Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাহাড় কেটে সাবাড়

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

//- চট্টগ্রামের পাহাড়-টিলা ধ্বংস অব্যাহত ভূমিদস্যুরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
- ‘আসন্ন বর্ষায় আরও বড়ধরনের পাহাড়ধস হতে পারে। যার পাহাড় তাকে দায়-দায়িত্ব নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পাহাড় সুরক্ষা করতে হবে’ -সাবেক ভিসি চুয়েট//
সাবাড় হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কেটে খুঁড়ে ছেঁটে সারি সারি বসতঘর তৈরি হচ্ছে। ভূমিদস্যুরা সেসব ঘর ভাড়া দিচ্ছে গরীব দিনমজুরদের কাছ থেকে। সুযোগ বুঝে এক পর্যায়ে সমতল করে সেখানেই নির্মিত হচ্ছে পাকা ভবন এমনকি বহুতল ভবন। পাহাড়-কাটা বালিমাটির ব্যবসাও চলছে অবাধে। ঠিক সাত-আট মাস আগে গত বছরে সমগ্র চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে জানমালের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির দাগ না শুকাতেই এ অঞ্চলের সুশোভিত পাহাড়-টিলা বন-জঙ্গল ধ্বংসলীলা অব্যাহত রয়েছে। পাহাড়খেকো ভূমিদস্যুরা থেকে যাচ্ছে আগের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর গরীব জনগোষ্ঠির পাহাড়ের ঢালে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে করছে বসবাস। এদের সংখ্যা কমপক্ষে ৮ লাখ। শুষ্ক মওসুম শেষ না হতেই প্রাক-বর্ষা শুরু হবে। প্রতিবছর দেখা যায় বর্ষায় এমনকি তার আগে-পরেও আকস্মিক ভারী বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল নামলেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলায় ধস নামে। শুষ্ক মওসুমে বর্ষার আগে চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর জেলার প্রায় সর্বত্র ভূমিদস্যুরা অবাধে পাহাড়-টিলা কেটে-খুঁড়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ফেলে রাখে। আর যখন বৃষ্টিপাত শুরু হয় তখনই সেসব কাটা-ভাঙা ও ভঙ্গুর পাহাড় টিলার ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকে একে একে পাহাড়ে-টিলায় ও ঢালুতে ভয়াবহ ধস নামতে থাকে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এর অন্যতম কারণ উল্লেখ করে জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়গুলোর ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিকভাবে গঠন-গড়ন বালুমাটির এবং সেগুলো অত্যন্ত নরম, শিথিল। এতে করে বর্ষায় বৃষ্টির পানি ভাঙা পাহাড়ের ছিদ্র দিয়ে ভেতরে গেলেই বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠে।
চট্টগ্রামের পাহাড়-টিলা কেটে-ছেঁটে-খুঁড়ে ধ্বংসলীলা প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাইলে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক ভিসি ও ভূ-তাত্তি¡ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম গতকাল (শুক্রবার) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ‘আসন্ন বর্ষায় আরও বৃহৎ আকারে পাহাড়ের ধস নামতে পারে। পাহাড়ধস ও এ কারণে বিপর্যয় ক্ষয়ক্ষতি রোধে যার পাহাড় তাকে দায়-দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন- চট্টগ্রামে সিডিএ, সিটি কর্পোরেশন, রেলওয়ে, ওয়াসা, গণপূর্ত, জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি তথা ব্যক্তিবর্গও পাহাড়ের মালিক। শুধু বর্ষাকালে পাহাড় ছেড়ে যেতে মাইকিং করলেই চলবে না। এর টেকসই সামাধানের জন্য গতবছর বিশেষজ্ঞ কমিটির দেয়া ২৭ দফা সুপারিশমালা আশু বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে প্রকৌশল ও প্রযুক্তিগতভাবেই পাহাড় রক্ষা করতে হবে’। তিনি আরও জানান, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসনে পাহাড়-টিলাসমূহ ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়েছে। এর পরিণতিতে সেখানে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এ ব্যাপারে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ শহিদুল ইসলাম তার এক গবেষণাপত্রে বলেন, সংরক্ষিত রেকর্ডপত্র অনুযায়ী ১৯৬৮ সালে কাপ্তাই এলাকায় প্রথম পাহাড়ধস তথা ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে এটি ক্রমবর্ধমান এক বিপর্যয়। এতে এ পর্যন্ত এত মানুষ মারা গেলেও দেশের দুর্যোগ আইন-বিধিতে ‘পাহাড়ধস’ নামে কোনো শব্দ নেই। সেই সুবাদে পাহাড় কেটে-খুঁড়ে বেদখলকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া সরকারি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও তা কার্যত গুরুত্বহীন। পাড়াড়ধসের কারণে দেশের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষতি ছাড়াও বন-জঙ্গল, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। ড. জাহাঙ্গীর আলম, ড. শহিদুল ইসলামসহ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো বালুময়। এক-দেড় ফুট নিচেই বালুর আস্তরণ বা লেয়ার রয়েছে। এতে পানি প্রবেশ করে ভারী হলেই পাহাড় ধসে যেতে পারে। তদুপরি পাহাড় কাটা-খুঁড়ে ফেলাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডের ফলে পাহাড়ের ভেতরে আরও অনেকগুলো ফাটল, গর্ত, ছিদ্র তৈরি হয়। আর বৃষ্টির ফলে পানি ঢুকে ব্লক আকারে পাহাড়ের ধস সৃষ্টি হতে পারে। যা বিপজ্জনক। উপরোক্ত দুই বিশেষজ্ঞ পাহাড়ধস রোধে গঠিত সরকারি কমিটির সদস্য ছিলেন।
অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম ইনকিলাবকে জানান, চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-টিলা কেটে ফেলার কারণে বিশেষত দক্ষিণ খুলশী, কৈবল্যধাম, নাসিরাবাদ এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেড়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়-টিলা এলাকার মধ্যে রয়েছে, সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাস-লালখান বাজার, মতিঝরণা পাহাড়, টাঙ্কির পাহাড়, মোজাফফর নগর পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, বন গবেষণাগার সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়, রেলওয়ের মালিকানাধীন বিভিন্ন পাহাড়, ফ’য়স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, গরিবউল্লাহ শাহ মাজার সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়, এ কে খান কোম্পানির পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, জালালাবাদ পাহাড়, জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার পাশের পাহাড়গুলো ইত্যাদি। চট্টগ্রাম মহানগর ও শহরতলী এলাকায় বর্তমানে বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থায় আছে ১৭টি পাহাড় টিলা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বন্দর নগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বর্তমানে একশ’রও বেশি পাহাড়-টিলায় ও তার পাদদেশে ১৫ লাখেরও বেশি লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছে। যাদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষজন। মহানগরী ছাড়াও জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, মিরসরাই, সীতাকুন্ড, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী এবং তিনটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে অগণিত মানুষের পাহাড়ের ঢালে বসবাস।
গতবছর ১১, ১২ ও ১৩ জুন ভারী বর্ষণে পাহাড়-টিলা ধসে গিয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে পৌনে ২শ’ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। তখন সরকারের গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি ২৭ দফা সুপারিশ পেশ করে। ইতোপূর্বে ২০০৭ সালের ১১ জুন চট্টগ্রামে পাহাড় ধস ট্র্যাজেডির (নিহত ১৩৬ জন) ঘটনায় একটি টেকনিক্যাল কমিটি পাহাড় ধসের পেছনে ২৮ কারণ চিহ্নিত এবং পাহাড়ধস রোধে সরকারের কাছে ৩৬ দফা সুপারিশ পেশ করেন। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে তা আজও হিমাগারে পড়ে আছে।
চুয়েট-এর সাবেক ভিসি ড. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে বসতঘর তৈরি করা হয়। বর্ষায় তা ধসে গিয়ে বিপর্যয় ঘটে। শুধু তাই নয় পাহাড়ের ধোয়া বালিমাটি নগরীতে ছড়িয়ে পড়ে নালা-নর্দমা ভরাট ও অকেজো করে দেয়। যতই ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার করা হোক না কেন পাহাড় কাটা ও ধস বন্ধ না হলে তা টিকবে না। টেকসই সমাধানের জন্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তি-নির্ভর বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে সকলের সমন্বয়ে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাহাড়

২০ জুন, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ