Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা নিরসনে মেয়রের ক্রাশ প্রোগ্রাম খাল নালা খনন, উন্মুক্ত ফুটপাত

| প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : সামান্য বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যেত বন্দরনগরীর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের সামনের ব্যস্ত সড়কে। একই অবস্থা নন্দনকানন বৌদ্ধমন্দির মোড়ে ন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুলের সামনে সড়কেও। কারণ নেভাল এভিনিউ আর ডিসি হিল থেকে নেমে আসা পানি সরে যাওয়ার যেসব নালা-নর্দমা ছিল একেবারেই ভরাট হয়ে গেছে। কতিপয় বহুতল ভবনের মালিকের গ্রাসে সরু হয়ে যায় এসব নালা-নর্দমা এমনকি মানুষের চলাচলের ফুটপাত। এ এলাকার বাসিন্দাদের পানিবদ্ধতা থেকে রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সড়কের দুই পাশের নালা দখলম্ক্তু করে তা সংস্কার করা হচ্ছে। বাড়ছে নালার দৈর্ঘ্য এবং গভীরতা। এমনকি পান্ডা টাওয়ারের মতো কিছু ভবন মালিক ফুটপাত ও রাস্তা দখলে নিয়ে বহুদিন কব্জায় রাখার পর অবশেষে এবারই চসিকের সৎসাহসী ক্রাশ প্রোগ্রামের সুবাদে তা ভেঙে এখন আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি এসব নালা, নর্দমা হয়ে দ্রæত সরে গেলে এই এলাকায় আর পানিবদ্ধতা হবে না। আবার নালার উপর ফুটপাত হওয়ায় সড়কে যানজট কমবে। লোকজন স্বচ্ছন্দে রাস্তা পার হতে পারবে। প্রতিদিনই নগরীর এখানে-সেখানে খাল, ছরা খনন ও সংস্কার এবং ফুটপাত প্রশস্তকরণের কাজ চলছে অবিরাম। আর চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন নিজেই সরেজমিন তদারক করছেন কাজের অগ্রগতি। মেয়রের অঙ্গীকার তিনি চট্টগ্রামকে ‘গ্রিন সিটি ক্লিন সিটি’ হিসেবে ঢেলে সাজাতে চান।
নগরীর অন্যতম দর্শনীয় এবং ব্যস্ততম নন্দনকানন-এনায়েত বাজারের মতো আরও অনেক এলাকায় এভাবে খাল, ছরা, নালা, নর্দমা সংস্কারের পাশাপাশি ফুটপাত উন্মুক্ত এবং সম্প্রসারণের কাজ করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ভোর সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা শাবল-কোদাল হাতে বদলে দিচ্ছে ভাঙাচোরা অবকাঠামো। সেইসাথে আগামী বর্ষায় নগরীতে পানিবদ্ধতা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে খাল, নালায় ব্যাপক সংস্কার কাজ চলছে। নগরীর খালগুলোকে ছয়টি জোনে ভাগ করে খনন কাজও চলছে। এসব আগাম প্রস্তুতির ফলে এবারের বর্ষায় নগরবাসী পানিবদ্ধতার সমস্যা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবেন বলে প্রত্যাশা সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের।
নগরীর একটি জনবহুল এলাকা চকবাজার-বাকলিয়াবাসীর দীর্ঘদিনের ‘দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত ধুনির পুল ভেঙে সেখানে চাক্তাই উপখালের উপর একটি উঁচু (১৪ দশমিক ২ মিটার) সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। অতীত থেকেই ভাঙাচোরা ধুনির পুলের দুর্দশার কারণে চকবাজারসহ বিশাল এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যেত। এখন উঁচু সেতুটি নির্মিত হলে বিস্তীর্ণ এলাকা অনেকাংশে পানিবদ্ধতার সমস্যামুক্ত হবে। এমনিভাবে চসিক নগরীর যেখানে অবকাঠামো তথা খাল, ছরা, নালা-নর্দমার যে সমস্যা প্রকট সেগুলো চিহ্নিত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের কাজ চলছে। এতে করে সাধারণ নগরবাসী স্বস্তি প্রকাশ করছে।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ভিত্তিক বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে পানিবদ্ধতা সমস্যা দীর্ঘদিনের। সিটি কর্পোরেশন এককভাবে এ সমস্যার জন্য দায়ী না হলেও সমস্যার পুরো দায় নিতে হচ্ছে। আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনগণের কাছে জবাবদিহী করতে হচ্ছে সিটি মেয়রকেই। বিশেষজ্ঞদের মতে চট্টগ্রাম নগরীতে পানিবদ্ধতার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন আর নির্বিচারে পাহাড় কাটা। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে খাল, নালা, ছরা আর উন্মুক্ত জলাশয় এবং নীচুভূমি ভরাট হয়ে গেছে। আবার নির্বিচারে পাহাড় কর্তনের ফলে বিদ্যমান খাল, নালাও দ্রæত ভরাট হয়ে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থাকে অচল করে দিচ্ছে। এইসব কারণে পানিবদ্ধতা সমস্যা বাড়ছে। পরিকল্পিত নগরায়ন নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব সেই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেও পানিবদ্ধতা সমস্যা বাড়ছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে পানিবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার একটি মেগাপ্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন পানিবদ্ধতা নিরসনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছেন। এই ধারাবাহিকতায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সিটি মেয়রের উদ্যোগে পানিবদ্ধতা নিরসনে জরুরী ভিত্তিতে বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগের বাস্তবায়ন চলছে। নগরীর ডিসি হিল আর এনায়েত বাজারের মতো নগরীর আরও অনেক এলাকায় নালা, নর্দমা সংস্কারের কাজ চলছে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও সাধারণ নাগরিকগণ পানিবদ্ধতা সমস্যার পেছনে খাল, নালা-নর্দমা ভরাট, বেদখলকে অন্যতম সমস্যা হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে সমাধানের দাবি করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষার আগেভাগেই সিটি কর্পোরেশন এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছে।
সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ ইনকিলাবকে জানান, মহানগরীর এক একটি এলাকায় পানিবদ্ধতার কারণ ও ধরণ এক এক রকম। আমরা স্টাডি করে পানিবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করেছি এবং তা নিরসনে নানামুখি কার্যক্রম চলছে। কোন এলাকায় দেখা গেছে পাহাড় থেকে পানি নামছে কিন্তু সে পানি সরার জন্য পর্যাপ্ত নালা নেই। ওইসব এলাকায় বিদ্যমান নালা সংস্কার করা হচ্ছে, বাড়ানো হচ্ছে গভীরতা। কোথাও আবার ড্যাম তৈরিরও প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কোন কোন এলাকায় খাল সংস্কারের পাশাপাশি খননও করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জিইসি মোড়ে এবং ষোলশহরে পানিবদ্ধতা হচ্ছে। সেখানে সিডিএ ফ্লাইওভার নির্মাণকালে পানি নিষ্কাশনের ড্যাম সংকোচিত করে ফেলেছে। আমরা তাদের ওইসব এলাকায় নালা উন্মুক্ত করে দিতে বলেছি। তিনি বলেন, পানিবদ্ধতা সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার মেগাপ্রকল্প নিয়েছে। তবে নগরবাসীকে পানিবদ্ধতা সমস্যা থেকে রক্ষা তথা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে আমরা বেশকিছু কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছি। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন। আর্থিক সংকটের মধ্যেও সিটি কর্পোরেশন কাজ করে যাচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করি এর ফলে এ সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে।
সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৬২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পিচ ঢালাই সড়কের সংখ্যা ১১শ ৪০টি। ২৪৯ কিলোমিটার দীর্ঘ কংক্রিট সড়কের সংখ্যা ১১শ ৯টি। বেশিরভাগ সড়কের পাশে নালা নেই। ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন এসব সড়কের দুইপাশে নালা নির্মাণের পাশাপাশি ফুটপাত নির্মাণেরও উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে নগরীর নিউমার্কেটসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার ফুটপাত হকারমুক্ত হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের বেধে দেয়া সময় ও নিয়মে নির্ধারিত হকাররা শৃঙ্খলার সাথে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে নগরবাসী স্বাচ্ছন্দে পথ চলতে শুরু করতে পারছে। আবার মোড়ে মোড়ে জটলা ও বিশৃঙ্খলাও কমেছে। বিলবোর্ডের জঞ্জালমুক্ত মহানগরী অল্প সময়ের মধ্যে উন্মুক্ত ডাস্টবিন মুক্ত হচ্ছে। আর এর মধ্যদিয়ে সিটি মেয়রের গ্রিন সিটি ক্লিন সিটি বাস্তবায়ন আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন নগরবাসী।
এদিকে পানিবদ্ধতা নিরসনে নগরীর খালগুলোকে ৬টি জোনে ভাগ করে খনন কাজ অব্যাহত রেখেছে সিটি কর্পোরেশন। মেয়রের নির্দেশে ও সরাসরি তত্ত¡াবধানে প্রায় দুই মাস আগ থেকে খাল-নালা খনন ও সংস্কারের কাজ শুরু হয়। সিটি কর্পোরেশনের হিসাবে, শাখা-প্রশাখাসহ নগরীতে মোট খালের সংখ্যা ১১৮টি। এসব খালের দৈর্ঘ্য ১৮২ কিলোমিটার। আর কাঁচা অংশের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল করতে নগরীর দুঃখ হিসেবে খ্যাত চাক্তাই খালসহ বড় বড় খালগুলো খনন করা হচ্ছে। নির্মাণ করা হচ্ছে রিটেইনিং ওয়াল। খালের পাশে হাঁটার পথ এবং ফুটপাত নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকৌশলীরা জানান, ভারী বৃষ্টির পানি যাতে দ্রুত অপসারণ হতে পারে সেই লক্ষ্যে বর্ষার আগেই নগরীর খালগুলোর পলি-বালি, মাটি, বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে। খনন কাজ বর্ষা পর্যন্ত চলমান থাকবে। নগরীর ৫৭টি খাল ও এসব খালের শাখা-প্রশাখা সংস্কারের জন্য ৬টি জোনে ভাগ করে ৬ জন প্রকৌশলীকে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রম নিয়মিত তদারক করছেন সিটি মেয়র। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলরগণ নিজেদের এলাকায় সংস্কার ও উন্নয়ন কার্যক্রম দেখভাল করছেন। মেয়র নিয়মিত বৈঠকে কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। সবকিছু মিলে সুবিন্যস্তভাবে চলছে চট্টগ্রামের জরাজীর্ণ খাল, ছরা, নালা-নর্দমার সংস্কার করে উন্নয়নের ক্রাশ প্রোগ্রাম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেয়র


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ