Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উন্নয়নের ফানুস এবং সাধারণ মানুষের দুর্দশা

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কোনো সরকারই দেশ পরিচালনায় নিজেকে ব্যর্থ মনে করে না। সব সরকারই মনে করে, তার চেয়ে ভাল সরকার আর কখনো আসেনি এবং তার চেয়ে বেশি উন্নয়ন আর কেউ করতে পারে না বা করেনি। নির্বাচিত, অনির্বাচিত-উভয় সরকারের মধ্যেই এ প্রবণতা দেখা যায়। তবে যে সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হয়ে ক্ষমতায় আসে, তার আওয়াজ একটু বেশি থাকে। জনগণের ভোট না নিয়ে ক্ষমতায় আসার বিষয়টি আড়াল করার জন্য সে মূল অস্ত্র হিসেবে উন্নয়নের উসিলা দেয়। উন্নয়নের ধোঁয়া তুলে জনগণকে আচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা চালায়। এ ধরনের সরকার আমাদের দেশে কমবেশি দেখা গেছে। বর্তমানে যে সরকার দেশ পরিচালনা করছে, তার মধ্যেও ‘আমিই সব করেছি’ এমন একটা ভাব দেখা যায়। বিগত বছরগুলোতে যারা দেশ পরিচালনা করেছে, তার ভাষ্য মতে তারা কিছুই করেনি। কেবল তার আমলেই সব হয়েছে এবং দেশের মানুষ সুখ-স্বচ্ছন্দে বসবাস করছে। এটা বুঝতে চায় না, কোনো সরকার যদি চুপচাপ বসে থাকলেও উন্নয়ন থেমে থাকে না। ধীরগতিতে হলেও উন্নয়ন হয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। দেশের মানুষই নিজ তাকিদে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যায়। সরকার যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলমান উন্নয়নের ওপর নির্ভর করে থাকে, তবে উন্নয়ন কোনোভাবেই গতি পায় না। যে অবস্থায় চলে, সে অবস্থায়ই থেকে যায়। বর্তমান সরকার দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আক্ষরিক অর্থে দেশ কতটা উন্নত হয়েছে, তা বিবেচনার বিষয়। সরকারের মনোভাব অনেকটা এরকম যে, স্থাপনাগত উন্নয়নই আসল উন্নয়ন। বিশেষ করে পদ্মাসেতু নিয়ে তার আগ্রহ এবং প্রচারণার সীমা নেই। যেন পদ্মাসেতু হলেই রাতারাতি দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে। একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বলতে সাধারণত মানুষের জীবনযাপনের মান, সুশাসন, সামাজিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা সর্বোপরি গণতান্ত্রিক ধারার বিকাশকে ধরা হয়। আমাদের দেশে এসব বিষয়ের উন্নতি কতটা হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ থেকে সচেতন মহলের কম-বেশি ধারণা রয়েছে। সরকার যেভাবে উন্নয়নের কথামালা ছড়াচ্ছে, তার সাথে বেশিরভাগ সময়ই বিশ্লেষকদের দ্বিমত পোষণ করতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, উন্নয়ন যে একেবারে হচ্ছে না তা নয়, তবে সরকার যেভাবে বলছে, তার সাথে বাস্তবতার যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। উন্নয়নের সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। যেসব দেশ গণতন্ত্র চর্চা করে তার উন্নয়নের প্রথম শর্তই হচ্ছে, এর ভিত শক্ত করা। আমরা নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিবেচনা করি। সরকারও তা বলে। তবে মুখে বললেও এর প্রায়োগিক বাস্তবতা ভিন্ন। সরকার গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে আমলে না নিয়ে শুধু বস্তুগত বা অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এই মনোভাবের কারণে টেকসই উন্নয়নের হার কম। অথচ গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রকে গৌণ করে উন্নয়ন টেকসই ও ত্বরান্বিত করা যায় না। এর কারণ, গণতন্ত্রে যে জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকে, একে বাদ দিলে সে জবাবদিহি থাকে না। এতে উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিলেও জবাবদিহির অভাবে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এই দুর্নীতিই উন্নয়ন খেয়ে ফেলে এবং গৃহীত কার্যক্রম ধীর হয়ে পড়ে। জবাবদিহিতা থাকলে উন্নয়ন যেমন গতি পায়, তেমনি কার্যক্রমও দ্রæত সম্পন্ন হয়।
দুই.
গত ১৩ জানুয়ারি সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ২০১৭-১৮ অর্থবছরের অর্থনৈতিক পর্যালোচনা বিষয়ক এক প্রতিবেদন তুলে ধরে। সংস্থাটি প্রতি বছরই তা করে। তবে এবার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বিগত এক দশকে দেশে কী ধরনের উন্নয়ন হয়েছে, তার একটি চিত্র উঠে এসেছে। চিত্রটি খুবই হতাশাজনক। প্রতিবেদনে গত বছরকে ‘ব্যাংকিং কেলেঙ্কারির’ বছর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে কী পরিমাণ দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, তার বিবরণ পাওয়া যায় প্রতিবেদনটিতে। পাশাপাশি বলেছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য বেড়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমেছে। এর অর্থ হচ্ছে, ধনীরা আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হয়েছে। এ ব্যাপারে সংস্থাটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। ২০১৬ সালে দেশের মোট আয়ের ০.২৩ শতাংশ আসে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছ থেকে, যা ২০১০ সালে ছিল ০.৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৬ সালে দেশের মোট আয়ের ২৭.৮৯ শতাংশ আসে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় থেকে, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪.৬১ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, গরিবরা দিন দিন গরিব হয়েছে, আর ধনীরা দিন দিন ধনী হয়েছে। অর্থাৎ দেশের মোট আয় এবং সম্পদের সিংহভাগই রয়েছে ধনীদের কাছে। পরিসংখ্যানে বিগত বিএনপি সরকারের আমলের ধনী-দরিদ্রের আয়ের পার্থক্যও তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ মানুষের হাউজহোল্ড ইনকাম বা খানা প্রতি আয় ছিল ১১০৯ টাকা। ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ৭৩৩ টাকা। অন্যদিকে ধনী ৫ শতাংশের খানা প্রতি আয় ছিল ৩৮ হাজার ৭৯৫ টাকা, যা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকা। অর্থাৎ ধনীদের আয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ পরিসংখ্যান থেকে আরও বোঝা যায়, বিএনপি আমলে গরিবের আয় বর্তমান আয়ের চেয়ে বেশি ছিল এবং ধনীদের আয় কম ছিল এবং ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বর্তমানের চেয়ে অনেক কম ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, বিএনপি আমলে সাধারণ মানুষ যে আয় করত, তা বৃদ্ধি দূরে থাক, ধরে রাখাও সম্ভব হয়নি। বরং তা নিম্নগামী হয়েছে। অন্যদিকে সরকার জিডিপি নিয়ে যে গর্ব করে, তা সুষমভাবে সব মানুষের উপকারে আসছে না। জিডিপির ধারাবাহিকতা থাকলেও যে হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, সে হারে হয়নি, উল্টো কমেছে। দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমেছে। সরকার দারিদ্র্য কমিয়ে আনার যে কথা বলছে, তা যথাযথ নয়। সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি যে পরিমাণ মানুষকে উপরে তোলার কথা সে পরিমাণ তুলতে পারেনি। এর অর্থ, জিডিপি অনেকটা একপেশে হয়ে পড়েছে। হবে না কেন, যে দেশের মোট আয় ও সম্পদের ৫১.৩২ ভাগ মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কুক্ষিগত, সে দেশে সাধারণ মানুষের উন্নতি সুদূরপরাহত হয়ে পড়তে বাধ্য। তারা আরও দরিদ্র্য হতে থাকে। তাদের সাথে ধনীদের ব্যবধান বাড়তেই থাকে। সাধারণ মানুষের এক পা আগাতে ৫ সেকেন্ড লাগলে ধনীরা এ সময়ে আগায় ১০ পা। বলা বাহুল্য, শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষকে তলানিতে রেখে, শুধু ৫ ভাগ মানুষের আয়কে যদি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, তবে সে দেশের সাধারণ মানুষের অসহায় হয়ে পড়া ছাড়া কোনো গতি থাকে না। মনে হওয়া স্বাভাবিক, সরকার ৫ ভাগ মানুষের উন্নতিকেই দেশের উন্নতির মাপকাঠি হিসেবে ধরে নিয়েছে এবং উন্নয়নের ফানুস উড়াচ্ছে। সরকারের কাছে ৫ ভাগ মানুষই জনগণ এবং চালের কেজি যদি ২০০ টাকাও হয়, তাহলেও এই ৫ ভাগ মানুষের কিনতে কোনো অসুবিধা হবে না। এ কারণে ২৫ টাকার পেঁয়াজ ১২০ টাকা হলে বা মোটা চাল ৫০ টাকা হলেও সরকারের মধ্যে কোনো উদ্বেগ বা বিচলন দেখা যায় না। এ ধরনের সরকারকে কি সার্বজনীন বা সর্বসাধারণের বলা যায়? সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থার চিত্র শুধু সিপিডির প্রতিবেদনেই উঠে আসেনি, খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর ২০১৬ সালের প্রকাশিত খানা আয় ও ব্যয়ের জরিপ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সালে একটি পরিবার সব খরচ মিটিয়ে ৫৫৯ টাকা সঞ্চয় করতে পারত। ২০০৫ সালে এ সঞ্চয় বেড়ে হয় ৭৭৭ টাকা। ২০১৬ সালে গ্রামে একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। এর বিপরীতে মাসিক ব্যয় ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মাসে আয়ের তুলনায় প্রায় ৮০৩ টাকা বেশি ব্যয় বা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ পরিসংখ্যানগুলো সরকার আমলে না নিয়েই উন্নয়নের ধোঁয়া তুলেছে। এই উন্নয়নের স্লোগানের বিপরীতে যদি কোনো সংস্থার পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, তাহলেই সরকার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। যারাই এ ধরনের চিত্র তুলে ধরে তাদেরকেই বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির পক্ষ হয়ে কাজ করছে বলে তুলোধুনো করে ছাড়া হয়। সিপিডির প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর সংস্থাটিকেও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে তীব্র বাক্যবানে বিদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সংস্থাটি বিএনপির মুখপাত্র হয়ে কাজ করছে। প্রতিবেদনকে ‘রাবিশ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সরকারের এসব বক্তব্য যে তার ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। তবে সরকার যতই তার ব্যর্থতা আড়াল করতে চাক না কেন, তাতে ভুক্তভোগী ৯৫ শতাংশ মানুষের কষ্ট আড়াল করা যাচ্ছে না। তাদের জীবনের হাহাকার কোনো না কোনোভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মানুষের মনে এখন এ কথাই প্রতিধ্বণিত হচ্ছে, আগেই তো ভালো ছিলাম।
তিন.
আমরা যেন এখন এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালার যুগে বসবাস করছি। যেখানে কেবল স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো হচ্ছে। মানুষকে স্বপ্নের ঘোরে রাখা হচ্ছে। ঘোর ভেঙে সাধারণ মানুষ যখন বাস্তবের মুখোমুখি হয়, তখন তাদের আফসোসের সীমা থাকে না। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বপ্ন যে খুব বড়, তা নয়। তারা শুধু সম্ভ্রমের মধ্যে থেকে তিন বেলা পেট ভরে খেয়ে একটু স্বচ্ছন্দে চলতে পারলেই স্বপ্নপূরণ হয়েছে বলে ধরে নেয়। মৌলিক এই চাহিদা যদি সরকার পূরণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বড় বড় স্বপ্ন দেখায়, তাহলে সাধারণ মানুষও সে স্বপ্ন আগ্রহ নিয়ে দেখে। সেক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখাতে এবং দেখতে কোনো সমস্যা নেই। এখন মানুষকে জীবনযাপন করতেই মহা টেনশনে থাকতে হয়, এ অবস্থায় যত ভালো স্বপ্ন দেখানো হোক না কেন, তা তার কাছে বিরক্তিকর ঠেকে। মানসিক অস্থিরতা এবং পেরেশানির মধ্যে কারো পক্ষেই স্বপ্ন দেখা সম্ভব হয়ে উঠে না। দেশের মানুষ এখন এমনই এক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সূচকের যেসব অগ্রগতির কথা ব্যাপকহারে প্রচার করা হচ্ছে, তা যে ঐ ৫ শতাংশ মানুষের উন্নতি ও অগ্রগতির উপর ভিত্তি করে হচ্ছে, তা এখন স্পষ্ট। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে, তাও ঐ ৫ শতাংশ মানুষের আয়ের মধ্যেই নিহিত, যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো অংশ নেই। পদ্মাসেতুসহ অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, তা ৯৫ শতাংশ সাধারণ মানুষ ও ৫ শতাংশ ধনী মানুষের কাছ থেকে সমান হারেই কেটে নেয়া হচ্ছে। অথচ যে ৫ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের মোট আয়ের অর্ধেকের বেশি অর্থ-সম্পদ রয়েছে, তাদের কাছ থেকে কেটে নিলে একটি নয়, একাধিক পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। বলা বাহুল্য, ধনীর পকেট থেকে যদি ১০ টাকা কেটে নেয়া হয়, তবে তার কাছে তা নস্যি, অন্যদিকে একজন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে একই টাকা কেটে নিলে তাতে তার চলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। ক্ষমতাসীনরা এ বিষয়টি কোনোভাবেই উপলব্ধি করছে না। এর কারণ হচ্ছে, সে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়নি। জনগণের কিসে দুঃখ ও কষ্ট হয়, তা উপলব্ধি করতে পারছে না। জনগণের ভোটের মায়া তার ভেতর কাজ করে না। এই মায়া নেই বলেই জনগণকে কষ্ট দিয়ে হলেও একটি বড় স্থাপনা নির্মাণ করে দেখাতে চায়, সে উন্নয়ন করছে। এটা ভাবে না, এ উন্নয়ন করতে গিয়ে জনগণের পকেট থেকে অর্থ কেটে নেয়ার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে তারা যে দুর্গতিতে পড়েছে, এ থেকে তাদের বের হয়ে আসতে কত সময় লাগবে বা আদৌ বের হতে পারবে কিনা। ফলে যারা দারিদ্র্যসীমার মধ্যে ছিল বা দারিদ্র্যসীমার একটু উপরে উঠেছিল, তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। সঠিকভাবে যদি এখন দ্রারিদ্র্যসীমার উপর জরিপ চালানো হয়, তবে দেখা যাবে অসংখ্য মানুষ এই সীমার নিচে চলে গেছে। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এক চালের দাম বৃদ্ধিতে ৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম উর্ধ্বমুখী থাকায় সংখ্যাটি যে আরও ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যাপক ব্যবধানের ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাবও বড় ভূমিকা পালন করছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সাধারণ মানুষের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে ধনিক শ্রেণীকেই ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে ধরে নিয়েছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ধনিক শ্রেণীই তাকে ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করছে। সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগে ধনিক শ্রেণী নানা দুর্নীতি ও অনাচারের মাধ্যমে অর্থ-বিত্তের মালিক হলেও সরকার কিছু বলতে পারছে না। কারণ তার লক্ষ্য সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন নয়, ক্ষমতায় টিকে থাকা। সরকার ভালো করেই জানে, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর মতো শক্তি সাধারণ মানুষের নেই। অন্যদিকে ধনিক শ্রেণী ক্ষমতার বলয়ে থেকে সরকারকে নড়বড়ে করে দিতে সক্ষম। এ কারণেই সরকারের চিন্তায় সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধা পাত্তা পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলার যে সব মাধ্যম রয়েছে, যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম, সরকার আগে থেকেই সেগুলোকে চাপ প্রয়োগে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। ফলে জনগণের ভেতর যতই হাহাকার উঠুক তা সরকারের কানে পৌঁছায় না। এতে দেশের অর্থনীতি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। দ্ররিদ্ররা তলানিতে চলে যাচ্ছে, ধনীরা আরও উপরে উঠে যাচ্ছে। ধনীদের সম্পদ দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত গড়িয়ে পড়েছে। অর্থনীতিতে যদি ভারসাম্য থাকত তবে তা অর্থনীতির পিরামিডীয় সূত্রাকারে উপরের শ্রেণীর সম্পদ সম্প্রসারিত হয়ে নিচের দিকে বা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছত। তা না হয়ে, এ সূত্র উল্টা পিরামিডে পরিণত হয়ে সাধারণ মানুষের সম্পদ ধনী শ্রেণীর কাছে চলে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, অর্থনীতির এই বৈষম্য এবং ভারসাম্যহীনতার রেশ তাকে টানতেই হবে। বর্তমান সরকার পুনরায় এলে, এ পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এবং সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে, তা অনুমান করতে বোধকরি কারোই অসুবিধা হচ্ছে না।
চার.
সিপিডি ও বিবিএস-এর অর্থনৈতিক প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই সংগীন। সরকার যতই অসন্তুষ্ট হোক বা তা উড়িয়ে দিক না কেন, এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষের উপর দিয়ে যে টানাপড়েনের ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তা বালিতে মুখ গুঁজে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বর্তমান অর্থনীতির সার্বিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করতে হলে, আগে কী অবস্থা ছিল, তার পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করলে এর উন্নতি-অবনতি বোঝা যায়। অর্থনৈতিকভাবে দেশ কতটা এগিয়েছে, তার সঠিক চিত্র স্পষ্ট হয়। সিপিডির প্রতিবেদন নিয়ে সরকার যতই অসন্তুষ্ট হোক না কেন, তারা বর্তমান সরকারের ৯ বছর শাসনকাল এবং তার আগের শাসনামলের অর্থনৈতিক চিত্রের তুলনা করে হিসাবের যথার্থতা দেখিয়েছে। সরকারের সমস্যা হচ্ছে, কোনো সংস্থার প্রতিবেদন পক্ষে গেলে তা নিয়ে হুলুস্থুল প্রচারণায় মেতে উঠে। বিপক্ষে গেলেই রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়। বরং সরকারের উচিত, তার বিপক্ষের পরিসংখ্যান আমলে নিয়ে যাচাই করে এ থেকে উত্তরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কারণ, কোনো দেশই উন্নয়নের ফানুসের মধ্যে এগিয়ে যেতে পারে না। সিপিডি এ প্রতিবেদন না প্রকাশ করলেও সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র বদলে যেত না। তারা যে কষ্টে আছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ