহ ভাবে কমে, নদীতে পলি জমে, জলাধারগুলো ভরাট হয়ে একের পর এক নদী মরে যাচ্ছে।
উজানে ভারত থেকে পানিপ্রবাহ কমে আসার কারণেই নদীগুলো মৃত্যুর প্রহর গুণছে। তিস্তা চুক্তি না করা এবং উজানে তিস্তা নদীতে ভারতের বেশ কয়েকটি বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহারের কারণে পানিপ্রবাহ বস্তুত শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
একসময়ের স্রোতস্বিনী নদ-নদী ফুলকুমোর, কালজানি, গঙ্গাধর, সংকোশ, ধরনী, জিঞ্জিরাস,হংস, নীলকোমল, শিয়ালদহ, সোনাভরি, হলহলিয়া, জালছিরা, এমন অনেক নদী হারিয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে অনেক ঘাট। কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়,জেলার ৫৪টি ঘাটের মধ্যে অধিকাঙ্ক ঘাট বন্ধ হতে চলেছে। শত শত নৌকার মাঝির চলছে চরম দুর্দিন।সেই সাথে ঘাট শ্রমিকরা পড়ছে বিপাকে।
ধরলা এখন মরা গাঙ
ধরলা নদী দক্ষিণপূর্ব তিব্বতের হিমালয় হতে উৎপন্ন হয়ে “চুমবি” নাম ধারণ করে চুমবি উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর ‘আম-চু’ নামে দক্ষিণ দিকে তিব্বত ও ভুটানের মধ্য দিয়ে ভারতের উঃ পঃ পশ্চিমবঙ্গে তোরসা নামে প্রবেশ করেছে। ভারতের কোচবিহারের পশ্চিমে তোরসা ধরলা নাম ধারণ করে জলঢাকা নদীতে পতিত হয়েছে। জলঢাকা নামে কিছুদুর প্রবাহিত হওয়ার পর পুনরায় ধরলা নদী নামে কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার কর্তপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ধরলা নদী প্রায় ৩২২ কিলোমিটার দীর্ঘ। বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর ধরলা নদী লালমনিরহাটজেলার কোল ঘেঁষে কুড়িগ্রাম শহর ছুঁয়ে উলিপুর উপজেলার মধ্যদিয়ে দক্ষিণ পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বাগুয়ার নিকট ব্রক্ষপুত্র নদের সঙ্গে মিশে গেছে। কর্তপুর থেকে বাগুয়া পর্যন্ত ধরলা নদীর সরাসরি দুরত্ব প্রায় ৪৮ কিলোমিটার। খর¯্রােতা ও তীব্র ভাঙন প্রবণ নদীটি আঁকাবাঁকা পথে গমনের জন্য বাংলাদেশ অংশে ধরলা নদীর দূরত্ব প্রায় ৫৩ কিলোমিটার।
ভারতের একতরফা পানি আগ্রাসনের ফলে তিস্তা, গঙ্গা ও পদ্মাসহ বাংলাদেশের অনেক নদী এখন মৃত প্রায়। এবার সে আগ্রাসনে ধরলা নদী পরিণত হলো মরা গাঙে। বাংলাদেশের তীব্র আপত্তিকে উপেক্ষা করে ভারত গ্রীধারি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করেছে। ভারত থেকে নেমে আসা গ্রীধারি নদী ধরলার সাথে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ফলে এই বাঁধের বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমে ধরলা নদীতে ভয়াবহ নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়। ধরলা পরিণত হয় মরা গাঙে। আর বর্ষায় এই নদীতে দেখা দেয় ব্যাপক ভাঙন। স্থানীয় অধিবাসীরা জানায়, এই বাঁধ নির্মাণের ফলে আসন্ন বর্ষায় ধরলা নদীর ভাঙন আরও প্রকট হবে। এই বাঁধের বিরূপ প্রভাবে গেল বর্ষাতেও ধরলা নদীর ভাঙন তীব্র হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের ভাষ্যমতে, গেল বর্ষায় ধরলা নদীর ভাঙনে অসংখ্য ঘরবাড়ী, আবাদি জমি, স্থাপনাসহ কমপক্ষে ২ শতাধিক কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র নদ এখন ধূধূ বালুচর হারিয়ে গেছে আব্বাস উদ্দিনের চিলমারী বন্দর
ব্রহ্মপুত্র নদ ৫১৫০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।তিব্বতের হিমালয় পর্বতের কাছে মানস সরোবর উৎপন্ন হয়ে তিব্বত ও আসামের প্রায় ১৯৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার যাত্রাপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্র গড়ে সর্বোচ্চ ৬৫৪০০ঘনমিটার/সেকেন্ড (বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে) পানি বহন করে।তলদেশের গঠন বৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভূ-খন্ডের ঢালজনিত কারনে তীব্র ভাঙ্গন প্রক্রিয়া ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছ। ফ্লাড অ্যাকশন প্লান (ফ্যাপ-২২)এর প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের ডানতীরের পশ্চিম দিকে বার্ষিক ভাঙ্গনের হার গড়ে ৫০ মিটার।কুড়িগ্রাম জেলায় ব্রহ্মপুত্রের যতটুকু তটরেখা আছে তা কমবেশী ভাঙ্গন প্রবণ।বিখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের “ ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে” গানের চিলমারী বন্দর অতল গর্ভে হারিয়ে গেছে”। ব্রহ্মপুত্র নদ এখন ধূধূ বালুচর।
ভারতের উজান থেকে প্রায় ২ বিলিয়ন মেট্রিক টন পলি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তার মধ্যে বেশীর ভাগ পলি ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে আসে। ফলে নদী গুলো দ্রæত ভরাট হয়ে যাচ্ছে।সেই সাথে নতুন নতুন অসংখ্য চরের সৃষ্টি হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন চর গুলোর পাশ দিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ক্যানেলের। ফলে ভারতের উজান থেকে যে টুকু পানি আসে তা ক্যানেল গুলোতে প্রবেশ করায় সেই পানি আর বেশীদুর এগুতে পারে না।ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আর থাকে না।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে যাত্রাপুর ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে রয়েছে ঐতিহ্যবাহি যাত্রাপুর হাট। হাটটি ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে অবস্থিত। হাটের পাশেই ছিল নৌঘাট। নদীতে পানি একেবারে কমে যাওযায় ঘাটটি হাট থেকে প্রায় ২কিলোমিটার দূরে চর যাত্রাপুর এলাকায় সরে নেয়া হয়েছে।ঘাট যেতে পায়ে হাঁটা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই।ঘাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে ঝুনকার চর এলাকা ঐ এলাকা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতের আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।ঐ এলাকা থেকে চিলমারী পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং বর্ষার সময় পলিমাটি আসায় এই ৫০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩শতাধিক চরের সৃষ্টি হয়েছে। ঐ ইউনিয়নের ভগবতীপুর চরের মাহবুব(৭০) জানায়, আগে নদী দিয়ে বড় বড় পানি জাহাজ চলাচল করতো। জাহাজ গুলো ভারতের আসাম থেকে এই পানি পথে চিলমারী বন্দর হয়ে নারায়নগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেত। এখন নদীতে পানি একেবারে নেই। জাহাজতো দুরের কথা নৌকাও ঠিকমত চলে না।কথা হয় নদী তীরবর্তী উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হোসেনের সঙ্গে সে জানায় তার ইউনিয়নের ৩ভাগের ২ভাগ ক্রমাগত ভাঙনে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে ধূধূ বালুচরের সৃষ্টি হয়েছে। নৌকার মাঝিরা বেকার হয়ে পড়েছে সেই সাথে নদীতে তেমন পানি না থাকায় মাছ শিকার করতে না পেরে জেলেরা বেকার জীবনযাপন করছে। ভারত যদি ব্রহ্মপুত্রের তাদের অংশে বাঁধ নির্মাণ করে তাহলে ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ