প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
“হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”। এটি হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক ফারসী শিলালিপির বাংলা অনুবাদ। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি (১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ)। ঐতিহ্যের স্মারক ও ধারক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে এ শিলালিপি স্থাপিত রয়েছে। গবেষকগণ জানান, প্রাচীন এই মসজিদের সব শিলালিপির সঙ্গে সিরিয়ার ‘রাক্কা নগর’ এর স্থাপত্যকলার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বর্তমানে শিলালিপিটি মূল মসজিদের একপ্রান্তে বসানো অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে। সেই সময়ে মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাই করা সাদা অক্ষরে লেখা ফারসী শিলালিপিটি বসানো হয়েছিল। শুধু স্থাপত্য নিদর্শনই নয় স্থাপত্য অনন্য শৈল্পিক দিক থেকেও মসজিদটি এ অঞ্চলের এক অনন্য পুরাকীর্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। ঐতিহাসিকদের মতে, এখানে চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক হিসেবে শিলালিপিভিত্তিক যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের শিলালিপি অন্যতম।
মোঘল শাসকের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। চট্টগ্রামের অনন্য এক ঐতিহাসিক স্থাপনা এ মসজিদ। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছরের পুরানো এ মসজিদ কালের সাক্ষী। আদি চট্টগ্রামের অস্তিত্ব ও নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী জড়িয়ে আছে এ আন্দরকিল্লার সঙ্গে। হাজার বছরের প্রাচীন রাজ্য আরাকান ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি সুবেদার শায়েস্তা খাঁর নির্দেশে তারই পুত্র বুজর্গ ওমেদ খাঁর নেতৃত্বে মোঘল বাহিনী চট্টগ্রাম অভিযান করেন। ওই সালে মোঘল যোদ্ধারা কর্ণফুলী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনার নিকটস্থ দেয়াং পাহাড় চাটিগাঁ (আরাকানের প্রশাসন) দুর্গ দখল করে এবং ওইদিনই ওমেদ খাঁ বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করে চট্টগ্রামকে বাংলার সাথে সংযুক্ত করেন। চট্টগ্রাম বিজয়ের প্রধান সেনাপতি বুজর্গ ওমেদ খাঁ আরাকানীদের তাড়িয়ে ওই সময় রামু পর্যন্ত দখল করেন। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মোঘল যোদ্ধারা রামু ত্যাগ করে শঙ্খ নদীর উত্তর পাড়ে চলে আসেন। এখানে দুই হাজার সৈনিকের সেনাপতি আদু খাঁ ও দুই হাজার সৈনিকের সেনাপতি লক্ষণ সিং শঙ্খ নদীর তীরে দুইটি সেনা দুর্গ স্থাপন করে। তখন ওই এলাকার নাম হয়ে যায় দোহাজারী। ওটাই ছিল চট্টগ্রামের প্রধান সেনানিবাস (মোঘল যুগের) যুদ্ধ বিজয়ীর স্মারক হিসেবে দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেব চট্টগ্রামের নতুন নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। তারই নির্দেশে চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক চিহ্ন হিসেবে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ নির্মাণ করেন।
কথিত আছে, ১৭২৩ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরেক শাসক নবাব ইয়াসিন খাঁ এ জামে মসজিদের কাছাকাছি পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটি টিলার উপর আরেকটি পাকা মসজিদ তৈরি করে তার নাম রাখেন ‘কদম রসুল’। তখন সাধারণ মানুষের কাছে এ মসজিদটিই বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। এতে এক সময়ে প্রায় লোকশূন্য হয়ে পড়ে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। এ অবস্থায় ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ মসজিদটিকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৮৮৫ সালে হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদটি মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য আবারও খুলে দেয়া হয়। ১৯২০ সালে প্রকাশিত চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্মনের লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস বইটিতে বলা হয়েছে, হামিদুল্লাহ খাঁ ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বড় জমিদার। ১৮৪২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামে শাসনকালে তিনি এ অঞ্চলের ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। কোরআন মজিদ একাডেমীর সৌজন্যে মসজিদে টাঙানো একটি ব্যানারে লেখা রয়েছে ১৭৬১ থেকে ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত ৯৪ বছর ব্রিটিশ সরকার মসজিদটিকে গোলাবারুদের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করে। জানা গেছে, বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় রয়েছে মসজিদটি। এ প্রসঙ্গে ব্যানারে উল্লেখ রয়েছে, চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদ অডিন্যান্স ১৯৮৬-এর অধীনে ২ দশমিক ৪২৭৬ একর জায়গাসহ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি পরিচালনা করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
মোঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি হয়েছে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের আদলে তৈরি। আর সেই একই রীতিতে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে এই মসজিদটি নির্মিত হয় বলে একে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়ে থাকে। মসজিদের নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে জানা যায়, সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে ছোট একটি পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ। প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ গজ (৬.৯ মিটার)। প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মধ্যখানের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৬৬৭ সালে এ মসজিদ নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে মসজিদটি তীর্থস্থান হয়ে উঠে। আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ইমাম বা খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসূলগণ। তখন রোজা, ফিতরা এবং ঈদের চাঁদ দেখার প্রশ্নে এ মসজিদের ফয়সালা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ মেনে চলতেন। এ জামে মসজিদে প্রতি জুমার দিনে চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিরা এসে নামাজ আদায় করতেন। পবিত্র মাহে রমজানের শেষ জুমায় কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেও মানুষের সমাগমের নজির রয়েছে।
শাহী জামে মসজিদ সূত্রে জানা যায়, এ মসজিদে প্রতিদিন দুই হাজার মুসল্লি নামাজ পড়েন। প্রতি শুক্রবার ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ নামাজ পড়েন। রমজানে এ সংখ্যা বেড়ে যায়। বিদাতুল জুমায় ২০ হাজার মানুষ হয়। রমজানে বিশাল আকারে ইফতারির আয়োজন করা হয়। তখন এখানে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মানুষের ইফতারির ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে এ মসজিদে ৩ জন ইমাম, ২ জন মুয়াজ্জিন ও ৬ জন খাদেম রয়েছেন। এদিকে ঐতিহাসিক এ মসজিদটির উন্নয়নে এখনো হাত দেয়া হয়নি। মুসল্লিরা জানান, বর্ষাকালে মূল ভবনের ছাদ চুষে পানি পড়ে। ইফা সূত্রে জানা যায়, কুয়েতের অর্থায়নে দেড়শ’ কোটি টাকায় মসজিদটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও নানা জটিলতায় উন্নয়ন কাজ থমকে আছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক ইতিহাস গবেষক জামাল উদ্দিন বলেন, মোঘল শাসক কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক চিহ্ন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা মার্কেটের কারণে ঐতিহাসিক মসজিদটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। এটি যে ঐতিহাসিক মসজিদ মুসল্লি ছাড়া কেউই তা জানে না। অথচ একদা পৃথিবীর নানা দেশ থেকে মুসলিম ও অমুসলিম পর্যটকগণ আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ পরিদর্শন করে মুগ্ধ হতেন। এছাড়া মসজিদ পরিচালনায় রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।