Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ০২ জুলাই ২০২৪, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ২৫ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

মার্কিন চাপে হাক্কানির বিরুদ্ধে কঠোর হবে পাকিস্তান?

| প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ইনকিলাব ডেস্ক : যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান চলমান উত্তেজনায় সর্বশেষ সংযোজন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খুররাম দস্তগীর খানের বক্তব্য। পাকিস্তানে মার্কিন নিরাপত্তা সহযোগিতা স্থগিতের প্রতিক্রিয়ায় স¤প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে হাক্কানি এবং আফগান তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের আচরণ আগেও পরিবর্তন করা যায়নি, এখনও যাবে না। আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব কমাতে আগের মতোই এই জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে পাকিস্তান। আর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক বিশ্লেষণ বলছে, কঠোর ঘোষণা-পাল্টা ঘোষণা দেওয়া হলেও আদতে দুই দেশই অনেক সতর্কভাবে পদক্ষেপ ফেলছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার বিশ্লেষণেও একইরকম ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে সহায়তা বন্ধের ঘটনা নতুন নয়; সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পরীক্ষার মুখে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এই সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের মিত্ররা ধারাবাহিক অভিযোগ করে আসছে, আফগান তালেবান ও তাদের মিত্র হাক্কানি নেটওয়ার্ককে পাকিস্তানে ‘নিভৃত আবাস’ গড়ে তোলার সুযোগ করে দিয়েছে ইসলামাবাদ। নতুন বছরের টুইটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিথ্যাচার ও সন্ত্রাসবাদে মদদের অভিযোগ তুলে পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের হুমকি দেওয়ার পর ৫ জানুয়ারি নিরাপত্তা সহযোগিতা স্থগিতের ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে আর মিত্রতা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির সেনাপ্রধান। সর্বশেষ পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খুররাম দস্তগীর খান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান স্বার্থগত দ্ব›দ্ব যেভাবে শুরু
১৯৫০ এর দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান মিত্র দেশ হিসেবে পরস্পরকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক ঘাটতি পূরণ করতে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা পাঠাতো। ১৯৫৯ ও ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে পেশাওয়ারের কাছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র জন্য একটি ঘাঁটি তৈরি করে দিয়েছিল পাকিস্তান। ওই ঘাঁটিটি সোভিয়েত ইউনিয়নের রেডিও ট্রান্সমিশন রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হতো। ১৯৮০ এর দশকে দুই দেশই আফগান যুদ্ধে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। মূলত পাকিস্তানি ভূখন্ড ব্যবহার করে আফগান গেরিলারা এই লড়াই চালিয়েছিল। আর তাদেরকে সংগঠিত করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তবে দুই দেশের মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্বটা মূলত শুরু হয়েছিল ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা হওয়ার পর থেকে। তখন আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি দেখা যেতে লাগলো এবং মার্কিনিরা পাকিস্তানকে গোয়েন্দা তথ্যের উৎস ও সরবরাহ রুট হিসেবে ব্যবহার শুরু করলো। এমনভাবে সবকিছু সাজানো হলো যে দেখে মনে হতো, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী যন্ত্র ও ড্রোনের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করে যুক্তরাষ্ট্র, আর পাকিস্তান গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সরবরাহ করে। তবে বাস্তব কারণ ছিল ভিন্ন। এই সম্পর্কের নেপথ্যে ওয়াশিংটন চাইছিলো উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাকিস্তানে মনোনিবেশকারী সশস্ত্র ইসলামী জঙ্গিদের পরাজিত করতে। এই জঙ্গিদেরকে নিজেদের প্রধান শত্রু বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বিশ্বাস করে কেবল পাকিস্তানের সহায়তায় তাদেরকে পরাজিত করা সম্ভব। অন্যদিকে ১৯৮০ এর দশকে আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় প্রভাব দূর করতে এই গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করা শিখে ফেলে পাকিস্তান। কয়েকজন আল কায়েদা নেতাকে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করার জন্য পাকিস্তানিরা তথ্য সরবরাহ করলেও তা থেকে তালেবান কিংবা হাক্কানি নেটওয়ার্কের বড় বড় নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেবল তালেবানের শীর্ষ সামরিক কমান্ডার মোল্লা বিরাদার। ২০১০ সালে তাকে আটক করা হয়। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন, বিরাদারকে ভিন্নভাবে বিবেচনার কারণ আফগান সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক। তিনি গোপনে আফগান সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা চালাচ্ছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছিলো। পাকিস্তান বাইতুল্লাহ মাহসুদসহ তথাকথিত পাকিস্তানি তালেবান মুভমেন্ট (টিটিপি) এর বেশ কয়েকজন কমান্ডারের ওপর হামলা চালাতে সহযোগিতা করেছিল। এর কারণ ছিল ২০০৭ সালে ইসলামাবাদের লাল মসজিদে এক সামরিক অভিযানে বেশ কয়েকজন জঙ্গি নিহত হওয়ার পর এই তালেবান গোষ্ঠীটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল।
হাক্কানির বিরুদ্ধে আদৌ কি কঠোর হবে পাকিস্তান?
বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, যে বিষয়গুলোকেই পাকিস্তান তাদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে সেগুলোকে তারা আফগানিস্তান সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়। আর ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ বিষয়গুলো অক্ষত থেকে যায়। সেকারণেই হয়তো কোয়েটা, পেশাওয়ার, করাচি এমনকি রাজধানী ইসলামাবাদের মতো শহরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ তালেবান কমান্ডারদেরকে দেখতে পাওয়াটা বিরল কোনও ঘটনা নয়। বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে গোয়েন্দা সহযোগিতা অব্যাহত রেখে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অর্জনের আশা খুবই কম। একইভাবে পাকিস্তানও গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ রেখে যুক্তরাষ্ট্রকে সামান্যই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। কেবল একটি উপায়েই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। আর তাহলো আফগানিস্তানে সরবরাহ রুটগুলো বন্ধ করে দেওয়া। তবে এখন পর্যন্ত পাকিস্তান এই ধরনের কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। পাকিস্তানের কাছ থেকে পর্যবেক্ষকরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে খারাপ যে পদক্ষেপ আশঙ্কা করতে পারেন তাহলো- দেশটি মার্কিন সরবরাহের ক্ষেত্রে ট্রানজিট ফি বাড়িয়ে দিতে পারে কিংবা সরবরাহে বিলম্ব ঘটাতে সময়ে সময়ে জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিবিসির দাবি, এটি হলো উত্তেজনার চিহ্ন এবং প্রতিশোধের প্রদর্শন, কিন্তু দুই পক্ষ যে ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছে, বাস্তবতা অতোটা কঠোর নয়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উড্রো উইলসন সেন্টারের উপ পরিচালক মাইকেল কুগেলমান আল জাজিরাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহায়তা স্থগিতের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এই ধরনের ঘটনা আগেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে এবং সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পাকিস্তানের আচরণের পরিবর্তন হয়নি।’
কুগেলমান মনে করেন, মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলেও হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও আফগান তালেবানকে সমর্থন যুগিয়ে যাবে পাকিস্তান। তিনি বলেন, ‘ভারতবিরোধী এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখাটা পাকিস্তানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আফগানিস্তান থেকে ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি ঠেকাতে এই গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে পাকিস্তান।’
পাকিস্তানি বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী আল জাজিরাকে বলেন, তার ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমাতে পাকিস্তান হাক্কানি নেটওয়ার্কের কতিপয় যোদ্ধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে সেই তালিকায় কোনও বড় নেতার নাম থাকবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ