পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
নরসিংদী থেকে সরকার আদম আলী : হারিয়ে যাচ্ছে নরসিংদীর শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলূম বা হস্তচালিত তাঁত শিল্প। বিগত ৫শ’ বছর ধরে বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ সূতী বস্ত্রের চাহিদা মিটিয়ে এখন বিলুপ্তির প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে এই জনপ্রিয় তাঁত শিল্পটি। নরসিংদীর তাঁতীপাড়া বা তাঁত পল্লীগুলোতে এখন আর মাকুর ঠকঠক শব্দ শোনা যায় না। শোনা যায় না দিনরাত তাঁত শ্রমিকদের জীবন ঘনিষ্ঠ মর্মস্পর্শী গানের আওয়াজ। তাঁতের কাপড় মাথায় করে তাঁতীদেরকে বাজারে যেতে দেখা যায় না। মাধবদী ও শেখেরচর বাবুরহাট, রাধাগঞ্জ, মনিপুরা, ও হাসনাবাদের তাঁতী বাজারগুলোতে এখন আর তাঁতীদের সমাগম ঘটে না। তাঁত পল্লী ও বাজারগুলো এখন এক পরিত্যক্ত বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।
প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, সরকারী ঋণের অভাব, রং ও সূতা ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব। বাজারজাত করণের অভাব এবং সর্বোপরি শক্তিচালিত তাঁত বা পাওয়ারলূমের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় হস্তচালিত তাঁত শিল্পে এই অধোদশা বিরাজ করছে।
নরসিংদীতে তথা দেশে কবে কখন এই হস্তচালিত তাঁতশিল্প গোড়াপত্তন ঘটে এর সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য বা ইতিহাস পাওয়া যায়নি। তবে মোগল শাসন আমল থেকে নরসিংদীর গ্রামাঞ্চলে গর্ত তাঁত বা পিটলূম প্রচলন শুরু হয়। এ সময় তৎকালীন ঢাকা তথা বাংলাদেশে ব্যাপক সংখ্যক তুলা উৎপাদিত হতো। দেশীয় কাঁচামাল হিসেবে এই তুলাকে ঘিরেই নরসিংদী তথা দেশে এই হস্তচালিত তাঁতশিল্প বা পিটলূমের বিকাশ ঘটে। এই পিটলূমের সাহায্যে তৈরী করা হতো বাংলার বিখ্যাত কাপড় মসলিন। এরপর ক্রমান্বয়ে এই হস্তচালিত তাঁত বা পিটলূমে তৈরী হতে থাকে মোটা শাড়ী, লুঙ্গী, বিছানার চাদর, দরজার পর্দা, মোটা খদ্দর ও গামছাসহ বিভিন্ন সূতী বস্ত্রাদী। নরসিংদীর পিটলূমে তৈরী সূতী বস্ত্র সারা বাংলাদেশের ৬০ থেকে ৮০ ভাগ বস্ত্রের চাহিদা পূরণ করতো। এই পিটলূম বা গর্ত তাঁতের সূতিকাগার ছিল নরসিংদীর রায়পুরা। রায়পুরার আমিরগঞ্জ, হাইরমারা, আদিয়াবাদ ইত্যাদি অঞ্চলের ঘরে ঘরে গর্ত তাঁতের ফ্যাক্টরী ছিল। লেখক ও সাংবাদিক এমদাদুল ইসলাম খোকনের মতে, নরসিংদীর মাধবদীর আনন্দী, আলগী, গদাইরচর, নুরালাপুর, হাসেমেরকান্দি, করিমপুর, রসূলপুর, অনন্তরামপুর, জিতরামপুর, এলাকায় এই পিটলূম বা গর্ত তাঁতের প্রচলন ছিল। এই এলাকায় এই গর্ত তাঁতকে ঠকঠকী তাঁত বলা হতো। নরসিংদীতে ২ ধরনের হস্তচালিত তাঁতকল ছিল। একটি ছিল গর্ত তাঁত বা পিটলূম এবং অন্যটি হচ্ছে কাঠ ও লোহার তৈরী জাপানী তাঁতকল। তবে তাঁতশিল্পের আদিম তাঁতকল ছিল গর্ত তাঁত বা পিটলূম। এই শিল্পের প্রারম্ভিকতায় তাঁতীরা নিজেরাই তুলা দিয়ে সূতা তৈরী করতো এবং সেই সূতা দিয়ে কাপড় বয়ন করতো। ১৮ শ শতকে শিল্প বিপ্লবের পর স্পিনিং মিলের সাহায্যে সূতা তৈরী শুরু হয়। তখন থেকে তাঁতীরা স্পিনিং মিলে তেরী সূতা দিয়ে তাঁত বস্ত্র তৈরী করতে শুরু করে। এমদাদুল ইসলাম খোকনের মতে, ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে আলগী গ্রামের ভূ-স্বামী বানি কণ্ঠ ভট্টাচার্য ওরফে বিশু বাবু বিলেত থেকে প্রথম লোহার তৈরী উন্নতমানের তাঁত আমদানী করে। ১৯২৫ সালের দিকে লৌহ নির্মিত তাঁতকলের আদলে তাঁতীরা সম্পূর্ণ কাঠের তৈরী এক ধরনের তাঁত আবিষ্কার করে। এভাবেই আধুনিক হস্তাচালিত তাঁতশিল্পের বিকাশ ঘটে। ১৯৪৭ সালের পর নরসিংদীসহ বাংলাদেশে তাঁত প্রধান এলাকাগুলোতে তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তখন নরসিংদীতে ঘরে ঘরে তাঁত ফ্যাক্টরী গড়ে উঠে। এসব তাঁতের তৈরী সূতী বস্ত্রকে ঘিরে নরসিংদীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঐতিহাসিক বাবুরহাট। নরসিংদী জেলার নরসিংদী, রায়পুরা, পলাশ ও বেলাব উপজেলার হাজার হাজার তাঁতী তাদের তৈরী তাঁতের সূতী কাপড় এই বাবুরহাটে নিয়ে বিক্রি করতো। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, দিনাজপুর, খুলনা ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারী ক্রেতারা বাবুরহাটে গিয়ে নরসিংদীর সূতী তাঁত বস্ত্র নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতো। প্রাপ্ত তথ্যমতে ইংরেজ আমলে নরসিংদীর গর্ত তাঁতে তৈরী কাপড় সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত রফতানী করা হতো। পরবর্তীতে এই হস্তচালিত তাঁত শিল্পের কাপড় ও সূতা বিপননের জন্য রায়পুরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মনিপুরা বাজার, রাধাগঞ্জ বাজার ও আমিরগঞ্জের হাসনাবাদ বাজার। সূতা, কাপড়, রং ও তাঁতের যান্ত্রিক উপকরণ বিক্রি হতো এসব বাজারসমূহে। প্রতিদিন হাজার হাজার তাঁতী, তাঁত শ্রমিক ও কাপড় বিক্রেতাদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠতো এসব বাজারগুলো। কিন্তু এই তাঁতী সমাজের উন্নয়নে সরকারীভাবে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁতশিল্পের উন্নয়নে তাঁতীদেরকে ন্যায্য মূল্যে কো-অপারেটিভের মাধ্যমে সূতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন সরকার। তাঁতীদেরকে দেয়া এই সুযোগ গ্রহণ করে তৎকালীন এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। প্রকৃত তাঁতীদেরকে পিছনে ফেলে গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলে হাজার হাজার ভূয়া তাঁতী সমিতি। এসব তাঁতী সমিতির মাধ্যমে কো-অপারেটিভ থেকে সূতা উত্তোলন করে কালো বাজারে বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যায় শত শত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। পক্ষান্তরে সূতা ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে প্রকৃত তাঁতীরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর ৭০ দশকের শেষ দিকে চালু হতে থাকে শক্তিচালিত তাঁতকল পাওয়ালূম। আর তখন থেকেই হস্তচালিত তাঁতশিল্পের দূর্দিন শুরু হয়। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তাঁতীরা অর্থ কষ্টে পড়ে এই পেশা ছেড়ে দিতে শুরু করে। অধিকাংশ তাঁত শ্রমিক যোগ দেয় পাওয়ারলূম ফ্যাক্টরীতে। এত প্রতিযোগিতার মধ্যেও নরসিংদীর রায়পুরা ও সদর উপজেলার কাঠালিয়া, নুরালাপুর, জিতরামপুর, পাইকারচর ইত্যাদি এলাকায় অনেক তাঁতী তাদের এই পৈত্রিক পেশাকে আকড়ে ধরে রয়েছে। সম্প্রতি এই প্রতিবেদক রায়পুরার হাইরমারা গ্রামে গিয়ে কথা বলেছেন তাঁতী আলী আহসান ও আলী আশরাফ নামে দুই তাঁতীর সাথে। তারা জানিয়েছেন হস্তচালিত তাঁতশিল্প তারা ধরে রেখেছেন বিগত ১০০ বছর ধরে। এরমধ্যে ৬০ বছর ধওে তারা দুই ভাই এই তাঁত চালাচ্ছেন। তবে তারা এখন আর শাড়ী কাপড় তৈরী করেন না। তারা তৈরী করেন লুঙ্গী। এসব লুঙ্গী তারা বিক্রি করেন নরসিংদীর বাবুরহাটে। বর্তমানে তাদের দ্ইু ভাইয়ের ১৭ টি গর্ত তাঁত রয়েছে। তারা এই তাঁতের লুঙ্গী বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা জানায় পাওয়ারলূম থেকে ফেলনা সূতা এনে তারা লুঙ্গী তৈরী করে। তাদের তৈরী লুঙ্গীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বাজারে। একটি লুঙ্গী তৈরী করতে খরচ পড়ে ৮০ টাকা। তারা বিক্রি করে ১০০ টাকা দরে। তাঁত শ্রমিকরা জানিয়েছে তারা ৪০ বছর ধরে তাঁত শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। যতদিন বাঁচে ততদিন এই তাঁত শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে হবে। তারা আর কোন কাজ করতে পারেনা। তাছাড়া তাঁতের কাজ করে তারা খুবই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাঁতের কাজ করে সংসারের ছেলে-মেয়েরা সময় দেয়ার সুযোগ পায়। প্রতিদিন ৮ ঘন্টা কাজ কওে বাকী সময় সংসারের কাজে লাগাতে পারে। তাঁতী ও তাঁত শ্রমিকরা জানিয়েছেন পাওয়ারলূমের সাথে প্রতিযোগিতা করে হ্যান্ডলূম মালিকরা আপাতত টিকতে না পারলেও হ্যান্ডলূম বা হস্তচালিত তাঁতের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। এমন অনেক সূ² বুনন কাজ রয়েছে যা শুধুমাত্র হস্তচালিত তাঁত শিল্প বিশেষ করে পিটলূম বা গর্ত তাঁতকল দিয়েই সম্ভব। দেশের বিখ্যাত মসলিন কাপড় এই পিটলূম দিয়েই তৈরী হয়। কটন নির্মিত সূতা দিয়ে মসলিন বা মসলিনের মতো সূ² বয়নকাজ করতে হলে এই পিটলূমেরই দরকার। এ কাজগুলো পাওয়ারলূম দিয়ে করে গেলেও সূক্ষাতিসুক্ষভাবে করা সম্ভব নয়। এছাড়া মোটা সূতা দিয়ে মোটা কাপড় যথাক্রমে মোটা চাদর, বিছানার চাদর, দরজার পর্দা, গামছা ইত্যাদি কাজ হস্তচালিত তাঁতকল দিয়ে করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা। দেশীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে দেশীয় হস্তচালিত তাঁতশিল্পকে দেশের ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সরকারের পৃষ্ঠপোষণা প্রয়োজন। পাওয়ারলূমের পাশাপাশি হ্যান্ডলূম ফ্যাক্টরীগুলো চালু রাখা হলে স্বল্পব্যয়ে কাপড় তৈরী করে স্বল্পমূল্যে ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যা পাওয়ারলূম ফ্যাক্টরী দ্বারা সম্ভব নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।