Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়লেই প্রবৃদ্ধি বাড়বে পরিকল্পনা মন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ৫ জানুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগের সামঞ্জস্য নেই -মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বিনিয়োগ না বাড়িয়েও প্রবৃদ্ধি বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তাহলে ২০১৯ সালের মধ্যেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রেক্ষিত শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, জিডিপির ভিত্তিবছর পরিবর্তন প্রয়োজন। কেননা এখন প্রযুক্তি, ই-কর্মাস, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অনেক নতুন বিষয় অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে। এসব জিডিপির হিসাবে আনতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেসব দেশে বিনিয়োগ ছাড়াই প্রবৃদ্ধি হয়। মালয়েশিয়াতে মোট জিডিপির ২৩ শতাংশ বিনিয়োগ হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ অনেক বেশি। পরিকল্পনামন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, জনসংখ্যার বোনাসকাল নিয়ে যারা উদ্বিগ্ন তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ, আমাদের তথ্য বলছে, ২০৬১ সাল পর্যন্ত আমরা এই সুযোগ হারাব না। ওইসময় আমাদে কর্মক্ষম মানুষের হার থাকবে ৬৫ শতাংশ।
চালের দাম ও পেঁয়াজের দাম বাড়ার ফলে ৫ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে বলে সম্প্রতি যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, দুটি আইটেম দিয়ে আপনি বলতে পারেন না পাঁচ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিতে নেমে গেছে। এই দুটি পণ্য দিয়ে দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ হয় না। তবে চাল ও পেঁয়াজের দাম বাড়ার ফলে মানুষ কষ্ট পেয়েছে। উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়ার পক্ষেও মত দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
নানা বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে উন্নয়ন ঘটেছে, তাকে এক ‘বিস্ময়’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে তুলনা করে তিনটি খাতের উন্নয়নে ধাঁধা দেখছেন তিনি। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘এই যে দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবসহ নানা বাধা বিপত্তির পরও প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। মাথাপিছু জাতীয় আয় কম হওয়া সত্তে¡ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সামাজিক সূচকগুলোতে যেভাবে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে, তা এখনো ধাঁধা মনে হচ্ছে’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কম হওয়ার পরও কীভাবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে, সেটিকেও বিস্ময় হিসেবে দেখছেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তবে এত সীমাবদ্ধতার মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশের এমন উন্নতি ঘটেছে এমন রহস্য জানা নেই বলেও মন্তব্য তাঁর। সার্বিকভাবে এই উন্নয়নকে ধাঁধা হিসেবেই দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ‘রিবেজিং অ্যান্ড রিভিশন অব জিডিপিঃ বাংলাদেশ পার্সপেকটিভ’ শিরোনামের এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তাঁর মতে, গত কয়েকবছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং সাত শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু মোট জিডিপির অনুপাতে যে হারে বিনিয়োগ হচ্ছে, তাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এত হওয়ার কথা নয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গবেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকালে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) ঢুকেছে অনেক আগে। কিন্তু বিশাল এই কর্মক্ষম মানুষদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে না। এতে করে জনসংখ্যার বোনাসকাল এখন দুর্যোগে রূপ নিতে চলেছে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ ছাড়া কীভাবে এত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। দেশে নির্ভরশীলতার হার বেড়ে যাচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ। সেমিনারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য নিয়ে সমালোচনা করে কেউ কেউ বলেছেন, সরকারের এই সংস্থাটির তথ্য গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে। এজন্য তাদের সক্ষমতা বাড়ানো, সমন্বয় করা, জনবল বাড়ানো ও স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে সেমিনারে।
সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম, পরিকল্পনা বিভাগের সচিব জিয়াউল ইসলামসহ অন্যরা। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ও যুক্তরাজ্যের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এস আর ওসমানি।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, ‘দেশে অনেক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। গ্রামগঞ্জেও কলেজ দেখা যায়। তরুণ শিক্ষার্থীরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে চাকুরি পাচ্ছে না। আমার কাছে অনেকে চাকুরির জন্য আসে। কিন্তু তাদের জন্য কিছু করতে পারি না। তাতে দেখা গেছে, দেশে অনেক শিক্ষার্থী আছে, যারা পাশ করেও বেকার’। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতিবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে তথ্য দিচ্ছে, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জিডিপির সঙ্গে বিনিয়োগের কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাই না। রপ্তানি ও রেমিটেন্স প্রবাহেও তেমন গতি নেই। কাঁচামাল আমদানিও তেমন হচ্ছে না। তাহলে এত প্রবৃদ্ধি হয় কীভাবে?। তিনি বলেন, বিবিএস থেকে বলা হয় দেশে এখন বেকারের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা এত কম?। তাঁর মতে, বিবিএস থেকে যেসব পরিসংখ্যান আমাদেরকে দেওয়া হয়, তাতে অনেক অসঙ্গগতি চোখে পড়ে। সংস্থাটির এক শাখার সঙ্গে আরেক শাখার মধ্যে সমন্বয় নেই বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই উপদেষ্টা।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনের মতে, দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে। গ্রামগঞ্জে অনেকে কাজে ঢুকেছে। কিন্তু সেটা বিবিএসের জরিপে যোগ হয়নি। তবে দেশের কারিগরি শিক্ষায় কিছু দুর্বলতা আছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে কারিগরি শিক্ষায় পিপিপি ভিত্তিতে করা যেতে পারে। শিল্পায়নের মাধ্যমে জনসংখ্যার বোনাসকাল কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর বরকত ই খুদা বলেন, ‘বাংলাদেশ জনসংখ্যার বোনাসকালে ঢুকেছে অনেক আগে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ মাত্র একবার এই সুযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারছে না। এতে করে জনসংখ্যার বোনাসকাল এখন দুর্যোগে রূপ নিতে চলেছে। সরকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। বস্তির দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। পোশাক খাতে যারা কাজ করছে, তারা যে খুব ভালো আছে সেটা বলা যাবে না। তাদের মধ্যে যদি সঞ্চয়ের প্রবণতা বাড়ত, তাহলে ভালো থাকা বোঝা যেত। কিন্তু সেটা হচ্ছে না’।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৬ এই সময়ে দেশে কর্মসংস্থানের হার বাড়েনি। তবে এই সময়ে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর হার বেড়েছে। সরকার তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে পারছে না। দেশে বিভাগওয়ারি জিডিপি নিরূপন করার পরামর্শ দেন রুশিদান ইসলাম।
ড. মসিউর রহমান বলেন, বিবিএস ছোট প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। সেখানে পরিচালক পদে কোনো পরিসংখ্যান কর্মকর্তা যেতে পারে না। অন্য ক্যাডার থেকে পাঠানো হয়। পরিচালক পদে বিবিএসের নিজস্ব জনবল দেওয়ার জন্য আমি অনেক তদবির করেছি, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। পরিসংখ্যানের মান যদি উন্নয়ন করা না যায়, তাহলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। তাঁর মতে, বিবিএসের কাজের মান কমে গেছে। এর মান বাড়াতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিকল্পনা মন্ত্রী

৯ জানুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ