Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রশ্ন ফাঁস রোধ করুন আগে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

আসন্ন এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া গেলেই সে পরীক্ষা বাতিল করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন। ২৫ জানুয়ারি সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত জাতীয় মনিটরিং কমিটির সভার শুরুতেই এ কথা জানান তিনি। প্রয়োজনে ১০ বার একই পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশের কথাও বলা হয়। কিন্তু প্রশ্ন ফাঁসের পর ঢালাওভাবে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক? প্রশ্ন হলো, কার সাজা কাকে দেবেন? ২/৪ জন প্রশ্ন ফাঁস করলো আর সকল শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করা হলো বিষয়টি কেমন হবে? প্রশ্ন ফাঁস রোধের দায়িত্ব কাদের? প্রশ্ন ফাঁস রোধের ব্যর্থতা কাদের? অন্য কেউ অপরাধ করলে, সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এর দায় কোমলমতি শিক্ষারর্থীরা কেন নেবে? প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধে গুটি কয়েক মানুষ জড়িত। এ অপরাধতো দেশের সকল পরীক্ষারর্থীর নয়। তবে তারা কেন শাস্তি পাবে? প্রশ্ন ফাঁস রোধ না করতে পারার দায় এড়াতে সকল শিক্ষারর্থীর পরীক্ষা বাতিল ‘উদরপিন্ডি বোধর ঘারে’ চাপানোর মতই। প্রশ্ন ফাঁস হবে, রোধ হবে না আর যারা কষ্ট করে সারা বছর পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিলো তাদের কষ্ট জলাঞ্জলি দিয়ে পরীক্ষা বাতিল করা হলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।
প্রশ্ন ফাঁসের আমাদের যে অভিজ্ঞতা তাতে দেশে অনুষ্ঠিত অনেক পরীক্ষাই বাতিল করতে হবে। তাই পরীক্ষা বাতিল নয় আগে প্রশ্ন ফাঁস ঠেকান। এটা কঠিক কাজ নয়। প্রশ্ন ফাঁস ছাড়া আগে অনেক পরীক্ষা হয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির ববস্থ্যা করলে প্রশ্ন ফাঁস রোধ হবে। প্রশ্ন হলো, এখন কেন এতো হরেদরে প্রশ্ন ফাঁস হয়? প্রশ্ন ফাঁস কেন হয় এর উত্তর কিন্তু আমাদের জানা। যারা প্রশ্ন ফাঁস করে তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়ে বলে জেনেছি। ওদের উপযুক্ত সাজা কি হয়? কেন হয় না? আইন প্রয়োগ হয় না বলেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছেতো ঘটছেই। রোধ করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের হুঙ্কার, আশ্বাস, ভবিষ্যদ্বাণী সবটাই যেন অকার্যকর মনে হচ্ছে। সব কিছুকে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠছে। এতে আমরাই লজ্জা পাচ্ছি। সংশ্লিষ্টর লজ্জিত কিনা তাই এখন প্রশ্ন? বাজে একটি ঘটনা বারবার ঘটছে তাও আবার শিক্ষা ক্ষেত্রে এটা কী করে সম্ভব? সংশ্লিষ্টরা কি না দেখার ভান করছেন? সবাই জানে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষার্থী, অভিভাবকরাও বলছেন, যে প্রশ্ন তারা অনলাইনে পেয়েছে তার সাথে পরীক্ষা নেয়া প্রশ্নে পুরোপুরি মিলও আছে। সবাই দেখছেন, জানছেন কিন্তু কর্তৃপক্ষ কেন দেখছেন না? প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্পষ্ট হলেও সংশ্লিষ্টরা এর দায় কেন নিচ্ছেন না? এমনটা চলতে থাকলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, শিক্ষার মান বলে কিছু থাকবে না। প্রকৃত শিক্ষিত জাতি থেকে বঞ্চিত হবে দেশ। আর তা দেশের জন্য ভয়ানক একটা সংবাদ।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন কোন উপসর্গ নয়। নিয়মিত ঘটনা। সরকার জঙ্গি দমন করতে পারছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পারছে, বিশ্বব্যাংককে উপেক্ষা করেই পদ্মা সেতুর মতো কঠিন কাজগুলো করতে সক্ষমতা দেখাচ্ছে। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় রাষ্ট্র ব্যর্থ হচ্ছে কেন? সংশ্লিষ্টরা কি এর দায় এড়াতে পারেন?
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। আমাদের ছাত্র জীবনেও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তখন কেউ হঠাৎ প্রশ্নপত্র পেলেও অল্প সময়ে এক জায়গা হতে আরেক জায়গায় পাঠানো দুঃসাধ্য ছিল। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়েছে। কথায় আছে, কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলতে হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেই প্রশ্নপত্র ফাঁস সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। প্রশ্নপত্র বিতরণে ভিন্নতা আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কৌশলী হতে হবে। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে পরীক্ষার দিন সকালবেলা প্রশ্নপত্র ছাপানো এবং বিতরণ করা যায়। বছর তিনেক আগে আমি প্রশ্ন ফাঁস রোধে আমার লেখা কলামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে কয়েকটি সুপারিশ করেছিলাম। তখন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও এজাতীয় সুপারিশ পেশ করেন। তা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় উদ্যোগীও হয়। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যায়। আলোচিত সৎ এবং সাহসী মেজিস্ট্র্যাট রোকন-উ-দ্দৌলার মতো সরকারি আমলাদের এখানে কাজে লাগাতে হবে। যথা নিয়মে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশ্নপত্রের নমুনা কপি সংগ্রহ করা হবে। পরীক্ষার রাতে ঐসব সৎ আমলাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল সংগৃহীত প্রশ্নপত্র থেকে বেছে বেছে নতুন প্রশ্নপত্রের সেট তৈরি করবেন। সেখান থেকে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রগুলোতে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠাতে হবে। কেন্দ্রে আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষার্থীদেরও প্রবেশ করাতে হবে। এ সময়ে প্রিন্টারে প্রশ্ন প্রিন্ট করে পরীক্ষার হলে সর্বরাহ করতে হবে। তাতে সুফল মিলতে পারে। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার জন্য একটি সেন্ট্রাল সার্ভার থাকবে। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় সার্ভার হতে পরীক্ষাকেন্দ্রে থাকা ট্যাব বা কম্পিউটারে প্রশ্ন পৌঁছে দিতে হবে। অথবা ই-মেইলেও এ কাজটি করা যায়। দেশের সবচাইতে বড় পাবলিক পরীক্ষা হলো পিএসসি। এই পরীক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো ১২-১৫ কোটি টাকার মধ্যেই গড়া সম্ভব এবং শুধু পিএসসি কেন, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিসহ যে কোনো পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ ছাড়া বর্তমান প্রশ্নপত্র ছাপা এবং পাঠানোর খরচও অনেক বেশি পড়ে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেন্দ্রে প্রশ্ন পাঠালে বর্তমানের তুলনায় খরচ কয়েকগুণ কম হবে। বর্তমানে উন্নত পৃথিবীতে পরীক্ষার গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা চালু আছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এদেশেও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব। আসল প্রশ্ন হলো, সংশ্লিষ্টরা সমাধান চাইছেন কিনা?
দেশে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। এখনো হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সাফল্য দেশবাসীর কাছে বেশ স্পষ্ট হলেও পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তাদের সে সফলতাকেই ¤øাান করে দিচ্ছে। প্রায় সব পরীক্ষাতেই এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটায় শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মহল চিন্তিত। আর এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য বজায় থাকবে কিনা তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পিএসসি, জিএসসি, এসএসসি ও সমানের পরীক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখিও হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের কর্ণকুহরে পানি ঢুকছে বলে মনে হচ্ছে না। তা যদি হতো তাহলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটত না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে। একবারও এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে না কেউ। ‘শর্ট সাজেশনস থেকে আসতে পারে’ এমন মন্তব্য করে শিক্ষা বিভাগ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা চালায়। এর আগে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা স্পষ্ট হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যথারীতি ফল প্রকাশ করে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করায় মেধাবীরা বঞ্চিতই থেকে গেছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়াসহ মুঠোফোনে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে প্রতিটি পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন পৌঁছে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে। পরীক্ষার পর দেখা যাচ্ছে, মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকার শাস্তি ন্যূনতম ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। কতবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো ক’জনকে এ শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে? পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন, ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নাম্বার ধারায় এই শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এমনকি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাই শাস্তির এ বিধান সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না। প্রশ্ন ফাঁসের পর তদন্ত কমিটি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ প্রমাণিত হয় কিন্তু শাস্তি হয় না। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে বারবার একই ঘটনা ঘটাচ্ছে।
প্রশ্নফাঁসের ফলে একটি নীতিহীন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠছে। এটা আর চলতে দেয়া যায় না। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবার মধ্যেই একটি ব্যাধি সংক্রামক আকারে বাড়ছে। এটা রোধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে একটি নীতিবিবর্জিত প্রজন্ম উপহার দেয়ার মতো বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই আর বিলম্ব করা ঠিক হবে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত প্রয়োজন মনে করি।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রশ্ন ফাঁস

২০ নভেম্বর, ২০২১
১৭ আগস্ট, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন