বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
মুন্শী আবদুল মাননান
এক.
দুই দশকের বেশি সময় আগে, সন-তারিখ মনে নেই এ মুহূর্তে। একদিন সহকর্মী ইউসুফ ভাই (ইউসুফ শরীফ, সাংবাদিক, কথাশিল্পী) বললেন, ফুলতলী যাবেন? হঠাৎ তার এ প্রস্তাবে কিছুটা হতচকিত হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কেন, কোনো উপলক্ষ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, উপলক্ষ একটা আছে। কী সেই উপলক্ষ, জানতে চাইলে ইউসুফ ভাই বললেন, ‘ছাহেব কিবলাহ’র প্রতিষ্ঠিত ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া’ বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে কয়েকদিনের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। আপনি গেলে আপনাকে অন্তত দুটি বিষয়ে বক্তৃতা দিতে হবে। কোনো কিছু না ভেবেই তার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
সিলেটের প্রান্তিক থানা জকিগঞ্জের বিখ্যাত ফুলতলী গ্রাম, সেই গ্রামের বিখ্যাত ‘ছাহেব বাড়ি’ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি অনেকের মুখে। সবচেয়ে বেশি শুনেছি যার কথা তিনি হলেন, হজরত আল্লামা মো. আবদুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.)। তিনি ‘ফুলতলীর পীর ছাহেব’, ‘ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী’ কিংবা শুধুই ‘ছাহেব কিবলাহ’ নামে সাধারণ্যে খ্যাত ও পরিচিত। তিনি প্রচলিত অর্থে পীর নন, তার চেয়েও অধিক। এক ব্যতিক্রমী আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, মানবমুক্তির অনন্য সাধারণ দিশারী, মানবসেবা ও মানব কল্যাণে বিরল নজির সৃষ্টিকারী এক মহাপুরুষ। তার কথা, তার প্রশংসা এত মানুষের কাছে শুনেছি যে, তাকে এক নজর দেখার, কিছুটা সান্নিধ্য লাভ করার প্রবল আকাক্সক্ষা মনের মধ্যে লালন করতাম। ইউসুফ ভাইয়ের প্রস্তাব ও আমন্ত্রণ সে আকাক্সক্ষা পূরণ সহজ ও সম্ভব করে দেবে, এই চিন্তা থেকেই রাজি হওয়া। জিজ্ঞেস করলাম, আর কে কে যাবেন? ইউসুফ ভাই বললেন, আমি, আপনি আর হারিস ভাই (হারিস উদ্দিন, খ্যাতিমান ফটো সাংবাদিক)।
নির্দিষ্ট দিনে দুপুরের পরপরই আমরা ফুলতলী পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে ট্রেনে সিলেট। সিলেট থেকে ফুলতলী। সিলেট গিয়েই আমরা হাওলা হয়ে গিয়েছিলাম ছাহেব কিবলাহর ছোট ছেলে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীর। তাদের পারিবারিক গাড়িতে তিনিই পথ প্রদর্শক। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি। যখন ছাহেব বাড়িতে পৌঁছলাম, দেখলাম ইলাহী কা-। চারদিকে গিজ গিজ করছে মানুষ। মনে হলো, যেন কোনো উৎসব। একটি কামরায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো, যা আগেই আমাদের থাকার জন্য ঠিক করা ছিল। আমরা তিনজনই কামরায় ঢুকে কিছুক্ষণ যে যার মতো বসে যখন কাপড় বদলানোর আয়োজন করছি, ঠিক তখনই কামরায় প্রবেশ করলেন এক সৌম্যদর্শন, আলোকস্তম্ভস্বরূপ বর্ষীয়ান পুরুষ। ইউসুফ ভাই ‘ছাহেব কিবলাহ’ বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। তিনি আমাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, বললেন, বাবারা, আপনাদের অনেক কষ্ট হয়েছে। এখন খাওয়া-দাওয়া করুন, বিশ্রাম নিন। আমি বিশেষ প্রয়োজনে এখন সিলেট যাচ্ছি, তাই বলতে এলাম। ফিরে এলে কথাবার্তা হবে।
শুরুতেই এক বড় রকমের ধাক্কা খেলাম। প্রথমত, এমন সুপুরুষ, সৌন্দর্যবান পুরুষ, নূরানী পুরুষ, এমন মনোহর, দৃষ্টি আকর্ষণকারী, মুগ্ধকর মানুষ এর আগে চোখে পড়েনি। যেন চোখ জুড়িয়ে গেল! দ্বিতীয়ত, তার কাছে আমরা কিছুই নই। তার কাছেই আমাদের আগে যাওয়ার কথা। অথচ সে সুযোগ না দিয়েই তিনি এলেন আমাদের কাছে। এ রকম মহানুভব, মেহমাননেওয়াজ, সদাচারী মানুষ দুর্লভ বললেও কম বলা হয়। তিনি চলে গেলেন। আমরা তিনজন কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে থাকলাম। আমাদের ভেতরে তখন চলছে তোলপাড়। প্রকৃতিস্থ হতে লেগে গেলো আরো কিছু সময়। এর পর অবশ্যই আমাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে গেল ছাহেব কিবলাহ।
রাতেই আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, ছাহেব কিবলাহর সঙ্গে আমরা কিছুটা সময় একান্তে কাটাবো। তার কথা তার মুখে শুনবো। তিনি তার জীবনস্মৃতির পাতা উল্টাবেন, আমরা দেখবো। হারিস ভাই তুলবেন ছবি। সেই মতে, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার অনুষ্ঠানসূচির ফাঁকে এক সকালে তার সান্নিধ্যে উপনীত হলাম। তার কাছে শুনতে চাইলাম তার জীবনের কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ। তার বিশাল জীবন, বর্ণাঢ্য জীবন, সংগ্রামী জীবন, কোথা থেকে কী বলবেন তিনি? আমাদের অনুরোধ ফেললেন না। তার শিক্ষা জীবনের কিছু ঘটনা বর্ণনা করলেন। বললেন : তিনি তখন তার উস্তাদ ও মুরশিদ হজরত মাওলানা আবু ইউসুফ শাহ মোহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরীর তত্ত্বাবধানে বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা শেষ করেছেন। কি করবেন ভাবছেন। এমন সময় করিমগঞ্জে তার এক সম্পর্কিত ভাই তাকে যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দিলেন। তিনি সে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং ব্যবসা শুরু করলেন। বিভিন্ন ব্রিটিশ কোম্পানির পণ্যের হোলসেলের ব্যবসা কিছু দিনের মধ্যেই জমে উঠলো। লাভও বেশ ভালোই হতে লাগলো। কয়েক মাসেই একেকজনের ভাগে কয়েক হাজার টাকা লাভ হয়ে গেলো। একদিন হজরত বদরপুরী ছাহেব তাকে তলব করে বললেন, ব্যবসা তোমার কাজ নয়। তোমার অন্য কাজ আছে। তোমাকে আরও লেখাপড়া করতে হবে, উচ্চ শিক্ষা নিতে হবে। রামপুরে যাও। মুরশিদের নির্দেশ যথা আজ্ঞা করে ব্যবসা ছেড়ে দিলেন তিনি। এমনকি লাভের ভাগও নিলেন না। প্রস্তুতি নিলেন রামপুর যাওয়ার।
তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রামপুরের মাদরাসায়ে আলিয়ায় ভর্তির জন্য যাবেন তিনি। সবকিছুই তার অজানা-অচেনা। শুনেছিলেন, ওই মাদরাসায় সিলেটের একজন ছাত্র পড়েন। ভাবলেন, তার কাছেই প্রথমে যাবেন। ভর্তি ও ছাত্রাবাসে থাকার ব্যাপারে তার সহায়তা নেবেন। মাদরাসায় পৌঁছে তার দেখা পেলেন বটে, তবে ছাত্রাবাসে থাকার ব্যাপারে তিনি কোনো সহায়তা করতে পারলেন না। কি করবেন, কোথায় থাকবেন, এই ভাবনায় তখন তিনি কিছুটা বিচলিত। সিদ্ধান্ত নিলেন আশপাশের মহল্লায় কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া গেলে নেবেন। বাসা খুঁজতে শুরু করলেন। এমন সময় এক মহল্লার মসজিদে মাগরিবের আজান হলো। তিনি নামাজ পড়তে গেলেন। গিয়ে দেখলেন ইমাম সাহেব কি কারণে যেন অনুপস্থিত। একজন বয়স্ক মুসল্লি এগিয়ে এসে তাকেই ইমামতি করতে বললেন। তিনি নামাজ পড়ালেন। নামাজ শেষে যখন বেরিয়ে আসছেন তখন সেই মুসল্লি এগিয়ে এসে তার খোঁজ-পরিচয় নিলেন। তখন তার কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি। বাসা ভাড়া পাওয়ার ব্যাপারে তার সহায়তা চাইলেন। ভদ্রলোক বললেন, তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনি আমার বাসাতেই থাকবেন। আমার সন্তানদের কোরআন শিক্ষা দেবেন। আপনার কোরআন পাঠ আমাকে মুগ্ধ করেছে। ভদ্রলোকের এ অনুরোধ তিনি এড়াতে পারলেন না। সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য তার অর্থের অভাব ছিল না। তার ম্যানেজারকে তিনি বাড়িতে থাকতেই বলে গিয়েছিলেন প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠাতে।
যথারীতি তিনি তার বাসায় গিয়ে উঠলেন। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। তিনি ভর্তি হলেন। কিছুদিনের মধ্যে বাড়তি কিছু আয়ের ব্যবস্থাও হয়ে গেল। মহল্লায় বিভিন্ন বয়সী আরও কিছু ছাত্র তিনি পেয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের সম্মানীও পেতে থাকলেন। তিনি বললেন : বাড়ি থেকে ম্যানেজারের পাঠানো টাকা এবং ছাত্রদের কাছ থেকে পাওয়া সম্মানীর টাকা খরচের জায়গা না থাকায় জমতে থাকলো। কি করবেন এই টাকা দিয়ে? খরচের পথও বের করলেন। মাদরাসার ছাত্রদের মধ্যে যাদের অভাব ছিল, কেতাবাদি কেনার সঙ্গতি-সামর্থ্য ছিল না তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে থাকলেন।
এ পর্যন্ত বলার পর ছাহেব কিবলাহ কিছুটা আত্মমগ্ন হয়ে পড়লেন। এই সুযোগে হারিস ভাই তার ছবি তোলার উদ্যোগ নিলেন। তার কাছে তখন দুটি ক্যামেরা। একটি দামি, উন্নতমানের। অন্যটি কম দামি, সাধারণ। দামি ক্যামেরাটি দিয়ে ছবি তুলতে গেলেন, তুলতে পারলেন না। ফের চেষ্টা করলেন, কিছুই হলো না। দ্বিতীয়টি দিয়ে তুলতে গেলেন, দেখলেন সেটিও বিকল। শত চেষ্টা করেও বিখ্যাত এই ফটো সাংবাদিক তার প্রিয় ক্যামেরা দুটি দিয়ে একটি ছবিও তুলতে পারলেন না। আমরা বিস্মিত ও হতবাক। তখন অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, ছাহেব কিবলাহর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাওয়ার আর সম্ভব হলো না। তিনিও ভক্ত, অনুরাগী, দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা অন্য কোনো জরুরি কাজের জন্য বললেন, এখন থাক। আমরাও আর কিছু বললাম না। ফিরে এলাম আমাদের নির্ধারিত কামরায়। হারিস ভাই ক্যামেরা দুটির ব্যাপারে যারপরনাই বিরক্ত। বারবার ঝাকাঝাকি করছেন, কেন এমন হলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ দেখা গেলো, ক্যামেরা দুটি সচল হয়ে গেছে। কোথাও কোনো ত্রুটি নেই। আগের মতোই ছবি উঠছে। হারিস ভাই ও আমাদের তখন বিস্ময়ের অবধি নেই। ঘটনা শুনে মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী শুধু বললেন, ছাহেব কিবলাহ ছবি তোলা পছন্দ করেন না।
ছাহেব কিবলাহর ব্যস্ততা এবং আমরা যে কাজের জন্য গিয়েছিলাম সে কাজে সময় দেয়ার কারণে তার সঙ্গে আর ওই ‘বৈঠকী আলোচনা’ করার সুযোগ হয় না। এ আফসোস এখনো রয়েছে। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরে আসার পর আর কখনো তার নিকট সান্নিধ্য উপভোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ঢাকায় এলে মাঝেমধ্যে দেখা হয়েছে। তবে একান্তে কথা বলার কোনো সুযোগ হয়নি। এত মানুষ তার পাশে সবসময় ভীড় করে থাকতো যে, তাকে একা পাওয়া সম্ভব হতো না। বহুবার ফুলতলী যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছে। নানা কারণে সে ইচ্ছাও পূরণ হয়নি। এরপর তিনি তো চলেই গেলেন। এখনো তিনি স্মৃতিতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন। তাকে একবার যিনি দেখেছেন, তার পক্ষে কি তাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব? এখনো মাঝে-মধ্যে তার অবয়ব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রফেসর মাওলানা সালাহ উদ্দীন তার সম্পর্কে লিখেছেন : ‘তার চেহারা মুবারকে এত নূর ছিল যে, দেখে স্বাদ মিটতো না। আর সবুজ পাগড়ী যখন পরতেন, যেন আরও ভালো লাগতো। তিনি এমনিতেই ছিলেন নূরানী মানুষ, পাগড়ী পরলে আরো সুন্দর লাগতো। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। মনে হতো, দেখি আরো দেখি।’ কবি আল মাহমুদ তার এক কবিতায় বলেছেন :
‘আজকাল এসব মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যায় না
কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই আমি
সেই পবিত্র মুখছবি দেখতে পায়।’
দুই
বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাণের সংগঠন, বাংলাদেশের পেশাজীবীদের সর্ববৃহৎ সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অবিসংবাদী নেতা, সভাপতি এবং দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.)-এর সঙ্গে ছাহেব কিবলাহর অকৃত্রিম সখ্য ছিল। উত্তরাধিকারগত মিলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তারা ছিলেন পরস্পরের সাথী। আধ্যাত্মিক ও কর্মগত সূত্র ধরেই তাদের দুই পরিবারের মধ্যে মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তাদের অবর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের অন্যতম উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক ছাহেব কিবলাহ হজরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.)-এর জীবিতকালে যেমন তেমনি পরবর্তীকালেও যতদিন জীবিত ছিলেন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সঙ্গে তার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি অংশ নিয়েছেন, তার বিপদে-আপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, অভয় ও মদদ দিয়েছেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের বর্তমান সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীনকে তিনি আপন সন্তানের মতো ভালোবাসতেন, ¯েœহ করতেন। আধ্যাত্মিক নিদের্শনা ছাড়াও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তাকে নিয়মিত পরামর্শ দিতেন। স্বভাবতই ছাহেব কিবলাহর ইন্তেকালে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তার একজন অকৃত্রিম উপদেষ্টা ও পৃষ্ঠপোষক হারিয়েছে। আর এএমএম বাহাউদ্দীন হারিয়েছেন একজন অভিভাবক ও মুরব্বীকে।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের তরফে যখনই কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে, ছাহেব কিবলাহ বিনা প্রশ্নে তা সমর্থন করেছেন এবং তাতে শরিক হয়েছেন। বিগত এক সরকারের আমলে কয়েকশ’ মাদরাসা বন্ধ করে দেয়া হয়। চলে আরো মাদরাসা বন্ধের পাঁয়তারা। এর প্রতিবাদে সারাদেশে জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ-সমাবেশ করতে থাকে। এরকমই এক প্রতিবাদ-সমাবেশে ডাকা হয় রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে। সে সমাবেশে উপস্থিত হন ছাহেব কিবলাহ। সমাবেশ থেকে সিদ্ধান্ত হয় বিক্ষোভ মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হবে। কিন্তু বিক্ষোভ মিছিল আর শুরু হয় না। চারদিকে পুলিশের প্রাচীর। তা ভেদ করে ঝুঁকি নিয়ে মিছিল শুরু করতে সবাই যখন ইতস্তত করছেন তখন সামনে এসে দাঁড়ান ছাহেব কিবলাহ। ঘোষণা করেন, আমি থাকব মিছিলের সামনে। গুলি হলে আমার বুকে লাগবে আগে। আমি শহীদ হব। এর পর যেন বাঁধ ভেঙে যায়। সামনে এগিয়ে চলে দৃপ্ত মিছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা শিক্ষার ফাজিল ও কামিল স্তর ন্যস্ত করার মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্ব ও ঐতিহ্য বিনাশ করার যখন চক্রান্ত চলে তখন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনসহ দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ একযোগে তার প্রতিবাদ জানান। ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। মাঠে-ময়দানে সরকারের পরিকল্পনা ও পাঁয়তারা বন্ধ এবং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ওইসময় ছাহেব কিবলাহ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী বরাবরে তিনি ও শর্ষিনার পীর ছাহেব যৌথভাবে একটি খোলা চিঠি দেন। চিঠিতে তারা বলেন, ‘ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং তার অধীনে মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্স মান প্রদানের দাবি দীর্ঘদিনের। এ দাবি বাস্তবায়নের জন্য দেশের ওলামায়ে-কেরাম, মাশায়েখে এজাম, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী। এ শিক্ষার শুভাকাক্সক্ষীগণ দীর্ঘদিন থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে এজন্য গঠিত কমিশন ও কমিটিসমূহ এর অনুকূলে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করেছে। এর আলোকে সরকার দেশে একটি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করবে, এ প্রত্যাশা সকলের।
ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার এ জাতীয় দাবিকে পাশ কাটিয়ে সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাজিল কামিলকে ন্যস্ত করে মান দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বলে জানতে পেরে আমরা গভীর উদ্বেগ বোধ করছি। সরকারের অনুধাবন করা প্রয়োজন, মান প্রদানের নামে যদি মাদ্রাসার ঐতিহ্য, বৈশিষ্ট্য, ও স্বাতন্ত্র্য কোনো প্রকার ক্ষুণœ করা হয় কিংবা ফাজিল-কামিলের জন্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের যে কোর্স-কারিকুলাম আছে তা যদি রদবদল করা হয় অথবা মঞ্জুরিপ্রাপ্ত ফাজিল-কামিল মাদ্রাসাসমূহের কোনোটিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয় কিংবা ওই সকল মাদ্রাসায় চাকরিরত শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিতে কোনো বিঘœ সৃষ্টি করা হয় তবে সে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা মনে করি, এর দ্বারা সমস্যার কোনো সমাধান হবে না বরং তা নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে, জটিলতা বৃদ্ধি করবে যা কারোর কাম্য নয়।’
পীরদ্বয় ওই খোলা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমরা বিষয়টির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং অবিলম্বে এফিলিয়েটিং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। এই সঙ্গে আরো আবেদন জানাচ্ছি যে, এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সাপেক্ষে আপাতত ফাজিল-কামিল মাদরাসাসমূহকে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে রেখেই অচিরেই ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্স মান প্রদান করা হোক!’
মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ছাহেব কিবলাহ ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে। তিনি তার প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে সভা-সমাবেশ করেন। তিনি দাবি আদায়ে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা দেন এবং তার নেতৃত্বে শত শত গাড়ির লংমার্চ ঢাকায় আসে ২০০৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। বায়তুল মোকাররম মসজিদ চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল সমাবেশ। ওই সমাবেশে ছাহেব কিবলাহ বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা দেন, আমরা অবিলম্বে এফিলিয়েটিং আরবী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন চাচ্ছি। এর অধীনে ফাজিল ও কামিলের মান চাই। এর বিকল্প কোনো কিছু মানি না। মানব না। এরপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছাহেব কিবলাহকে আমন্ত্রণ জানান আলোচনার জন্য। সে আলোচনায় তার সঙ্গী হন দৈনিক ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক কবি মাওলানা রুহুল আমীন খান এবং তার ছোট ছেলে মাওলানা হুছাদ্দীন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছাহেব কিবলাহর আলোচনায় তিনি তার বক্তব্য ও অভিমত তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাদরাসা ন্যস্ত করা হবে না। মহিলা শিক্ষক নিয়োগের বাধ্যতামূলক আদেশ শিথিল করা হবে। ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
হজরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.) এবং ছাহেব কিবলার আজীবন স্বপ্ন ছিল ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের। এখন সেই ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্বপ্ন নয় বাস্তব। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি এএমএম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলন ও প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সঙ্গত কারণেই হজরত মাওলানা আবদুল মান্নান (র.)-এর প্রতিষ্ঠিত ও এএমএম বাহাউদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক ইনকিলাবের প্রতি, ইনকিলাব পরিবারের প্রতি ছাহেব কিবলাহর প্রশ্রয়, সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা আজীবন অক্ষুণœ ও অটুট ছিল। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হয়, তার সঙ্গে ছাহেব কিবলাহর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মিল ছিল। একারণেই যখন ১৯৮৮ সালে সরকার ইনকিলাবের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে তখন তার প্রতিবাদে ছাহেব কিবলাহ গর্জে ওঠেন। ইনকিলাব বন্ধের প্রতিবাদে ও বন্ধের আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী যে বিশাল আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শামিল হয় ছাহেব কিবলাহ প্রতিষ্ঠিত আনজুমানে আল ইসলাহ, আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়াসহ বিভিন্ন সংগঠন। ছাহেব কিবলাহ তার সিলেট শহরের সুবহানীঘাটের বাড়িতে এক সুধী সমাবেশের আয়োজন করেন। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, অবিলম্বে ইনকিলাব খুলে দিতে হবে। নইলে সারাদেশে অবিরাম আন্দোলন-কর্মসূচি চলবে। সামনে আমি থাকব। আপনাদের সহযোগিতা চাই।
সব প্রয়োজনে, সব বিপদাপদে যিনি সামনে এসে দাঁড়াতেন, সেই মানুষটি তার প্রিয়তমের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ায় দেশে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা আজও পূরণ হয়নি। জাতির এই অভিভাবকের কথা বিভিন্ন উপলক্ষে এখনো স্মরণ হয়। আরও বহুদিন স্মরণ হতে থাকবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।