হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
ছোট বেলায় সুখী মানুষ নিয়ে একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি প্রাইমারি লেভেলের কোনো একটি শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই গল্পে একজন সুখী মানুষের কথা বলা হয়। যদ্দূর মনে পড়ে গল্পটির সারসংক্ষেপ এরকম- সুখী মানুষটির একটি মাত্র জামা, একটি লুঙ্গি। থাকেন বনের ভেতর কুঁড়ে ঘরে। কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে যা পান তাই দিয়ে জীবন ধারণ করেন। এর বেশি তার কোনো চাওয়া নেই। তিনি অত্যন্ত সুখী। পাঠ্যপুস্তকে এই গল্প অন্তর্ভুক্ত করে এটাই শিক্ষা দেয়া হয়, সুখী হতে বেশি কিছু লাগে না। যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট হলে সুখী হওয়া যায়। বলা যায়, এটা চাহিদার এক ধরনের সীমিতকরণ প্রক্রিয়া। ওয়ান্ট নট ওয়্যাস্ট নট-চাহিদা নেই, হারানোর ভয়ও নেই। এটি নীতি-নৈতিকতা এবং সততারও বিষয়। গল্পটি ছাত্র-ছাত্রীদের নৈতিক শিক্ষা দেয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত ছিল। তবে এ ধরনের গল্প এখন আর পাঠ্যপুস্তকে খুব একটা দেখা যায় না। এর কারণ হতে পারে পুঁজিবাদের দিকে ধাবিত করা। অল্পতে তুষ্ট থাকলে হবে না, নিজের এবং দেশের উন্নতি করতে হবে। সময়ের সাথে অনেক থিওরিই বদলে যায়। এক সময় অল্পতে তুষ্ট থাকার জন্য নসিহত করা হতো। এখন আয়-উন্নতি করার জন্য ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেয়া হয়। প্রতিনিয়ত উন্নতির নতুন নতুন থিওরি আবিষ্কার এবং উপস্থাপন করা হচ্ছে। পুঁজিবাদে সুখী হওয়ার একমাত্র সংজ্ঞাই হচ্ছে, যেভাবে পারো অর্থ রোজগার করো, সুখী হও। মানুষও এ সংজ্ঞা মেনে অর্থের পেছনে ছুটছে। উন্নতির রেসে শামিল হচ্ছে। যারা পারছে, এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকে প্রাণপণ চেষ্টা করছে, অনেকে ছিটকে পড়ছে, অসুখী হচ্ছে। তাদের দুঃখের সীমা থাকছে না। ভাববাদীরা অনেক সময় বলেন, অর্থ থাকলেই সুখী হওয়া যায় না। তবে ভাববাদীদের এ কথাকে এখন অক্ষমের সান্ত¡না পাওয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। বাস্তববাদীরা ভাববাদীদের এ কথার সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, অর্থ থাকলে সুখের সন্ধানে বিশ্বের অনেক জায়গায় যাওয়া যায়। পুঁজিবাদের এ যুগে অধিকাংশ মানুষের কাছে এখন সুখের একমাত্র সংজ্ঞা এটাই এবং সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। আবার অনেকে এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, সুখ একটি আপেক্ষিক বিষয়। যার কাছে যেটি সুখের অন্যের কাছে, তা দুঃখের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কারো কাছে শিশুর দুষ্টুমি আনন্দের মনে হয়, কারো কাছে বিরক্তিকর হয়ে উঠে। কেউ পা পিছলে পড়ে গেলে তার যেমন দুঃখের সীমা থাকে না, তেমনি তার পতন দেখে অনেকে আনন্দিত হয়ে উঠে। খিলখিল করে হাসে। মানুষের বৈশিষ্ট্যই এমন, অতি ক্ষুদ্র বিষয় থেকে যেমন আনন্দ লাভ করে, তেমনি তা থেকে দুঃখ বোধও করে। যার কাছে যেটা সুখের, অন্যের কাছে তা দুঃখের। দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে সুখ বিষয়টি আপেক্ষিক রূপ ধারণ করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ের এই সুখ-দুঃখ এখন সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। কোন দেশ কতটা সুখী এ পরিমাপ করা শুরু হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা জরিপ করা শুরু করেছে। বছর বছর সাড়ম্বরে সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়।
দুই.
সম্প্রতি জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সল্যুশন নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন)-এর এক জরিপে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ডেনমার্ক, আর সবচেয়ে অসুখী দেশ বুরুন্ডি। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১০। সংস্থাটি তিন বছর ধরে ১৫৬টি দেশে জরিপ চালিয়ে এ তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রতিটি দেশের এক হাজার নাগরিকের কাছে প্রতিবছর তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এবং শূন্য থেকে দশের মধ্যে একটি পয়েন্ট তালিকায় নম্বর দেয়ার জন্য বলা হয়। সুখের এ মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, দাতব্য সেবা এবং দুর্নীতিহীনতা। দশ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৪.৬৪৩ পয়েন্ট। জরিপে দেখানো হয়েছে, যেসব দেশে বৈষম্য বা ভেদাভেদ কম, সেসব দেশের মানুষ বেশি আনন্দে থাকে। বিশেষ করে যেসব দেশে সামাজিক সহায়তা বেশি, বিপদে সমাজ বা রাষ্ট্রের সহায়তা পাওয়া যায়, সেসব দেশের নাগরিকরাই বেশি সুখী। তবে এ কথাও সত্য, জরিপ বা পরিসংখ্যানে সবসময় সত্যিকারের চিত্র প্রতিফলিত হয় না। এটা একটি ধারণামাত্র। সার্বিক পরিস্থিতি বোঝার জন্য এক ধরনের পরিমাপক। বাংলাদেশ চিরকালই একটি দুঃখী দেশ, এটা সবারই জানা। এদেশের মানুষকে শত শত বছর ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত হয়ে নিপীড়ন-নির্যাতন সইতে হয়েছে। এই শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে অনেক সংগ্রাম ও রক্ত দিতে হয়েছে। অবশেষে নিজেদের দেশে সুখে-শান্তিতে বসবাসের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। তারপরও এদেশের মানুষ সুখের সন্ধান পায়নি। সুখের সন্ধান যে পায়নি, তা জাতিসংঘের জরিপে ১১০ নম্বর হওয়া থেকেই বোঝা যায়। তার চেয়েও বড় বিষয়, এখনও আমাদের শাসক গোষ্ঠী বক্তৃতা-বিবৃতিতে দেশকে একটি সুখী সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার কথা অহরহ বলছে। এ থেকেও বোঝা যায়, জনগণ দুঃখের মধ্যেই আছে। তাদের সুখের জন্য যে লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন-তা সোনার হরিণ হয়েই রয়েছে। তা নাহলে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০ নম্বরে হবে কেন? সহায়-সম্পদে না হোক, নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে রেহাই পেয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার মধ্যেই তো সুখী হওয়ার কথা। তাছাড়া এ কথাও বলা হয়, আমাদের দেশের মানুষ অল্পতেই তুষ্ট হয়। মোটা কাপড় আর মোটা চালের ভাত খেতে পারলে তাদের আর কিছু লাগে না। তাদের এ চাহিদার বিপরীতে তো আমাদের সম্পদ অনেক ছিল। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছের কথা আমরা সবাই জানি। মুরুব্বিদেরও গল্প করতে শুনেছি। ফলে যার গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর স্বাধীনভাবে বসবাস করার সুযোগ থাকে, তার তো অসুখী হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। তারপরও কেন বাংলাদেশ সুখী মানুষের দেশের তালিকায় একশ’র পরে? এ নিয়ে ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন না হলেও এটা সবাই স্বীকার করবেন, বিভিন্ন সময়ে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন, তারাই দায়ী। জনগণ তাদের ‘গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ’ রক্ষা এবং তা বৃদ্ধির দায়িত্ব একেকবার একেক শাসক দলের উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে অতি আদর করে দায়িত্ব অর্পন করেছে। তারা যে এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে করতে পারেননি, তা জনগণের দুঃখ না ঘোচা থেকেই বোঝা যায়। বরং তাদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ বরাবরই উঠেছে, মানুষের সরল বিশ্বাসকে পুঁজি করে তারা নিজেদের সুখী করার সব বন্দোবস্ত করায় ব্যস্ত থেকেছেন এবং এখনও আছেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, জনগণ এসব মেনে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেরাই নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করার নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে। তারা শাসক গোষ্ঠীর দিকে না তাকিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মাধ্যমে নিজেদের সুখী করার চেষ্টা করছে। ফসলের বাম্পার উৎপাদন করছে। বিদেশ গিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে। মানুষের এই উদ্যমী ভূমিকার কারণেই দুঃখ-কষ্টের মধ্যে বাংলাদেশ এখনো টিকে আছে। এ নিয়ে শাসক গোষ্ঠীরও গর্বের সীমা থাকে না। জনগণের এ ভেবে দুঃখ হতে পারে, কার ফসল কার ঘরে যায়। বাম্পার ফসল ফলালাম আমরা, কৃতিত্ব নেয় শাসক গোষ্ঠী। বিদেশে কামলা দিয়ে টাকা পাঠাই আমরা, আনন্দ করে সরকার। বিষয়টি তাদের কাছে এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘কেউ মরে বিল সেঁচে, কেউ খায় কৈ’। তাদের আরও দুঃখ হতে পারে যখন তাদের উৎপাদিত ফসল রক্ষায় সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায় না। উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণে উৎপাদন খরচ দিয়েও ফসল কেনে না। এ দুঃখে কৃষকদের রাস্তায় ফসল ফেলে প্রতিবাদ করতে আমরা দেখেছি। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে! আবার যাদের কষ্টার্জিত অর্থে দেশের রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়, সেই অর্থও আবার চোরে চুরি করে নিয়ে যায়। সরকার রক্ষা করতে পারে না। জনগণের উৎপাদিত ও উপার্জিত সম্পদই যখন চুরি হয়ে যায়, তখন কি সুখী হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে?
তিন.
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ কতটা সুখী আর কতটা অসুখী, তা তারা বলতে পারছে না। বলার মতো কোনো প্ল্যাটফর্মও নেই। আমাদের সুখের কথা বলে দিচ্ছে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান। তারা আমাদের দেশে এসে হাজার খানেক মানুষের মতামত নিয়েই সুখী-অসুখীর রায় দিয়ে দিচ্ছে। এখন হাজার খানেক মানুষের সুখ-দুঃখের উপর ভিত্তি করে ষোল কোটি মানুষের সুখ-দুঃখের বিচার করা কতটা যৌক্তিক, তা পাঠকরাই ভাল বলতে পারবেন। হতে পারে কিছু মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে এ জরিপ করা হয়। তবে তা যে সঠিক হবে, এ নিশ্চয়তা বিধান করে না। এই সময়ে যদি বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখের হিসাব করা হয়, তবে অনেকেই একমত হবেন, তারা ভাল নেই। এই ভাল না থাকার মূল কারণ হচ্ছে, সুশাসনের অভাব। দেশে যে সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, তা একজন সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজের দিকে তাকালেই এটা বোঝা যায়। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে পরিলক্ষিত হবে, দেশে এক ধরনের ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবণতা বিরাজ করছে। ক্ষমতায় যারা আছেন, তাদের কথাই সঠিক, মানতে হবে, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, এমন একটা কালচার দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীনদের এই নিরঙ্কুশ আধিপত্য এবং থ্রেটের মধ্যে সাধারণ মানুষ রয়েছে। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার ও লুট হয়ে গেলেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। লোক দেখাতে কিছু লোককে ‘স্কেপ গোট’ বা বলির পাঁঠা বানিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে ব্যাপক প্রচার করা হলেও নেপথ্যের গডফাদাররা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। শেয়ার বাজার থেকে ৯৬ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল আর ৩৩ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়লেও- এর কোনো প্রতিকারই হয়নি। এ নিয়ে সরকারের মধ্যে কোনো উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়নি। সোনালি ব্যাংক, হলমার্ক, ডেসটিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটেরারা হাতিয়ে নিলেও একটি টাকাও উদ্ধার করা যায়নি। দেশর মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল, তাদের টাকা কিভাবে লুট হয়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ লুটের ঘটনাও তারা দেখছে। এ নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, এ ঘটনাও অল্প কিছুদিনের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে। কারো বিচারও হবে না, টাকাও উদ্ধার হবে না। যে দেশে জনগণের অর্থ নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা হয়, সে দেশের মানুষ কিভাবে সুখে থাকে? এর উপর জনগণকে যতভাবে টানাপড়েনের মধ্যে ফেলা যায়, তার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। গ্যাস, বিদ্যুতের ও দাম দফায় দফায় বাড়িয়ে তাদের তোলা হচ্ছে নাভিশ্বাস। জনসাধারণ উন্নতির যতটুকু পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেখান থেকে তাদের টেনে নামিয়ে আনার বন্দোবস্ত চলছে। তাদের জীবনযাপন বানরের তৈলাক্ত বাঁশে উঠানামার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে ক্ষমতার কাছাকাছি ও প্রভাবশালী মহলের কিছু লোক যে মহাসুখে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। তারা এ দেশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করলেও এ দেশকে সুখের আবাস মনে করে না। তাদের সব সুখ বাঁধা আছে বিদেশ- মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকায় তারা বসতবাড়ি বানিয়েছে। তাদের আচরণ অনেকটা ইংরেজদের মতো। ইংরেজরা যেমন ইংল্যান্ডের বাসিন্দা হয়ে এ দেশ দুইশ’ বছর শাসন করেছে এবং সম্পদ নিয়ে গেছে, তেমনি আমাদের দেশেরও কিছু লোক এ কাজ করে চলেছে। তারা দেশের দ-মু-ু হয়ে শাসনও করছে, আবার দেশের অর্থ লুট করে বিদেশেও নিয়ে যাচ্ছে। লুটপাটের কথা বাদ দেয়া যাক। আমরা যদি মানুষের নিরাপত্তার দিকে তাকাই, তাহলে মানুষের চেহারায় আতঙ্কই দেখব। অপহরণ, খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাস এতটাই বেড়েছে যে, কে কখন অপহরণ বা খুনের শিকার হবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এসব অপরাধ যাদের দমন করার কথা সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যই ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন, ধর্ষণ, অপহরণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। রক্ষক যদি এমন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে, তাহলে মানুষ সুখে থাকে কীভাবে! শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশে মানুষের ত্রস্ত ও শংকিত হয়ে বসবাসের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। এভাবে কী সুখে থাকা যায়? এর পাশাপাশি তো অকল্পনীয় সামাজিক অপরাধ রয়েছেই। হিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষকে এমনভাবে গ্রাস করে ফেলেছে যে, নিজের সন্তানকে পর্যন্ত খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না। পুরো সমাজ ব্যবস্থায় এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রের পরিচালকরা যদি সঠিক পথে না থাকে বা সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারে, তবে অনিবার্যভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পড়তে বাধ্য। মাথা যদি ঠিক না থাকে, শরীর ঠিক থাকার কোনো কারণ নেই। আমরা যদি রাজনীতির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব সেখানে যারা বিচরণ করেন, তারা সুখে আছেন, এমন কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের কথা বাদই দেয়া যাক। তাদের দুঃখের সীমা নেই। তবে সরকারে যারা আছেন এবং যেভাবে আছেন, তারা কি সুখে আছেন? শান-শওকত ও ক্ষমতা-প্রতিপত্তির মধ্যে থেকেও কি শঙ্কার মধ্যে নেই? বিশেষ করে যে দল জনসাধারণের ভোটের তোয়াক্কা না করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে, তাদের শঙ্কা তো স্বৈরাচারী সরকারের চেয়েও বেশি থাকার কথা। কারণ ক্ষমতাচ্যুত হলে এর জবাব জনগণকে অবধারিতভাবে দিতে হবে। এটা অবশ্য পরের কথা। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে দেশ জোরজবরদস্তির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়, সে দেশের মানুষ কোনোভাবেই সুখে থাকতে পারে না।
চার.
আমরা প্রায়ই সরকারের সর্বোচ্চ পার্যায় থেকে বলতে শুনি, ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চাই’। সচেতন মহল থেকে এর বিপরীতে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও বাংলার দুঃখী মানুষ সুখী হতে পারল না কেন? সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যমলা সোনার বাংলার দুঃখ ঘুচলো না কেন? সমস্যা কোথায়? ঘুরে-ফিরে এসব প্রশ্নের উত্তর ঐ এক জায়াগায়ই পাওয়া যায়। স্বাধীনতার পর থেকে সোনার বাংলা যারা চালিয়েছেন, তারা দক্ষ চালক ছিলেন না। বড়ই অদ্ভুত বিষয়, যে দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে পারে, সে দেশ পরিচালনার জন্য দক্ষ চালক খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশ ও দেশের মানুষকে সুখী করার জন্য সর্বপ্রথম যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন, তা আজও প্রতিষ্ঠা কারা যায়নি। এখনও এ নিয়ে আলোচকরা এন্তার আলোচনা করছেন। তাদের কথাবার্তা-আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। সুশাসন আর প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না। কেবল দুঃশাসনই গ্রাস করে চলেছে। এর ফলে মানুষের প্রাণহানি, অপহরণ, নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে এক ধরনের লুটপাটতন্ত্র কায়েম হয়েছে। জনগণের পয়সা মেরে খাওয়ার সংস্কৃতি চালু হওয়া এবং কিভাবে তাদের জীবনে টান ধরানো যায়, তার প্রক্রিয়া চলছে। এক ‘বর্গী’ শ্রেণীর হানা যেন বিস্তৃত হয়েছে। সব লুটপাট করে তারা নিজেরা সুখে থাকতে চাচ্ছে। অন্যদিকে জনগণের সামনে উন্নয়নের কিছু ‘প্ল্যাকার্ড’ তুলে ধরে আশ্বস্থ ও সান্ত¡না দেয়ার অবিরাম প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। অথচ দেশকে এক ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের সুখে থাকার কারণ থাকতে পারে না। জাতিসংঘ সুখী দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ যে অবস্থানে রয়েছে, তা না দেখলেও বুঝতে কারোই অসুবিধা হয় না, দেশের মানুষ সুখে নেই। সুখ তাদের কাছে সোনার হরিণ হয়েই রয়েছে এবং ‘সুখ তুমি কি বড় জানতে ইচ্ছে করে’ এ গান যেন তাদের গেয়েই যেতে হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।