মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
ইনকিলাব ডেস্ক : ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৪ সালে প্রথম নির্মিত ড্যাম উদ্বোধনের সময় একে আধুনিক ভারতের মন্দির হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আধুনিক ভারতের রূপকার নেহরুর মনে স্পষ্ট ধারণা ছিল, নতুন এই দেশকে কোন্ দিকে নিতে হবে। বিভক্তি এবং এরপর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যকার রক্তাক্ত সংঘাতের তিক্ত স্মৃতি পেছনে ফেলে নেহরু চেয়েছিলেন ভারতকে সেক্যুলার (ধর্মনিরপেক্ষপতা) পথে পরিচালিত করতে। আর সে কারণেই তিনি ধর্মকে রাজনীতির বাইরে রেখেছিলেন। তাই গুজরাটের সোমনাথে প্রাচীন ভারতীয় একটি মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্নে তার মন্ত্রিসভায় বিল উত্থাপিত (১৯৫১ সালে) হলেও অর্থ ছাড় দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই ভারতে এই আদর্শটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে। আধুনিক ভারতের প্রতীক হিসেবে ড্যাম আর বিবেচিত হচ্ছে না। গণতন্ত্র এখন মন্দির আর হিন্দুধর্মের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। নতুন শাসকরা এখন জাতি গঠনে তার অবদানকে খারিজ করে দিচ্ছেন। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের ক্ষমতায় আসার পর স্বাধীন ভারতে দুটি মিথ ভেঙেছে-একটি হলো, কোনো বিভক্তসূচক ব্যক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না এবং দ্বিতীয়টি হলো কোনো উগ্র হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এই বহু ধর্মবিশিষ্ট দেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে না। ফলে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ভারতের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে অভিহিত করা যায়। প্রথমবারের মতো ভারত স্পষ্টভাবে বিভক্তসূচক নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছে। নরেন্দ্র মোদি এমন নেতা, যিনি সেক্যুলার হওয়ার ভান করেন না। এর ওপর প্রথমবারের মতো ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে (লোকসভা) সংখ্যালঘুদের একজন সদস্যকে না নিয়েও সংখ্যাগরিতা পেয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার শাসন ভারতে এখন আর ওঁৎ পেতে থাকা বিপদ নয়, বরং বাস্তবতা। মোদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে ভোট চেয়েছিলেন। আর আগে কংগ্রেসের দুর্নীতি এবং অর্থনৈতিক ভ্রান্তিতে অসুস্থ ও ক্লান্ত হয়ে পড়া বিপুল সংখ্যাগরি মানুষ মোদির বিভাজনসূচক এজেন্ডা সম্পর্কে সংশয়কে পাশে ফেলে রেখে তাকে এবং তার কথায় বিশ্বাস করে বিপুলভাবে তাকে ভোট দিয়েছিল। অবশ্য সংশয়বাদীদের কথাই সত্যি হয়েছে। আশঙ্কা অনুযায়ী বিজেপির এজেন্ডা অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল না, ছিল ভারতকে একটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত করা। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগী আদিত্যনাথকে নিয়োগ করার মাধ্যমে মোদি আবারও তার সমালোচকদের কথা সঠিক বলে প্রমাণ করেছেন। যুক্তরাজ্যের সমান আকারের এবং ২০ কোটির বেশি জনসংখ্যা-সংবলিত ভারতের বৃহত্তম রাজ্যটির প্রধান হিসেবে তাকে নিয়োগ ছিল নেহরুবাদ এবং সেক্যুলার ভারতের কফিনে আরেকটি পেরেক ঠোকা। মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মের বিরুদ্ধে অন্ধ পক্ষপাতিত্ব থাকা এক ধর্মীয় ব্যক্তির এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়াটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধের শামিল। ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ থাকার নীতির প্রতি এটি একটি বড় ধরনের আঘাত। ভারত যখন স্বাধীনতার সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন ১৯১৫ সালে কিছু হিন্দু একত্রিত হয়ে কেশব বিলারাম হেগেওয়ারের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) গঠন করে। এই লোকটি বিশ্বাস করতেন, ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তি হওয়া উচিত হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। হিন্দু স¤প্রদায়ের মধ্যে সংগঠনটি ফ্যাসিবাদী আদলে সংগঠিত হতে থাকে। ওই সময় জার্মানিতে হিটলার এবং ইতালিতে মুসলিনির উত্থান দেখা গিয়েছিল। এসব হিন্দু কিন্তু কখনো স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, বরং ব্রিটিশদের আনুকূল্য চেয়ে গেছে। আরএসএস সব সময় কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির বিরোধিতা করত এবং মুসলমানদের অধিকারের কথা বলায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা করত। আরএসএসের প্রভাবেই উগ্র হিন্দু এক লোক গান্ধীকে হত্যা করে। গান্ধী নিহত হওয়ার পর সংগঠনটি নিষিদ্ধ করেন নেহরু। আরেকটি দল ভারতীয় জনসংঘ (বিজেএস)। দলটি গঠিত হয় ১৯৫১ সালে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে। তারাও ছিল উগ্র হিন্দুবাদী। ১৯৫২ সালের নির্বাচনে তারা মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল। তবে তাদের বড় অর্জন ছিল ১৯৭৭ সালে। তারা প্রথম অ-কংগ্রেসীয় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। মন্ত্রী হয়েছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি এবং লালকৃষ্ণ আদভানি। তবে জোটটি টিকে থাকতে পারেনি। তারা প্রান্তিক গ্রæপ হিসেবেই থেকে যায়। ১৯৮০ সালে বিজেএস পরিণত হয় বিজেপিতে। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি মাত্র দুটি আসন পায়। এতে তাদের প্রান্তিকতার বিষয়টিই ফুটে ওঠে। তবে ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভিপি সিংয়ের নেতৃত্বে জনতা দলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে নির্বাচন করে কংগ্রেসকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। অবশ্য জোটটি দুই বছরের মধ্যেই ভেঙে যায়। ১৯৮০-এর দশকে হিন্দু সংখ্যাগরি দলে পরিণত হয় বিজেপি। তারপর লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে রামমন্দির আন্দোলনের মাধ্যমে তারা ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালে সম্রাট বাবরের নামে থাকা মসজিদটি তারা গুঁড়িয়ে দেয়। তারপর ১৯৯৮ সালে প্রথম দিল্লির ক্ষমতা কবজা করে বিজেপি। ২০০৪ সালে তারা আবার ক্ষমতা হারায় কংগ্রেসের কাছে। ক্ষমতায় আসার জন্য হিন্দু দলটি (বিজেপি) সব সময়ই সংখ্যাগরি হিন্দু স¤প্রদায়ের ক্রোধ ও উদ্বেগকে ব্যবহার করেছে। মুসলমানরা ক্ষমতায় আসতে পারে, এমন একটি ভীতি তারা সৃষ্টি করে। তাদের একটি প্রিয় থিম হলো পাকিস্তানবিরোধী প্রপাগান্ডা। মোদি গুজরাটে এই অস্ত্র ব্যবহার করেই ২০০১ সাল থেকে ক্ষমতায় থেকেছেন। এরপর ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তিনি ওই খেলাই খেলে যাচ্ছেন। অবশ্য তিনি ভারতে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে চাইছেন, দেশে তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি ভারতকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম। ভারতের একশ্রেণীর মিডিয়া ও নাগরিক তার কাজকে সহজ করে দিচ্ছে। সংখ্যাগরিবাদের শাসনের ফলে কী হয়, তার উদাহরণ হলো পাকিস্তান। জিন্নাহ চেয়েছিলেন, সব ধর্মের লোকজনকে সমান অধিকার দিতে। কিন্তু পরের শাসকরা তা থেকে সরে এসেছিলেন। পরিণতিতে তারা মৌলবাদী শক্তির কাছে হেরে গেছে। নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারতও একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেœষক এরই মধ্যে ভারতকে ডাকছেন হিন্দু পাকিস্তান হিসেবে। আদিত্যনাথ তো বলেই দিয়েছেন, হিন্দুত্ববাদ আর উন্নয়ন একই জিনিস। যারা হিন্দুত্ববাদের বিরোধী, তারা উন্নয়নের বিরোধী। যারা হিন্দুত্ববাদের বিরোধী, তারা জাতির বিরুদ্ধে। একটি অন্যতম শঙ্কা সৃষ্টি করেছে সরকারি সংস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিানগুলোর গেরুয়াকরণ বা হিন্দুয়ানিকরণে। কট্টর হিন্দুপন্থিরা এখন ইতিহাস লিখছেন। তাদের লক্ষ্য হলো-ভারতকে ঐতিহাসিকভাবে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং প্রমাণ করা মুসলমানরা বিদেশি। হিন্দু গোঁড়ামির প্রতি চ্যালেঞ্জকারী উদার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষভাবে টার্গেট হচ্ছে। সৌদি আরবের মতো বদ্ধ ও রক্ষণশীল দেশ যেখানে নিজেকে উন্মুক্ত করছে, সংস্কারের পথে যাচ্ছে, সেখানে ভারত যাচ্ছে বিপরীত দিকে। এখন প্রশ্ন হলো ভারত কি সত্যিই হিন্দু পাকিস্তান হতে যাচ্ছে? মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৩১ ভাগ ভোট। দেশের বিপুল সংখ্যাগরি মানুষ কিন্তু বিজেপির শাসনকে এখনো বরণ করতে প্রস্তুত নয়। বরং বিজেপিবিরোধীদের মধ্যে বিভক্তিই হিন্দুত্ববাদীদের সুবিধা করে দিচ্ছে। উদার ও সেক্যুলার অংশ এখনো সমাজে শেকড় গেড়ে আছে, তারা এখনো শ্রদ্ধা পেয়ে আসছেন। তরুণরা মোদিকে বেছে নিয়েছিল তার উন্নয়নের কথা শুনে। কিন্তু তার বেশির ভাগ প্রকল্পই নতুন প্রজন্ম সমর্থন করছে না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজেপির যুব শাখার পরাজয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে, ভারতের তরুণরা উদারবাদ ও সেক্যুলারবাদের পক্ষে। এখন কংগ্রেসের সাফল্যের ওপরই নির্ভর করছে বিজেপির এই অগ্রযাত্রা রোখা। ভারত এখন পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্র কি সংখ্যাগরিতাবাদের দেশে পরিণত হবে? এখনো তা বলার সময় আসেনি। তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রবণতা কেবল ভারতের স্থিতিশীলতার জন্যই নয়, পুরো অঞ্চলের জন্যই হুমকি। সাউথ এশিয়ান মনিটর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।