হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
পশ্চিম পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেয়া বর্বরতা থেকে বাঁচার জন্যই আজকের স্বাধীনতা। বহু আকাক্সিক্ষত আমাদের এই স্বাধীনতা, যার প্রয়োজন ছিল নিজস্ব স্বত্ত্বাকে রক্ষা করার জন্য। ১৯৭০ সালে জনতার আশাআকাক্সক্ষার প্রতিফলন অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল যদি জেনারেল ইয়াহিয়া খান মেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তানের সরকার পরিচালনার ভার ছেড়ে দিতো তবে এতো মানুষের জীবন ও মা-বোনদের নির্যাতনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হতো না।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন হওয়ার পূর্বে তৎকালীন মেজর জিয়া নিজে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ‘ডব জবাড়ষঃ’ ঘোষণার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার (১) সামাজিক সমতা (ঊয়ঁধষরঃু), (২) মানব সমমর্যাদা (ঐঁসবহ উরমহধঃু), (৩) সামাজিক সুবিচার (ঝড়পরধষ ঔঁংঃরপব), এই তিনটি মূলনীতিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয় এবং বিজয়ের এক বছরের মাথায় যখন সংবিধান রচিত হয় তখন বাস্তব অর্থে কোন বিরোধী দল ছিল না।
বাংলাদেশের সংবিধান ইতোমধ্যে ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধানকে সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিত করার ক্ষমতা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে প্রদান করা হয়েছে। ‘সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন’ ২০১১ (২০১১ সনের ১৪নং আইন) বলে ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছে যা নিন্মরূপ:
‘(ক) সংসদের আইন-দ্বারা এই সংবিধানের কোন বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হইতে পারিবে:
(অ) অনুরূপ সংশোধনীর জন্য আনীত কোন বিলের সম্পূর্ণ শিরনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হইবে বলিয়া স্পষ্টরূপে উল্লেখ না থাকিলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাইবে না;
(আ) সংসদের মোট সদস্য-সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হইলে অনুরূপ কোন বিলে সম্মতিদানের জন্য তাহা রাষ্ট্রপতির নিকট উপস্থাপিত হইবে না;
(খ) উপরি-উক্ত উপায়ে কোন বিল গৃহীত হইবার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট তাহা উপস্থাপিত হইলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিবেন, এবং তিনি তাহা করিতে অসমর্থ হইলে উক্ত মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’
জনগণের প্রয়োজনে সংবিধান, সংবিধানের প্রয়োজনে জনগণ নয়। আওয়ামী লীগ, জামায়াত, বামদল সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা আন্দোলন করার ফলশ্রæতিতে ‘সংবিধান (ত্রোয়দশ সংশোধন) আইন’ ১৯৯৬ (১৯৯৬ সনের ১নং আইন) এর ৩ ধারা বলে গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য সংবিধানের ২ক পরিচ্ছেদে ৫৮খ ধারায় নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংযোজিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সংবিধান থেকে উক্ত ধারা রদ ও রহিত করার ফলে ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার বিধান পুনঃজীবিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকার সংবিধানে সংযোজন করার জন্য আন্দোলন করেছে এবং দুঃখ ও লজ্জাজনক এই যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি রদ ও রহিত করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি সংবিধানে সংযোজিত করে নিজেদের ক্ষমতায় থাকার অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে এখন বলছে যে, ‘সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে। সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণও নড়া যাবে না।’ যারা সংবিধান বোঝে না বা সংবিধান সম্পর্কে পড়াশুনা নেই তারাও বক্তৃতার মঞ্চে ‘সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন হবে’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। এসব কথা জনগণের সাথে প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে।
সরকার ও সরকারি ঘরনার বুব্ধিজীবীরা বলে বেড়াচ্ছেন, তাদের ক্ষমতায় আসতেই হবে নতুবা পিঠের চামড়া থাকবে না, রোহিঙ্গা হয়ে যেতে হবে, দেশ পাকিস্তান হয়ে যাবে ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বদ্ধ পরিকর। এমতাবস্থায়, জনগণের আশাআকাক্সক্ষার প্রতিফলন যে নির্বাচনে ঘটবে তারা (সরকারি দল) অবশ্য তা চাইবে না সংগত কারণেই। এ দেশের নির্বাচনে আমলা তথা ডিসি, এসপি এবং ওসি তথা পুলিশের একটি ব্যাপক প্রভাব রয়েছে, যারা সব সময়ই সরকারি দলের তাবেদারিতে ব্যস্ত। এই তাবেদারদের কারণেই জনগণ নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী করেছিল। আমলাদের কারসাজির কারণেই আওয়াজ উঠেছিল যে, ‘আমার ভোট আমি দিবো, যাকে খুশী তাকে দেবো।’
সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে দায়িত্ব দেয়ার জন্য বিরোধী জোটের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে, সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেয়ার কোন বিধান সংবিধানে নেই। ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১০, ১১ এবং ১২ মোতাবেক, তিন ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট বিদ্যমান রয়েছে। ধারা ১০ মোতাবেক নির্বাহী, ম্যাজিস্ট্রেট (ঊীবপধঃরাব গধমরংঃৎধঃব), ধারা-১১ মোতাবেক বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট (ঔঁফরপরধষ গধমরংঃৎধঃব) এবং ধারা ১২ মোতাবেক বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট (ঝঢ়বপরধষ গধমরংঃৎধঃব) রয়েছে এবং সরকার সহকারী পুলিশ সুপারের নিন্মে নয় এমন কোন পুলিশ কর্মকর্তাকেও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। পুলিশের মত সেনাবাহিনীও একটি উবপরঢ়ষরহধৎু ঋড়ৎপব. সেনাবাহিনীকে দিয়ে যদি যানজট নিরসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় তবে জাতীয় নির্বাচনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না দিয়ে সাক্ষী গোপলের মতো দাঁড় (ঝঃৎরশরহম ঋড়ৎপব) করিয়ে তাদের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করার প্রয়োজন কী? ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছাড়া সেনাবাহিনী কোন বিষয়ে প্রতিকার বা প্রতিরোধ করতে পারবে না বরং দর্শকের ভ‚মিকাই পালন করতে হবে।
দেশটি দুই বার (১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সাল) স্বাধীন হলেও আমলাতন্ত্রের মনোভাব ঔপনেবেশিক রয়ে গেছে। স্বাধীন স্বত্ত¡া নিয়ে তারা কোন কাজ করতে পারে না। স্বায়ত্বশাসিত বা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও তারা ‘আদর্শে’ নয় বরং ‘আদেশে’ কাজ করে। ‘বিবেক’ নয় ‘নির্দেশ’ পালন করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে করে। ফলে নির্বাচনী মাঠেও দলীয় সরকারের সেবাদাস হিসেবে আমলারা নির্দেশ পালন করবে। ফলে তাদের (আমলাদের) নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না, অতিত অভিজ্ঞতা তাই বলে।
‘সংবিধান থেকে এক চুল পরিমাণও সড়া যাবে না’, এমন বক্তব্য আইয়ুব, ইয়াহিয়া ও এরশাদের মতো জেনারেলদের মুখে মানুষ বহুবার শুনেছে, এখন শুনছে গণতন্ত্রের নিশান বরদারদের কাছ থেকে। পৃথিবীতে অনেক রাষ্ট্র রয়েছে যাদের কোন লিখিত সংবিধান নেই। গণতন্ত্র প্রথমে গ্রিক ও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে। সে দেশের জনগণের মতামতের প্রতিফলনই সংবিধান। জনগণের প্রয়োজন মিটানোর জন্য আমাদের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সংবিধান একটি ‘প্রতিশ্রæতি’ যা সংশোধনযোগ্য।
সংবিধানিক যত প্রতিষ্ঠান যথা: বিচার বিভাগ, দুদক, নির্বাচন কমিশন, এ জাতীয় সকল প্রতিষ্ঠানই ‘স্বাধীন’(!) যাদের স্বাধীনতা কচুপাতার পানির মতো। মিডিয়া স্বাধীন, তবে যতটুকু স্বাধীনতা কর্তৃপক্ষ প্রদান করে ততটুকুই। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী একই স্থানে জনসভা করেছেন। কিন্তু মিডিয়া বিএনপি’র জনসভা ‘লাইভ’ দেখাতে পারেনি যতটুকু করেছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ক্ষেত্রে। এভাবেই গণতন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। সরকারি দলের জনসভা হয়েছে সরকারি বেষ্টনীর মধ্যে, অন্যদিকে বাসসহ যোগাযোগের সকল ব্যবস্থা বন্ধ করে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করেও বিএনপির জনসভা স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। এখানেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের আবশ্যকতা। দেশকে পরিচালনার আস্থাশীল একটি সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন, যা প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক অঙ্গনে দলীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না।
এমপি’রা এমপি পদে অধিষ্ঠিত থেকে এমপি’র ক্ষমতা ও মর্যাদা সাথে নিয়েই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে। অথচ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান যেমন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে স্বপদ থেকে পদত্যাগ করেই নমিনেশন পেপার জমা দিতে হয়। একই দেশে দু’ধরনের আইন প্রয়োগ করে সরকারের সংবিধান রক্ষার দোহাই ধোপে টিকবে কী?
জনগণের আশাআকাক্সক্ষার প্রতিফলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য ‘সংবিধানের’ দোহাই দেয়া হয় শুধুমাত্র জনগণকে ধোকা দেয়ার জন্য। শাসকদল যদি গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় তবে তাদের অবশ্যই জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সে ধরনের কথাই বলতে হবে যা জনগণ আস্থায় নেবে। রোহিঙ্গাদের রিলিফ বিতরণে যাওয়া ও ফেরার পথে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গাড়ির বহরে হামলার বিষয়ে সরকারি দল বিএনপি’কে দায়ী করে যে বক্তব্য দিয়েছিল সে বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক আওয়ামী লীগ নেতাই বলেছেন যে, সরকারি দলের এহেন বক্তব্য জনগণ ‘খায়’ না। অনুরূপভাবে বলতে হয় যে, প্রতিটি বিষয়ে সরকারি ভাষ্য এমনই হওয়া উচিৎ যা জনগণ ‘খায়’। নতুবা জনগণের নিকট যাই পরিবেশন করা হোক না কেন বদহজমে তা বমিটিং হবে। জনগণকে বেতোয়াক্কা করে অনেকেই খেসারত দিয়েছেন, ইতিহাসে যার সাক্ষ্যের অভাব নেই।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।