হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি। গত ২৫ জানুয়ারি উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রাজধানীর বকশিবাজারে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ-৫ এর বিচারক ড. মোহাম্মদ অক্তারুজ্জামান এ তারিখ ঘোষণা করেন। তারিখটি ঘোষিত হবার পর থেকে মামলার রায় নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। বলা যায়, এটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। রায় কী হতে পারে, বেগম জিয়ার কত বছরের সাজা হতে পারে, সাজা হলে তাকে কারাগারে নেয়া হবে কীনা, নাকি তিনি বেকসুর খালাস পাবেন, এসব বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। মামলার ধরন এবং আদালতে দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের যেসব বিবরণ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে অনেকে ধারণা করছেন, শেষ পর্যন্ত বিচারক বেগম খালেদা জিয়াকে খালাস দিয়ে দিতে পারেন। অন্যদিকে কেউ কেউ মনে করেন যে, মামলার ধরন যাই হোক না কেন, এতে বেগম জিয়ার দন্ডিত হওয়ারসমূহ আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এ মামলায় বেগম খালেদা জিয়া খালাস পেয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে চলমান অন্যান্য মামলা সম্পর্কেও জনমনে ভিন্ন ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। দু’পক্ষের চিন্তাভাবনা আশা-আশঙ্কার মধ্যেই যুক্তি আছে সন্দেহ নেই। তবে, বাংলাদেশে এখন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছে না- এটা মাথায় রেখেই ভাবতে হবে এবং আশা করতে হবে।
ঘোষিতব্য এ রায় নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ইতোমধ্যে যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তাতে একটি আশঙ্কা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ রায়কে কেন্দ্র করে দেশ আবারো রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পতিত হয় কীনা- এ আশঙ্কা অনেকের মনেই সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই তড়িঘড়ি করে মামলার রায় দেয়া হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত রায় ঘোষণার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সভা সমাবেশ ও প্রেস ব্রিফিং করে এ অভিযোগও তুলেছেন যে, সরকার আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার ষড়যন্ত্র করছে।
অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী ও শাসকদলের নেতারা বলছেন যে, মামলার রায়ের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো হাত নেই। মামলায় বেগম জিয়া সাজা পাবেন নাকি খালাস পাবেন তা নির্ভর করছে আদালতের ওপর। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়ার জবাবে বলেছেন যে, তারা কীভাবে বলছেন যে, বেগম জিয়ার সাজা হবে? তবে, বিএনপি নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর একটি বৃহৎ অংশের মনে সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছে সরকারের একজন প্রতিমন্ত্রীর আগাম মন্তব্যে। সম্প্রতি তিনি বলেছেন যে, অতি শিগগির বেগম জিয়া জেলে যাবেন। তাছাড়া সরকারের প্রধান অংশীদার এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদও একই কথা বলেছেন। ফলে জনমনে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করা হবে।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার মামলার ঘোষিতব্য রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ব্যাপক বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা নিয়ে কেউ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ব্যবস্থা নেবে। রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকাল তিনি এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় একই দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিমূলক আগাম বক্তব্য সঙ্গত নয়। সদ্য পরলোকগত সাহিত্যিক শাওকত আলীর বাসায় মরহুমের পরিবারকে সমবেদনা জানানোর পর উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মির্জা আলমগীর বলেন, আমরা এখনও রায় পাইনি। রায় ঘোষণার আগে আমরা তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া সেভাবে বলতে পারব না। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা নিয়ে গতকাল শুক্রবার কথা বলেছেন। এ কথা বলা মোটেই সঙ্গত নয়। তিনি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। তার এ বক্তব্য থেকে এটি পরিষ্কার যে, তারা কী চিন্তা করছেন। অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২৬ জানুয়ারি ফেণীতে বলেছেন, মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেয়া হলে সারা দেশে আগুন জ্বলবে। এর জবাবে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাজা হলে যারা বিশৃঙ্খলার আগুন জ্বালবে, সে আগুনে তাদের নিজেদেরকেই পুড়ে মরতে হবে। অতীতেও তাই হয়েছে।
সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এ রায়কে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ২৮ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জে বলেছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায় আইনের বিষয়। এ রায়কে ঘিরে বিএনপি দেশে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করলে সরকার লাগবে না, জনগণই তাদের প্রতিহত করবে। সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার দিন যাতে বিএনপি নেতাকর্মীরা কোনো রকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সারা দেশের নেতাকর্মীদের সতর্ক ও প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীতে দলের এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের যার যার ইউনিটে সতর্ক অবস্থায় অবস্থানেরও নির্দেশনা দিয়েছে দলটি। বোঝা যায়, বেগম জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি যাতে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়, সে জন্য তারা আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা এ মামলার রায় দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর যে মারত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রায় যদি বেগম খালেদা জিয়ার বিপক্ষে যায়, তাহলে বিএনপি তার প্রতিবাদে মাঠে নামার চেষ্টা করবে। অন্তত দলটির নেতানেত্রীদের সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতি থেকে তেমনটিই অনুমান করা যায়। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, রায় ঘোষণার দিন দলের নেতা কর্মীদের রাজপথে থাকার কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাই কমান্ড থেকে। তাছাড়া রায় পরবর্তী পরিস্থিতিতে দল কীভাবে চলবে, নেতাদের করণীয় কী, এসব নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই স্থায়ী কমিটি ও ২০ দলীয় জোট নেতাদের সাথে তিনি বৈঠক করেছেন। বৈঠকসমূহের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ গণমাধ্যমে না এলেও প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, মামলায় যদি বেগম জিয়ার জেল-জরিমানা হয়, তাহলে কঠোর আন্দোলনে যাবে তারা। কেননা, বিএনপি মনে করছে যে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বেগম খালেদা জিয়াক দূরে রাখতে সরকার ষড়যন্ত্র করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার আদালতের রায়কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না। এছাড়া গত ২৮ জানুয়ারি বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে দলের গঠনতন্ত্র জমা দেয়ার পর স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেছেন, চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ছাড়া বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে না। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানকে অন্যায়ভাবে যদি নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়, তাহলে বিএনপির কেউ নির্বাচনে অংশ নেবে এমনটি ভাবা মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
দু’পক্ষের এসব বাকযুদ্ধকে সাধারণ মানুষ অশনি সংকেত হিসেবেই দেখছে। বেগম জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে আরো একবার অস্থিরতার ঘূর্ণিপাকে পড়তে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে প্রায় সবাই এক রকম নিশ্চিত। এ বিষয়ে গত ২৮ জানুয়ারি দৈনিক যুগান্তর এক বিশেষ প্রতিবেদনে লিখেছে, ‘বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সৃষ্ট উত্তাপ শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা ছড়িয়ে পড়েছে দল-মত নির্বিশেষে সব স্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। নানা উদ্বেগ ও অজানা আতঙ্ক পেয়ে বসেছে তাদের। সবখানেই একই আলোচনা- আবার কি মুখোমুখি হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি।’ পত্রিকাটি লিখেছে, রায়কে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের নেতাদের যে বাকযুদ্ধ চলছে, তা মাঠে গড়ালে কি ঘটবে- এমন প্রশ্ন অনেকের। তাদের আশঙ্কা, যদি রায়ে খালেদা জিয়ার সাজা হয়, আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে দেশ। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘দুই দলের নেতাদের পরস্পরকে দেয়া হুমকি ভালো পরিণতি বয়ে আনবে না। রাজপথের মোকাবেলায় কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। প্রধান দুই দলের নেতারা যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন, এর ক্ষতির শিকার হতে হবে জনগণকেই। তাদের জানমালের ক্ষতি হবে, দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। কাজেই রাজনীতিবিদদের জনগণের কথা মাথায় রেখে কর্মসূচী পালন এবং বক্তব্য দেয়া উচিত।’
সুজন সম্পাদক রাজনীতিবিদদের জনগণের কথা মাথায় রাখার কথা বললেও তা যে আমাদের রাজনীতিকরা মোটেও রাখেন না, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর বহু প্রমাণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে আছে। মুখে তারা দেশের জন্য প্রাণপাত করলেও কার্যক্ষেত্রে তার নজির পাওয়া যায় না। দেশ ও জনগণের চাইতে তাদের কাছে দলের স্বার্থ অনেক বড়। আর সে জন্যই জনগণের একটি বৃহৎ অংশ এখন রাজনীতি নামক ক্রিয়াটিকে ভালো চোখে দেখে না। বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায়, যা এখনও ঘোষণা করা হয়নি, তা নিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে যে বাক্যবাণ নিক্ষেপ চলছে, তা ভয়ঙ্কর আগামীর ইঙ্গিত দিচ্ছে। দুই দলই যে রকম ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী’ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে, তাতে আগামী দিনগুলোতে পরিবেশ-পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠার আলামত স্পষ্ট।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।