Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

চোখের পানিতে ভাসছে ঢাকা

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দু’টি জরীপ বের হয়েছে। একটিতে বলা হয়েছে ‘সুখী মানুষের র‌্যাংকিং এ বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে’। আরেকটি জরীপে বলা হয়েছে ‘বিশ্বের যেসব দেশের রাজধানীতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যায় বেড়ে গেছে ঢাকা তার অন্যতম’। অর্থাৎ ঢাকার নাগরিকদের লিভিং স্টান্ডার্ড এ এক বছর আগে যে অর্থ ব্যয় করতে হতো; এখন তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। কোন মানদন্ডে জরীপ হয়েছে জানা না গেলেও চোখ বন্ধ করেই বলা যায় দুটি জরীপই যথার্থ। আন্তর্জাকিত র‌্যাংকিং-এ বাংলাদেশ যতই গরীব দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত, সেখান থেকে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার হাতছানি হোক; এবং দেশ উন্নয়নের যত বড় মহাসড়কে উঠুক না কেন মানুষের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং অনিশ্চয়তা থাকলে নাগরিকরা সুখী হতে পারেন না। আর দ্বিতীয় জরিপটি সম্পর্কে ঢাকা মহানগরে যারা বসবাস করেন তারা হারে হারে টের পাচ্ছেন।
এই যে রাজধানী ঢাকায় শত শত আকাশ ছোঁয়া বিল্ডিং উঠছে; দৃষ্টিনন্দন মার্কেট-স্থাপনা তৈরি হচ্ছে এর এক স্কোয়ার ফিট বিল্ডিং এর দাম এলাকাভেদে ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। মানুষ সেসব কিনে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে ঠিকই; কিন্তু মানুষ কী স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন? বস্তির বৃত্তহীন থেকে শুরু করে বারীধারার বৃত্তশালী সবারই প্রায় অভিন্ন অবস্থা। যে নিত্যদিন রিক্সায় এবং পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন রাস্তায় নামলে তার যেমন দুর্গতি; তেমনি যিনি কোটি টাকার দামী গাড়িতে চলেন, বছর বছর গাড়ির মডেল পরিবর্তন করেন তাঁর একই অবস্থা। নিত্যদিন যানজটের ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে উপরতলা নীচতলা সব মানুষকে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে। ঢাকার পথে নামা মানেই গন্তব্যে পৌঁছায় অনিশ্চয়তা। ১০ মিনিেিটর পথ পাড়ি দিতে কোথাও এক ঘন্টা কখনো দুই ঘন্টা সময় চলে যায়। যারা চাকরি-ব্যবসা করেন এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তাদের বাধ্য হয়েই নিত্যদিন যানজট যন্ত্রণা সহ্য করতেই হয়। তবে বাধ্যবধকতা না থাকলে সাধারণ মানুষ বাসা-অফিস থেকে ১০-২০ কিলোমিটার দূরের পথে যেতে চান না। এই যে যানজট তার ওপর উন্নয়নের নামে চলছে শহরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক থেকে শুরু করে পাড়া মহল্লার সড়কগুলোতেও এই খোঁড়াখুড়ি বিদ্যামান। কতদিনে এই উন্নয়ন কর্মের ড্রেন বসানো এবং মাটি ভরাট করে রাস্তা মানুষের চলাচলের উপযোগী করা হবে কেউ জানে না। যারা এসব করছেন তারাও নিদৃষ্ট করে কিছুই বলতে পারেন না। দায়িত্বশীলদের এ নিয়ে প্রশ্ন করলে উল্টো চোখ রাঙানীতে পড়তে হয়। সিটি কর্পোরেশনের শত শত মহল্লায় সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে; আবার নতুন করে যেসব এলাকা সিটি কর্পোরেশনে অন্তভূক্ত হয়েছে সে সব এলাকার পাড়া মহল্লার সড়কে বিশাল বিশাল রিং এনে রেখে মানুষের হাটাচলার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মাসের পর মাস বন্ধ করে রাখা হয়েছে রাস্তা। শুধু তাই নয়, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ওই সব সড়কে রিং রেখে দিয়ে ড্রেনের মুখও বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে অনেক এলাকায় স্যুয়ারেজের পানি সড়কে উঠে যাওয়ায় চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। দেখার যেন কেউ নেই।
বিজ্ঞানের বদৌলতে তথ্য প্রযুক্তির যুগে গত কয়েক বছরে রাজধানীতে মিডিয়া বিপ্লব ঘটে গেছে। আগে হাতেগোনা কয়েকটি টিভি ছিল; প্রিন্ট মিডিয়ার সংখ্যাও এতো বেশি ছিল না। কিন্তু পত্রিকায় অব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু ছাপা হলে বা টিভিতে কোনো বিষয়ে সচিত্র খবর প্রচার হলে হৈচৈ পড়ে যেন। প্রশাসনের টনক নড়ে উঠতো। শুরু হতো দৌঁড়ঝাপ। এখন ব্যাঙের ছাতার মতো মিডিয়ার ছড়াছড়ি। সব ধরণের জনগুরুত্বপূর্ণ খবর প্রচার হচ্ছে। অথচ মিডিয়ার কোনো খবর প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাজে গুরুত্ব পায় না। মিডিয়ার খবরকে যেন কেউ পাত্তা দিতে চায় না। প্রশাসনের সেচ্ছাচারিতা, ঘুষখোর, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের এতো বাড় বাড়ন্ত বেড়েছে যে, অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ ও প্রচার হলে সে খবরকে তারা পাত্তাই দেন না। বরং প্রশাসনযন্ত্র যেন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, অনিয়মকারীদের সঙ্গে একাট্টা হয়ে উল্টো মিডিয়াকে দোষারোপ করেন।
রাজধানীর মশার কথাই ধরুন। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরবাসী। বস্তি থেকে শুরু করে গুলশান-বারীধারার অভিযান পাড়ায় মশার প্রকোপ ভয়াবহ। এমনকি মন্ত্রী পাড়া খ্যাত মিন্টুরোড, বেইলি রোড, ধানমন্ডি, মগবাজার, ইস্কাটন গার্ডেন, রমনা, বনানীর বাসিন্দারাও মশার যন্ত্রণায় অস্থির। সাধারণ মানুষের মতোই মশার যন্ত্রণায় মন্ত্রী ও সচিবদের ত্রাহি অবস্থা। স্কুল, হাসপাতাল, অফিস থেকে শুরু করে বিমানের ভেতরে পর্যন্ত মশার আক্রমণ। এমনকি মশার কারণে বিমানের সিডিউল পর্যন্ত বদলাতে হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়। অথচ ঢাকা সিটির একাংশের নগরপিতা নামে পরিচিত মেয়র দাবি করছেন তার এলাকায় মশার যন্ত্রণা কমে গেছে। তাদের দাবি ১২ ফেব্রæয়ারি থেকে তাদের মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম চলছে। এই প্রোগ্রামটি ২৮ ফেব্রæয়ারি শেষ হওয়া কথা থাকলে আরও ১৫ দিন বাড়িয়ে ১৫ মার্চ পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু মশার উপদ্রব না কমে বরং এলাকাভেদে বেড়ে গেছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, কালসী, ভাষানটেক, কল্যাণপুর, দারুসসালাম, নাখালপাড়া, মহাখালী, বাসাবো, খিলগাঁও, মুগদা, শনির আখড়া, কলাবাগান, কাঠালবাগান, রামপুরা, চৌধুরী পাড়া, যাত্রাবাড়ি, কমলাপুর, মানিকনগরের বাসিন্দাদের অভিযোগ মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের ঝিল কচুরিপানায় ভর্তি। এসব কচুরিপানা ভর্তি ডোবা-নালা মশার প্রজনন ক্ষেত্র। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার খালগুলোর অনেক জায়গায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব স্থানেও মশার বংশ বিস্তার হচ্ছে। উন্নয়ন কাজের জন্য খোলা ও ভাঙাচোরা নর্দমাগুলোর জন্যও বাড়ছে মশার বংশ। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় রাজধানীর নিচু জমি, ঝিল ও লেকগুলো ভরে উঠেছে আবর্জনায়। এসব জায়গার মশা নিধনের ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। তাহলে সিটি কর্পোরেশনের মধা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম কোথায় হচ্ছে? পত্রিকায় খবর বের হয়েছে গত অর্থবছরে মশা নিধন কার্যক্রমের জন্য ডিএসসিসির বাজেট বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এই অর্থবছরে ডিএসসিসির বাজেট বাড়িয়ে করা হয় ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর ডিএনসিসিতে এ অর্থবছরে মশক নিধনে বরাদ্দ করা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। কিন্তু মশা নিধনের নামে নগরবাসীর সঙ্গে যেন ‘মশকরা’ করা হচ্ছে। মশা নিধনের নামে এমন মশকরা করা হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। ওই সময় মেয়র মশা নিধনের জন্য গাপ্পি মাছ এনে নগরীর ড্রেনে ছেড়ে দিয়ে নগরবাসীর সঙ্গে মশকরা করেছিলেন। এখনো কী সেই মশকরা চলছে? যানজট, ময়লার দুর্গন্ধ, মশার কামড়, আয়ের চেয়ে ব্যায় বেশি চরম দর্দশায় দিনযাপন করছে মানুষ। উচ্চবৃত্ত নিম্নবৃত্ত কোথাও সুখ নেই। রাস্তায় নামলে যানজটে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে; বাজারে গেলে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি দেখে চোখের পানি ফেলতে হচ্ছে। এছাড়াও চলাফেরা-স্কুলভর্তিসহ নাগরিকরা নানামুখী দুঃখ-দুর্দশায় চোখের পানি ফেলছেন। অথচ দেখার যেন কেউ নেই।



 

Show all comments
  • কামরুল ১৭ মার্চ, ২০১৮, ৩:৫২ এএম says : 0
    এই শোক আসলেই সইবার মত নয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা

৮ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ