Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আজ ভোক্তা অধিকার দিবস অসহায় ভোক্তারা ঠকছেন

| প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নিত্যপণ্য সেবা ক্রয়ে হরেক পথে প্রতারণা কারচুপি শুভঙ্করের ফাঁকি : ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে প্রয়োগ কদাচিৎ : নেই বাজার তদারকি, অসংগঠিত ভোক্তা-ক্রেতা সাধারণ
শফিউল আলম
দোকান-পাট মার্কেট শপিং মল ওষুধের শো-রুম চেইন শপ কাঁচাবাজার সবখানেই হরেক পণ্যসামগ্রী থরে থরে সাজানো। অনেক সময়ই থাকে লোভনীয় মূল্যহ্রাসের অফার টানানো ব্যানার ফেস্টুন পোস্টার। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই ভিন্ন চিত্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্যটির মূল্য লেখা নেই, মূল্য তালিকা টানানো নেই। উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ নেই কিংবা নতুন আরেকটি কাগজে তারিখ বসিয়ে, ঘষামাজা করে দেয়া হয়েছে। আমদানিকৃত বিদেশী ফলমূল বাজারে অবাধে বিকিকিনি হচ্ছে ফরমালিনসহ হরেক বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে। মাছেরও একই দুরবস্থা। গরু ছাগলের গোশত বিক্রিতে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার তদারকির কোনো বালাই নেই। আমদানি পণ্যের ক্রয়মূল্যের (সিএন্ডএফ ভ্যালু) চেয়ে পাইকারি দর অযৌক্তিক হারে বেশী। আবার খুচরা বিক্রেতারা যথেচ্ছ পকেট কাটছে আরেকদফায়। শাক-সবজি, ফল-ফসলসহ যাবতীয় কৃষি-খামারজাত পণ্যের মাঠের দর পানির মতো। ঠকছে কৃষক। সেই একই পণ্য বাজারে বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশী দামে। ফায়দা লুটছে মধ্যস্বত্ত¡ভোগী ও ফড়িয়ারা।
বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রয়োগ হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখের পরও অথবা নকল ওষুধ। সুপার শপ থেকে ফুটপাত পর্যন্ত বেচাকেনা হচ্ছে বিদেশী হরেক নামিদামি ব্রান্ডের নামের নকল পণ্যসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, টেলিফোন-টেলিকম, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ বিভিন্ন সেবা-পরিসেবা খাতে উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করেও সাধারণ জনগণ প্রত্যাশিত মানের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনে গলাকাটা ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বাড়িভাড়া আদায়ে যথেচ্ছ নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও টিউশন ফি’র নামে নৈরাজ্য চলছে। আর এমননিভাবেই অসহায় ভোক্তারা ঠকছেন প্রতিনিয়তই। প্রতিদিন ভোক্তা-ক্রেতাদের বাড়তি ডেমারেজ বা মাশুলের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় কয়েকশ’ কোটি টাকা। এই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায় নিত্যপণ্য ও সেবা ক্রয়ে হরেক পথেই হচ্ছে কারচুপি, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি আর শুভঙ্করের ফাঁকি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে আইন আছে। তবে তার প্রয়োগ হচ্ছে খুব কদাচিৎ। নেই বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান থাকলেও বিভিন্ন সরকারি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের নির্লিপ্ততায় তা চোখে পড়ে না। আর অসংগঠিত ভোক্তা-ক্রেতা সাধারণকেই গুণতে হচ্ছে এর মাশুল।
এদিকে আজ (বৃহস্পতিবার) ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণ’। দেশের ভোক্তা সাধারণের অধিকার আদায় বা সংরক্ষণে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’-এর আওতায় বিভিন্ন ধরনের আইনি প্রতিবিধান রয়েছে। (২০০৯ সনের ২৬নং আইন )। যদিও এ বিষয়ে ভোক্তার আইনি প্রতিবিধান লাভ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে উদোগের অভাব রয়েছে। ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য প্রতিরোধ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে বিধান হিসেবে এই আইন-বিধিমালা প্রণীত হয়। এরমধ্যে রয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার তদন্তের ক্ষমতা, পরোয়ানা জারির ক্ষমতা, প্রকাশ্য স্থান, ইত্যাদিতে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষমতা, তল্লাশি ইত্যাদির পদ্ধতি, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্যের জন্য দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি সাময়িকভাবে বন্ধের নির্দেশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সহায়তা গ্রহণ, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য সামগ্রীর উৎপাদন, বিক্রয় ইত্যাদির উপর বাধা-নিষেধ, নমুনা সংগ্রহের ক্ষমতা, বাজেয়াপ্তযোগ্য পণ্য ও বাজেয়াপ্তকরণ পদ্ধতি, ভেজাল পণ্যের সরাসরি আটক ও নিষ্পত্তি ইত্যাদি। অপরাধ, দÐ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রয়েছেÑ পণ্যের মোড়ক ইত্যাদি ব্যবহার না করা, মূল্যের তালিকা প্রদর্শন না করা, সেবার মূল্যের তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, ধার্য্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয় করা, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, খাদ্য পণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারণা, প্রতিশ্রæত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি, পণ্যের নকল উৎপাদন, মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্যাবলী করা, অবহেলা ইত্যাদি দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য, জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো, মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলা দায়ের, অপরাধ পুনঃসংঘটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অপরাধের দÐসমূহ।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভোক্তা-ক্রেতা সাধারণের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকারের কাছে বিভিন্ন সুপারিশ করে। এরমধ্যে রয়েছেÑ ১২ থেকে ১৫টি খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সেসব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য ‘সরবরাহ ও মূল্য’ নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক বিভাগ অথবা একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা, বিকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার দায়িত্বে একটি পৃথক উইং প্রতিষ্ঠা, ধান-চালের মূল্য স্থিতিশীল রাখা ও কৃষককে উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ‘কনট্রাক্ট গ্রোয়িং’ পদ্ধতি অনুসরণ করা, ধান কাটার মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি সরকার নির্ধারিত মূল্যে ধান-চাল সংগ্রহ ও তাদের জন্য শস্যবীমা প্রথা প্রবর্তন, বাড়ি ভাড়া আইন ১৯৯১ অনতিবিলম্বে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুসারে বাড়ি ভাড়া কমিশন গঠন, ডাক্তারদের ফিসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ, ওষুধের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সুলভে মানসম্মত চিকিৎসা সেবা প্রদান নিশ্চিত করা, শিক্ষাখাতে অনিয়ম-দুর্নীতি দূরীভূত করার লক্ষ্যে অবিলম্বে শিক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। এছাড়া আছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইন-ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯, প্রতিযোগিতা আইন ২০১২, নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫-এর বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ, ওষুধ নীতি বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা, জনস্বার্থে সিটি কর্পোরেশন ও অনান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার মান, মূল্য নিয়ন্ত্রণে আইনানুগ কার্যকর ভূমিকা পালন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য হ্রাসের সুফল ভোক্তারা যাতে পেতে পারে সেই লক্ষ্যে আমদানি বাণিজ্যকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করা, মুদ্রা বিনিময় হারের পরিবর্তনের কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম যাতে বৃদ্ধি না পায় সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা ইত্যাদি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোক্তা অধিকার তদারকি বা মনিটরিং-বিহীন অবস্থায় লঙ্ঘিত এবং ভোক্তারা উপেক্ষিত থাকলে সাধারণ জনগণের জীবন-জীবিকার ন্যুনতম মান বজায় রাখাই হবে কঠিন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কাঁচাবাজার

২৬ জুন, ২০২১
১৭ এপ্রিল, ২০২১
২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
১৬ জানুয়ারি, ২০২১
৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ