Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যস্ত পুলিশবেড়েছে ইয়াবা বেচাকেনা

| প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম : কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়ার খুটাখালি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই বাস যাত্রীকে আটক করেছে হাইওয়ে পুলিশ। গত শুক্রবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রামমুখী শাহ আমিন পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে যাত্রীবেশী ফেরিওয়ালা আমজাদ হোসেনের কাছ থেকে ২ হাজার পিস এবং চকরিয়া সার্ভিস নামে লোকাল একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে কবির আহমদ নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃত ইয়াবার মূল্য প্রায় ৪৮ লাখ টাকা। এর চার দিন আগে গত ৬ ফেব্রæয়ারি নওগাঁ শহরের বাইপাস বরুনকান্দি এলাকা থেকে ১৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে র‌্যাব। উদ্ধারকৃত ইয়াবার মূল্য প্রায় ৫২ লাখ টাকা। ৩ ফেব্রæয়ারি কক্সবাজার সদর উপজেলার লিংকরোড এলাকা থেকে শাহ আলম (২৫) নামে এক যুবককে ৫ হাজার ২শ’ পিস ইয়াবাসহ আটক করেছে র‌্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পের সদস্যরা। জব্দ করা ইয়াবা ট্যাবলেটের আনুমানিক বাজার মূল্য ২০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। চলতি ফেব্রæয়ারি মাসের ৩ থেকে ১০ তারিখ মাত্র ৭ দিনের ব্যবধানে উদ্ধারকৃত এসব ইয়াবার মূল্য প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ধরা পড়ে, তার চেয়ে কয়েকশ’ গুণ বেশি পাচার হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র সাত দিনে উদ্ধারকৃত ইয়াবার পরিসংখ্যানই বলে দেয় প্রতিদিনই দেশে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা আসছে। ভয়ঙ্কর ইয়াবার বিস্তার এখন শুধু শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, একেবারে অজপাড়াগাঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকাসহ দেশের যেকোনো জেলা, উপজেলা, এমনকি গ্রামে-গঞ্জেও হাত বাড়ালেই ইয়াবা পাওয়া যায়। গত কয়েক দিন রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে ব্যস্ত সময় পার করেছে পুলিশ। এই সুযোগে ইয়াবার বেচাকেনা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
মাদকাসক্তদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক দিন পুলিশের ব্যস্ততায় রাজধানীর পাড়া মহল্লায় দেদারছে বিক্রি হয়েছে ইয়াবা। পুরনো স্পটগুলোসহ নতুন নতুন স্পটেও প্রকাশ্যে বেচাকেনা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ঢাকার ব্যবসায়ি, চাকরিজীবী ও স্বচ্ছল পরিবারে ঢুকে পড়েছে মরণ নেশা ইয়াবা। এতে করে সংসার জীবনে অশান্তি ও ভাঙ্গন লেগেই আছে। ভুক্তভোগিদের মতে, মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ বরাবরই জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বললেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই দেখা যায়। অভিযোগ রয়েছে, কোনো কোনো এলাকায় পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলে ইয়াবার বেচাকেনা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিগত ৫ বছরে দেশে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ৮১ গুণ। ইয়াবা উদ্ধারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ৮১ গুণ বেশি ইয়াবা ধরা পড়েছে। উদ্ধারকৃত ইয়াবার সংখ্যা থেকে এই তথ্য বের করেছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১০ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৮ লাখ ১২ হাজার ৭১৬ পিস, ২০১১ সালে ১৩ লাখ ৬০ হাজার ১৮৬, ২০১২ সালে ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৩৯২, ২০১৩ সালে ২৮ লাখ ২১ হাজার ৫২৮, ২০১৪ সালে ৬৫ লাখ, ১২ হাজার ৮৬৯ এবং ২০১৫ সালে ২ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫পিস। তবে উদ্ধারের এই পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার অনেক ফারাক। খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই মনে করেন, এর চেয়ে বহুগুন বেশি ইয়াবা বেচাকেনা ও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাদক ব্যবসায়িদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে পুলিশ তৎপর হলে মাদকের বেচাকেনা অনেকটা কমে যায়। থানাগুলোতে মাদকবিরোধী বিশেষ টিম গঠন করার কারণে মাদক ব্যবসায়িরা গাঢাকা দিতে বাধ্য হয়। গত কয়েক দিন রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও আটক অভিযানে ব্যস্ত সময় কাটায় পুলিশ। এতে করে মাদক স্পটগুলোতে পুলিশের নিয়মিত টহল ব্যাহত হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে মাদক ব্যবসায়িরা। গত কয়েকদিনে রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি অভিযোগ পাওয়া গেছে। কদমতলী থানা সূত্র জানায়, কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ি বিল্লাল ডাকাতের মৃত্যুর পর কদমতলীর ওয়াসার পুকুরপাড়সহ চিহ্নিত মাদক স্পটগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন সেগুলোতে আবার বেচাকেনা চলেছে। বিশেষ করে মুরাদপুর, জুরাইন, দনিয়ার গোয়লবাড়ী মোড়, ধোলাইপাড় ডিপটির গলি, সরাই মসজিদ রোড ও কদমতলী শিল্প এলাকার হাড্ডি কারখানায় প্রকাশ্যে ইয়াবার বেচাকেনা হয়েছে। কদমতলী থানার ওসি আব্দুল জলিল জানান, গত ১৫দিনে থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৫০টির বেশি মামলা হয়েছে। ভুক্তভোগিরা জানান, কদমতলী ও যাত্রাবাড়ী থানার সংযোগস্থল ধোলাইপাড়ের আশপাশে গত কয়েকদিন প্রকাশ্যে ইয়াবা বেচাকেনা করেছে। দনিয়া বাজার এলাকার একজন ভুক্তভোগি বলেন, প্রায় এক বছর ধরে ধোলাইপাড় থেকে দনিয়া যাওয়ার রাস্তাটি সংস্কারের নামে বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে করে পুলিশের গাড়ি এই এলাকায় প্রবেশ করতে পারে না। এতেই ইয়াবা ব্যবসায়িরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সরাই মসজিদ রোডে ইয়াবার হাট বসে উল্লেখ করে ওই ভুক্তভোগি বলেন, এলাকার মানুষ সব কিছু চোখে দেখলেও ভয়ে কিছু বলে না। আর পুলিশকে খবর দিলেও রাস্তার অভাবে পুলিশ আসতে পারে না। দনিয়া গোয়াল বাড়ী মোড়েও প্রকাশ্যে ইয়াবার বেচাকেনা চলে জানিয়ে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, মনির নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ি কদমতলী থানার এক দারোগাকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যেই ইয়াবা বিক্রি করে চলেছে বহুদিন ধরেই। কদমতলী থানার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে জানা গেছে, কিছু সোর্সের যোগসাজশে এখানকার মাদক ব্যবসা জমজমাট। বড়ইতলার বিল্লাল, দোলাইপাড়ের ৩নং গলির দুলাল, শ্যামপুর পালপাড়ার মাদক সম্রাট ফরহাদ এই এলাকার সবচেয়ে বড় মাদক ব্যবসায়ী। এরা প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকার মাদক বিক্রি করে। এ ছাড়াও যারা প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছে তারা হলো, মুরাদপুর জিরো পয়েন্টে পিস্তল কামাল, বিড়ি ফ্যাক্টরী সোহাগ, বউ বাজারে আনোয়ারের বউ আলেয়া, সরাই মসজিদ রোডের মতি মিয়া, চায়না বাবুল, শ্যামপুর রানী স্টীলের পাশে মনসুরের ফার্মেসী, লাবুর বাড়ীর শাহেদ, বদনা রনি, লাইজু, আলমবাগের আলাউদ্দিন, কমিশনার রোড মিষ্টির দোকানের মাহমুদের ভাই বাবু, ছোট শাকিল, ওয়াসার ঢালে বজলুর বউ, জামাই মনির, শ্যামপুর ঢাকা ম্যাচ কলোনীর হানিফ, জুরাইন ঋষিপাড়ার রানা ও লাকী, মুরাদপুর ডিপটি গলির জুম্মন, দুলাল, জুবায়ের, শাহ আলম ও বিনা। মুরাদপুর হাইস্কুল রোডের আকবরের ছেলে বার রুবেল, ইয়াবা ব্যাবসায়ী ডেউয়া সুমন, দনিয়া বাজারের চান্দু শাহীন, আকবর, দনিয়া আদর্শ স্কুল গলির রাসেল, আদম, ইতি, হাফিজুল, বগা মাসুম, কোকিলার ভাগ্নে নাঈম, রায়েরবাগের বাহার, সোহেল, সাহেব মিয়া, স্বপন কসাই, মুরাদ, নূরু, রফিক, ধোলাইপাড় ডিপটির গলির ফারুক, রহিম, সোর্স দুলাল, বাপ্পী ও রাজু। এলাকাবাসী জানায়, এদের মধ্যে অধিকাংশই ইয়াবা ব্যবসায়ী। শুধু যাত্রাবাড়ী বা কদমতলী নয়, রাজধানীর প্রতিটি থানা এলাকায় মাদকের ব্যবসা এখন জমজমাট। দিনে রাতে অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হোরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য। এ কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করছে থানা পুলিশের কতিপয় সোর্স, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা, ছাত্রনেতাসহ কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা তালিকাভূক্ত সন্ত্রাসীরা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইয়াবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ