পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
“প্রকৃত পহলওয়ান নহে কভু সেই
ধরাকে বীরত্বে মুগ্ধ করিয়াছে যেই
অথবা ওজন যুক্ত ভারি বোঝাগুলো
বহিয়া নিবার পারে শির পরে তুলি
যে জন আপন ক্রোধ পারে দমাবার
ক্রোধকালে হিতাহিত জ্ঞান থাকে যার
ক্রোধকালে নাফরমানি না করে স্থির
রহে যেই প্রকৃত সেই মহাবীর।” -আল হাদীস
হাদীসটি আলেম-উলামাদের অজানা নয়। কিন্তু একী কথা। ...“এদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয় বাংলার মাটিতে একটি মাজারও থাকতে দেওয়া হবে না। ....অনেক মাজারকে অস্ত্রের গুদাম বানানো হয়েছে। .....মাজার পূজারীরা সন্ত্রাসী জঙ্গি। দেশে এরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।” কোন দায়িত্ববান ব্যক্তির মুখ থেকে এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য উস্কানীমূলক কথা কেউ আশা করে না। এমন লড়াইয়ের হুংকারও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। অথচ একোন দায়িত্ব জ্ঞানহীন সাধারণ লোকের কথা নয়। কথাগুলো জনসভাতেই বলেছেন একজন মর্যাদাশীল দায়িত্ববান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি হলেনÑ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও দারুল উলুম হাট হাজারী মাদরাসার অন্যতম শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবু নগরী। কিছুদিন আগে সিলেটের জয়ন্তপুর জাফলংয়ে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে গেছে তাতে বিবেকবান ব্যক্তি মাত্রই ব্যথিত হয়েছেন, যার যার সাধ্য অনুযায়ী এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে, গ্রেফতার করে, বিচারের সম্মুখীন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসনও এ ব্যাপারে সক্রিয়। তাই বলে এ ঘটনার জের ধরে সারাদেশে জঙ্গি অবস্থার সৃষ্টি করার প্ররোচনা সমর্থন করা যায় না। মুসলমানদের ‘মুশরিক’। ‘পূজারী’ বলে আখ্যায়িত করাও সমর্থন যোগ্য নয়। এদেশের সাধারণ মানুষ ‘পীরভক্ত’ পীর পূজারী নয়। ‘মাজার পূজারী নয়’ মাজার জিয়ারতকারী। তারা ‘মুসলমান’ ‘মুশরিক’ নয়। বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে পাকিস্তানে কী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, আফগানিস্তানের কী হালত হয়েছে, কী দশা হয়েছে, সিরিয়ার কী হাল দাঁড়িয়েছে তাতো চোখের সামনেই রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী মুসলিম দেশে দেশে আজ রক্তের বন্যা বইছে, মা-বোনের বেইজ্জতি হচ্ছে, অশ্রæর প্লাবন বইছে, আর্তপীড়িত মজলুমের হাহাকার চলছে, বিধবা এতিমের আহাজারীতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠছে, তা কি কারো অজানা? বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তে এখন অসহায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের আর্তনাদ। উত্তরপূর্ব সীমান্তে আসামের মুসলমানরা উচ্ছেদের ভয়ে দিশেহারা। এখন সব ব্যাপারেই আমাদের ধৈর্য্যরে প্রয়োজন, দূরদর্শিতা বিচক্ষণতা আবশ্যক। উত্তেজনা, অস্থিরতা পরিহার করে প্রয়োজন উদ্ভূত সমস্যার প্রজ্ঞাপূর্ণ সমাধান খোঁজা।
বহু দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশ অনেক শান্তিপূর্ণ দেশ। উগ্রবাদ জঙ্গিবাদ পায়নি কোন জনসমর্থন। এর পেছনে এদেশের আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখ, ইমাম-খতীব, ওয়ায়েজ মুবাল্লিগদের ভূমিকা অপরিসীম। তারা ওয়াজ মাহফিলে মাহফিলে, মসজিদে মসজিদে ইসলামের সাথে যে উগ্রবাদের জঙ্গিবাদের চরম পন্থার কোন সম্পর্ক নেই এ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করছেন, সতর্ক করছেন। এ অবস্থা কোন কিছু দ্বারা নষ্ট করা যাবে না। অশান্তির দাবানল একবার সৃষ্টি হলে তা ক্রমেই বাড়তে থাকে, ছড়িয়ে পড়তে থাকে, বিস্তৃত হতে থাকে। তা আয়ত্তে আনা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তাই আমাদের আবেদন, কেউই এই শান্তির দেশে অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করবেন না। বিশেষত: মূরব্বী শ্রেণীর লোকদের বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আমলোকেরা অতশত বোঝে না, তারা আবেগপ্রবণ, আবেগদ্বারাই পরিচালিত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আবেগ তাড়িত হয়ে অনেক কিছু করে বসে। সে আবেগকে উত্তেজিত করা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মিশরের জগত বিখ্যাত শহীদ হাসানুল বান্নার একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি দরস দিচ্ছিলেন একটি মজলিসে। শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন কিয়াম-লাকিয়াম, মুনাজাত দোয়ায় হাত তোলা ইত্যাদি নানা মাসআলা সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আমি এর উত্তর দেব না। কিছুক্ষণ পরে তাঁর দরসে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন মাজহাবের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেমকে তাঁর নিকটে ডেকে এনে বসালেন এবং ফরজ ওয়াজিব নিয়ে ইখতিলাফ আছে এক একজনকে এমন কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলেন। তারা উত্তর প্রদান করলেন। তিনি আবার এক একজনকে প্রশ্ন করলেন : এ সম্পর্কে তো অমূক ইমাম সাহেব এই বলেছেন, এইরূপ আমল করেছেন এবং তাদের অনুসারীরাও সে মোতাবেক আমল করে আসছেন? তাহলে ইমাম আবু হানিফা বা ইমাম শাফী বা ইমাম মালেক কিংবা ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল কি ভুল করেছেন এবং তাঁদের অনুসারীরা কি ভুল করে যাচ্ছেন? সকলেই বললেন না, ভুল করেননি, তাদের অনুসারীরাও ভুল করছেন না। এটা মুজতাহিদদের ইজতিহাদ। ইজতিহাদটি সঠিক হলে তো দ্বিগুণ সওয়াব আর ভুল করলেও এক সওয়াব। ইমামগণ সঠিক, তাদের অনুসারীগণও সঠিক। শহীদ বান্না বললেন: এই যদি ফরজ ওয়াজিবের ক্ষেত্রে হয়, একে অপরের বিপরীত আমলকারী হওয়া সত্তে¡ও ইমামগণকেও তাদের অনুসারী মুকালিদগণকে সঠিক বলতে পারি, শ্রদ্ধা সম্মান করতে পারি তবে যে সব মাসআলা ফরজ ওয়াজিব সংক্রান্ত নয়, মুস্তাহাব মুস্তাহসান মাত্র সে সব নিয়ে আমরা পরস্পরকে সম্মান দেখাতে পারি না কেন? সেসব নিয়ে আমরা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হই কেন? কিছুক্ষণ পর তিনি আবার বললেন: প্রশ্নকৃত বিষয়গুলো সম্পর্কে আমারও অবশ্যই একটা অভিমত আছে কিন্তু তা আমি এখানে প্রকাশ করছি না এই আশঙ্কায় যে তাতে ক্ষতি হবে। এখন তো আমার মজলিসে উভয় দলের লোকেরা আছেন, দরসেও সবাই নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। আমি আমার মত প্রকাশ করলে তা যাদের অনুকূলে যাবে না কাল থেকে তারা আর আমার দরসে অংশগ্রহণ করবে না। আমি তো সবার ঐক্য চাই। আমরা তো সবাই দেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তখন এ ঐক্য আর থাকবে না। আর এমনটাও তো নয় যে, আমি আজ একটা মত প্রকাশ করলে সকলে তারই ওপর আমল শুরু করে দেবে! এ ইখতিলাফ তো শত শত বছর ধরে চলে আসছে। আজ আমাদের ওলামা নেতৃবৃন্দের এই বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা আবশ্যক। লক্ষ্য হাসিলের জন্য চাই বৃহত্তর ঐক্য. চাই শান্তি। ইদানীং পীর-মাশারেখ তরিকা তাসাউফ, জিকর-আযকার, কবর জিয়ারত ইত্যাদি সম্পর্কে বিষেদাগার করা যেন এক শ্রেণীর লোকের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আয়েম্মায়ে শরীয়ত ও ত্বরিকতের বিরুদ্ধে বেফাঁস কথা বার্তা বলতেও তারা দ্বিধা-সঙ্কোচ বোধ করছেন না। অথচ দুনিয়া ব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার পেছনে তাদের অবদান অপরিসীম। তাদের উসিলাতে তারা নিজেরাও মুসলমান। ঐ যে কথায় বলে- ‘কার উসিলার শিন্নী খাইলা- মোল্লা চিনলা না’ এ যেন তাই। ঐ যে প্রিয় নবী (সা.) বলে গেছেন... ‘ওয়ালায়ানা আখিরু হাজিহিল উম্মাতি আউয়ালাহা’ ‘এই জাতির পরবর্তীগণ পূর্ববতীগণকে অভিশাপ দেবে।’ এ যেন তারই বহি:প্রকাশ। বাংলাদেশে ইসলামের আগমন বিশেষত: কাদের মারফতে? মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ মহাসাগরের দ্বীপে-দ্বীপে সাইবেরিয়ার তুষারাচ্ছন্ন এলাকায় আফ্রিকার গভীর অরণ্যে সাহারা গোবীতে কাদের উসিলায় ইসলামের কালিমা গুঞ্জরিত? হাজার হাজার মাইল সাগর পথ পাড়ি দিয়ে হাওয়াই দ্বীপ পুঞ্জের রাজধানীর (আরবী ‘হুনা লু’লু- ‘এখানে মুক্তা পাওয়া যায়’ এর বিকৃত উচ্চারণ) নাম হনুলুলু হলো কীভাবে, সে ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না।
কোনটি সুন্নাত ও সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত হবে তা বিবেচনায় না এনে কেবল বিদাত বিদাত বলে চিৎকার দিলেই সব বিদাতে সাইয়্যিয়াহ বা ঘৃণিত বিদাত হয়ে যাবে না। নবী করিম (সা.) কি খতম তারাবিহ পড়েছিলেন? কোনো সাহাবি কি সারারাত জেগে নানা মুজাহাদা করেছেন, নফল নামাজ পড়েছেন? নিষিদ্ধ দিনগুলো ছাড়া সারা বছর কোন সাহাবী কি নফল রোজা রেখেছেন? না এমন কোনে প্রমাণ নেই, তবে কি এগুলো বিদাত? খতমে বুখারী অনেক জায়গায়ই হয়, এ যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি বিপদ-আপদ থেকে নাজাতেরও উসিলা। হুজুর (সা.) এর জামানায় কি বুখারী শরীফ ছিল? সাহাবাদের জামানায়ও কি ছিল? এর অনেক পরে বিশুদ্ধ হাদীসের এই কিতাব ইমাম বুখারী (রা:) সঙ্কলন করেছেন? তাহলে এই যে খতমে বুখারী করা হয়, তা কি বিদাত? গুনার কাজ? এই যে তথাকথিত তাহলে হাদীসরা বুখারী শরীফে নাই, তাই মানি না বলছে, তা কি ইনকারে হাদীস হবে না? বুখারী শরীফে বাইরে যে লক্ষ লক্ষ সহীহ হাদীস রয়েছে তা কি অস্বীকার করা হল না? এমত পোষণকারীরা কি মুনকিরে হাদীস হয়ে যায় না? বিচারের ভার বিজ্ঞ আলেম ও সুধী পাঠকদের হাতে।
খুবই আফসোসের বিষয়, লক্ষ হাদীস ছিল যাদের কণ্ঠস্থ তারা মুজতাহিদ ফকীহগণের অনুসরণের মধ্যেই মনে করেছেন দ্বীনি অনুসরণ নিরাপদ অথচ যারা মাদরাসায় পড়েনি, আরবি ইবারত দেখে পড়তে পর্যন্ত জানে না। ১০/২০টি হাদীসও যাদের মুখস্থ নেই তাদের অনেকে বলছে আমাদের ফকীহ ইমামের কোন আবশ্যক নেই।
বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে মূলতঃ পীর-আওলিয়াদের মাধ্যমে, তাদের কাছে আমরা ঋণী, কৃতজ্ঞ। এ জন্যই এদেশের অধিকাংশ মুসলমান তাদের ভক্ত। এদেশে যত মাদরাসা-মসজিদ তা তাদেরই ভক্ত-মুরীদদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই ভক্তি ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপই তারা তাদের মাজারে যান, দোয়া-ফাতেহা পাঠ করেন ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি লাভ করেন। এটা শরীয়াহ সম্মত। হ্যাঁ ভÐামী কোথাও যে নেই, তা নয়। তবে তা কোন ক্ষেত্রে নেই। তাই বলে এসব ভেঙে দেয়ার, গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রশ্ন আসে না। নির্মূল নয়, সংস্কার-সংশোধন আবশ্যক। সেটা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হিকমাহ ও মাওয়িজাতুল হাসানার মাধ্যমে। গুঁড়িয়ে দেয়ার হুমকি বা রণহুঙ্কার দ্বারা নয়। তাতে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মানুষ মাজার পূজা করে না- জিয়ারত করে; পীর পূজা করে না, পীর থেকে ফয়েজ তাওয়াজ্জুহ হাসিল করে। পূজা, শিরক, জিয়ারত, ফয়েজ, তাওয়াজ্জুহ হাসিল বুযুর্গদের খিদমত হচ্ছে ইবাদত। তবে বাড়াবাড়ি অনেক সময় শিরকের শামিলও হয়ে যায়। এজন্য দায়ী মাজার নয়, মাজারে শায়িত বুজুর্গও নন। দায়ী ঐ সব নাদান মূর্খ ভক্ত। সংশোধন করতে হবে তাদের, লাঠি দিয়ে নয়, নেক-নসিহত দিয়ে। তা না করে সব মাজার গুঁড়িয়ে দেব বলে রণহুঙ্কার দিলে, ওই পক্ষ থেকেও পাল্টা হুঙ্কার আসবে। হুঙ্কার কার্যকর করতে গেলেও পক্ষ থেকেও প্রতিরোধ হবে। কোনো পক্ষই নয়, এমন ভয়ংকর তৃতীয় পক্ষও এসে যোগ দেবে। নেপথ্য থেকে আসবে অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান। ধ্বংস হয়ে যাবে এ সোনার দেশ। শুরু হয়ে যাবে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেনের মতো আস্তাহীন ভ্রাতৃঘাতি লড়াই। তাই আমাদের আহ্বান, সংযত হোন, সংযমী হোন। তাতেই মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।