হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান হচ্ছে সমতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা। গণতান্ত্রিক পরিমন্ডলে কারো মত এবং যুক্তি-তর্ক পছন্দ না হলেও তার মত প্রকাশের বিষয়টি নির্বাধ করে দিতে হয়। বিশেষ করে, যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের এ কাজটি বেশি করতে হয়। সরকারের বিরোধিতাকারীদের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করে নিজের যুক্তি দিয়ে যে কোনো বিষয় উপস্থাপন করার মধ্যেই গণতন্ত্রের সার্থকতা নিহিত। বিষয়টি এমন নয় যে, তোমার মতামত পছন্দ হয়না, তাই তোমার কথা বলার অধিকার নেই। আমি যা বলব, তাই তোমাকে মেনে নিতে হবে, নইলে কোমরে রশি বেঁধে চৌদ্দ শিকের ভেতর ঢুকিয়ে দেব। গণতন্ত্রে এ ধরনের আচরণের কোনো ঠাঁই নেই। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চেতনা খুবই টনটনে। বহুকাল ধরেই তাদের এ চেতনা কাজ করে আসছে। তারা কথা বলতে পছন্দ করে। সরকার বা বিরোধীদলের যে কোনো কর্মকাÐ, সিদ্ধান্ত এবং বক্তব্য নিয়ে বটতলায়, টং দোকানে কিংবা আড্ডায় চায়ের কাপে তুমুল ঝড় তোলে। কখনো কখনো হাতাহাতির পর্যায়েও চলে যায়। ফলে দেখা যায়, রেস্টুরেন্টগুলোর দেয়ালে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বাণী লেখার পাশাপাশি, ‘রাজনৈতিক আলাপ’ নিষিদ্ধ লিখে রাখে। আসলে আমাদের দেশের মানুষ ইউরোপ-আমেরিকার মানুষের মতো নয়। সেসব দেশে গণতন্ত্রের ভীত শক্ত এবং নিয়মিত চর্চা অবারিত বলে এ নিয়ে তাদের চিন্তা করার কিছু নেই বলে তারা খুব একটা মাথা ঘামায় না। তারা নিজেদের অধিকার নিয়ে অত্যন্ত সচেতন বলেই, কেউ তাতে বাঁধ সাধবে, তা চিন্তাও করতে পারে না। এমনকি পাশের বাড়ির কুকুরটি যদি ঘেউ ঘেউ করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে অভিযোগ করে বসে। পুলিশও কোথা থেকে ভোজভাজির মতো হাজির হয়ে সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে। বিষয়টির মর্মার্থ হচ্ছে, তোমার কুকুর পালার অধিকার থাকলেও আমার ঘুমের বারটা বাজানোর অধিকার নেই। আমাদের দেশে পাশের বাড়ির ছাদে বিয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গভীর রাত পর্যন্ত মাইকে উচ্চ শব্দে হিন্দি গান বাজিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে দিলেও কিছু বলার থাকে না। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের ভীত শক্ত হয়ে উঠেনি এবং এ ভীত শক্ত করার দায়িত্ব পালনে ক্ষমতাসীন দল থেকে শুরু করে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সচেতন নাগরিক মহল খুব একটা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না। ফলে নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক অধিকারের প্রতি সচেতন হওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। এর পরিবর্তে সমতা নয়, ক্ষমতার বিষয়টি সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। যার যত ক্ষমতা, সে তত স্বাধীনতা ভোগ করে। আমার অর্থ-বিত্ত, ক্ষমতা এবং ক্ষমতার উৎস আছে, কাজেই আমি যা খুশি তাই করতে পারব। ক্ষমতার দাপটে অন্যের অধিকার হরণ করার এই মনোভাবের পেছনে রয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। ক্ষমতাসীন দল থেকে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের মর্ম সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর কোনো চর্চাই দেখা যায় না। তারা আছে ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার রশি টানাটানির মধ্যে। ক্ষমতাসীন দল এবং তার নেতা-কর্মীর ক্ষমতার দাপট এতটাই যে, আতঙ্কে সাধারণ মানুষের চুপ হয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। অন্যদিকে জনসাধারণকে এই ভীতিমুক্ত করতে বিরোধী দলগুলো যে পাশে দাঁড়াবে, তারও তেমন কোনো নমুনা দেখা যায় না।
দুই.
আমাদের দেশের শাসন ব্যবস্থা যখনই কোনো স্বৈরশাসন বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পড়েছে, তখন জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়েছে। এ ধরনের সরকার যা খুশি তা করলেও তাদের বলা বা করার কিছু থাকে না। এর কারণ, ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা দল জনসাধারণের মতামতকে দমিয়ে রাখার সব পন্থা অবলম্বন করে। বন্দুক কোলে নিয়ে ক্ষমতার চেয়ারে বসে থাকে। কেউ বিরোধিতা করলেই বন্দুক তাক করে। বিরোধীদল ক্ষমতার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠলে গুলি করে দেয়। এ ধরনের সরকারের পুরো ব্যাপারটিই থাকে ভনিতার উপর। পেছনে বন্দুক লুকিয়ে জনসভার নামে তার সামনে ধরে আনা জনসাধারণের উদ্দেশে ভাল ভাল কথা বলে। উন্নয়নের জিকির তোলে। জনগণ তার সাথে আছে, এ কথা জোরেসোরে উচ্চারণ করে। গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের এন্তার বিবরণ দিয়ে আবেগাপ্লুত বা অশ্রæসজল হয়ে বলে, আমার এ জীবন আপনাদের সেবায় উৎসর্গ করলাম। আমৃত্যু আপনাদের সেবা করে যাব। ক্ষমতার দাপটের কাছে অসহায় ও হতাশ হয়ে পড়া সাধারণ মানুষও বিরস ও হতাশ বদনে তা শোনে। কেউ হাততালি দিতে না চাইলেও তাকে বাধ্য করা হয়। জনসভায় আসতে না চাইলে হুমকি দিয়ে আনা হয়। এ ধরনের সরকার সামন্তযুগীয় জমিদারের মতো। কোনো প্রজাকে ডেকে আনতে হলে জমিদার যেমন লাঠিয়াল পাঠিয়ে ধরে নিয়ে আসে, তেমনি মৌখিক গণতন্ত্রের যুগে জনসাধারণকেও ক্ষমতাসীন দলের জনসভায় অনেকটা জোর করেই হাজির করা হয়। তার নজির আমরা অহরহই দেখতে পাই। অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিতে গণতন্ত্র, সুশাসনের কথাগুলো মুখে উচ্চারিত হলেও রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল যেভাবে তার সুবিধা হয়, সেভাবে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে থাকে। অথচ যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের দেশের মানুষ সুদীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, তা শাসক গোষ্ঠী বরাবরই উপেক্ষা করেছে এবং করছে। মানুষ গণতন্ত্রের পূর্ণ স্বাদ পায়নি। এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই সময়ে গণতন্ত্রের অবস্থা কী, তা বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, তা কর্তৃত্ববাদের মধ্যে আটকা পড়ে আছে। একে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে, ‘সীমিত বা নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্র’ বলে এবং এটাই যথেষ্ট বলে বলা হচ্ছে। অনেকে বলে থাকেন, গণতন্ত্রের মোড়কে এ ধরনের তন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ। এর মধ্য দিয়েই উত্থান ঘটে শাসক দলের অনুগত সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর, যারা হিটলারের প্রপাগান্ডার দায়িত্বে নিয়োজিত গোয়েবলস-এর মতো স্তুতি গাইতে থাকে। অসত্যের আশ্রয় নিয়ে তারা এমন সব মনগড়া বিষয় প্রকাশ করতে থাকে, যার ভিত্তি থাকে না বললেই চলে। শাসকদলও তা নিয়ে আনন্দ-উল্লাস আর হই-হুল্লোড়ে মেতে উঠে। এ প্রবণতা এখন খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। কষ্টে থাকা জনসাধারণ না পারে সইতে, না পারে কিছু বলতে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন কেমন এবং কী পর্যায়ে আছে, তা বৈশ্বিক বিবেচনায় বিচার করা প্রয়োজন। এটা করা প্রয়োজন বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার চরিত্র নির্ধারণের জন্য। যে গণতন্ত্রের কারণে দেশ স্বাধীন হয়েছে, ৪৬ বছরে তার স্বরূপ কেমন তা জানা দরকার। এ বছরের শুরুতে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের ওপর যুক্তরাজ্যের ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ‘হাইব্রিড’ গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়েছে। গণতন্ত্রের মান ধরা হয়েছে ১০। এই ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ৫.৭৩। ১৬৭টি দেশের ওপর পরিচালিত জরিপের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থান ৮৪। হাইব্রিড গণতান্ত্রিক দেশ সেগুলোকেই বলা হয়, যেগুলোর স্কোর ৪ থেকে ৫.৯০-এর মধ্যে রয়েছে। বিচার্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, সরকারের কার্যকারিতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি নেই। বলা বাহুল্য, হাইব্রিড হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যা অসম্পূর্ণ। গ্রীক মাইথলজির ‘সেন্টুরাস’ বা অর্ধ মানব, অর্ধ ঘোড়ার মতো, যাকে মানুষও বলা যায় না, আবার ঘোড়াও বলা যায় না। অথচ আমাদের দেশের মানুষ এমন ‘সেন্টুরাস ডেমোক্রেসি’Ñএর জন্য সংগ্রাম করেনি। তারা পূর্ণ গণতন্ত্র, যেখানে আইনের শাসন, সুশাসন, মানবিকতা, অর্থনৈতিক মুক্তি, সমতা এবং স্বাচ্ছন্দ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকবে, তার জন্য সংগ্রাম করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এসব বিষয়ের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ও বৈষম্য অকাশ-পাতাল হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বলয়ে থাকা এক শ্রেণী এতটাই অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছে যে, দেশে তাদের অর্থ রাখার জায়গা নেই। বিদেশে পাচার করে সেখানে আলিশান বাড়ি-ঘর তৈরি করছে। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগে মানুষ এসবই জানে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে ক্ষমতাসীনদের কার কার কী সম্পদ রয়েছে, তা এখন ওপেন সিক্রেট। সেখানে বিভিন্ন স্বতন্ত্র এলাকাও গড়ে তোলা হয়েছে। ‘সেন্টুরাস ডেমোক্রেসি’র ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এবং জবাবদিহীতা না থাকায় একটি শ্রেণী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তাদের সম্পদের পবর্তমালা দেশ থেকে বিদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী, যে সম্পদ পিরামিডের মতো বা আর্থিক উন্নতি উপর থেকে নিচের দিকে ধাবিত হয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার কথা, সে পিরামিড এখন উল্টে গেছে। সাধারণ মানুষের অর্থ শুঁষে ক্ষমতাসীন বলয়ের শ্রেণী ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। উঁচু শ্রেণী আরও উঁচু হচ্ছে। আর এ শ্রেণীর উন্নয়নকেই সরকার তার সাফল্য এবং ব্যাপক উন্নতি বলে দাবী করছে।
তিন.
দেশের মানুষ সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি এবং আত্মতৃপ্তিতে ভোগার চিত্র প্রতিদিনই দেখছে। এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারের মুখোমুখিও হচ্ছে তারা। তবে তারা যে ভাল নেই, এ বিষয়টি সরকার আমলেই নিচ্ছে না। সাধারণ মানুষ চাপা কষ্ট নিয়ে গুমরে দিন পার করছে। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং আয়-ব্যয়ের গড়-মিলের হিসাব সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর প্রতিবেদনেই উঠে আসছে। সেখানে মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার চিত্র এবং সঞ্চয় করার সামর্থ্য হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। শহরের নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে জীবনযাপন করছে, তা পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে বিশদভাবে এসেছে। দিন দিন সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও, সরকারের তা অনুভব করার মতো ¯œায়ু আছে বলে মনে হচ্ছে না। উল্টো ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী বড় গলায় বলছে, দেশের মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। তারা সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে। তারা উন্নয়নের এক ধরনের ইন্দ্রজাল মানুষের সামনে তুলে ধরে অনর্গল তা বলে যাচ্ছে। বছর দুই-তিনেক আগে হুট করেই সরকার ঘোষণা করে বসে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এক লাফে কয়েকশ’ ডলার বেড়েছে বলে জানান দেয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই এই আয় বাড়ছে বলে তুলে ধরা হয়। সরকারের এ ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরাও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। কীভাবে আয় বেড়েছে, এ হিসাব সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়ে উঠার আগেই সরকারও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সেবা খাতের দাম বাড়িয়ে চলেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম দ্বিগুণ করে দিয়েছে। দাম কমানোর সুযোগ থাকলেও কমাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম সর্বকালের সর্বনি¤œ পর্যায়ে থাকলেও, সরকার মূল্য সমন্বয় করে কমায়নি। যদি এই একটি খাতে দাম কমিয়ে দিত, তাহলে শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ এবং পরিবহণ খরচ কমে দ্রব্যমূল্য অনেক কমে যেত। মানুষের জীবনযাপনও স্বস্তিকর হতো। সরকার তা করেনি। বরং ভর্তুকি কমানোর উসিলায় দাম বাড়িয়েই রেখেছে। এমনকি জ্বালানি তেল খাতে ভর্তুকি মিটিয়ে লাভ করে চলেছে। বলা যায়, সরকার সাধারণ মানুষের সাথে এক ধরনের ব্যবসা করছে। আবার বিদ্যুতের দাম যে ৩৫ পয়সা বৃদ্ধি করা হলো, এই বৃদ্ধিরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। গণশুনানিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনোই প্রয়োজন নেই, বরং ১ টাকা ৩৮ পয়সা কমানো যায়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তা আমলে না নিয়ে উল্টো ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের এ মনোভাব থেকে মনে হতেই পারে, সে জনসাধারণের উপকার হয় এবং তারা স্বস্তিতে জীবনযাপন করুক, তা চায় না। এটাও প্রতীয়মাণ হয়, জনগণের প্রতি সরকারের দরদ নেই। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজনও বোধ করে না। অবশ্য যে সরকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় না, জনগণের প্রতি সে সরকারের দায়বোধ, দরদ কিংবা জবাবদিহীতা থাকারও কোনো কারণ নেই। পক্ষান্তরে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে যদি সরকার নির্বাচিত হতো, তবে তার মর্ম উপলব্ধি করে সামর্থ্যরে সবটুকু নিংড়ে দিয়ে জনসেবায় মনোযোগী হতো। তা না হওয়ায়, জনগণের কাছে সরকারের কোনো দায় বা জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে না। এটা ‘সেন্টুরাস ডেমোক্রেসি’র কুফল এবং তা জনগণকেই ভোগ করতে হচ্ছে। এই ডেমোক্রেসির শাসন ব্যবস্থায় ৩৫ টাকা কেজির চাল ৬০ টাকা, ২৫ টাকার পেঁয়াজ ১০০ টাকা হলেও কিছু করার থাকে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম দ্বিগুণ হলেও বলা হয় ‘মামুলি ব্যাপার’। অর্থাৎ জনগণ তা অ্যাডজাস্ট করে নেবে, সয়ে যাবে। স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পরিবেশে এ মনোভাব কল্পনাও করা যায় না।
চার.
হাইব্রিড বা সেন্টুরাস ডেমোক্রেসির বিপজ্জনক দিক হচ্ছে, যারা এ নীতি অবলম্বন করে, তারা ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও সুসংহত করার জন্য জনগণের ওপর ভরসা করার পরিবর্তে প্রশাসনিক বলয় বা দুর্গ গড়ে তুলে। জনগণের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস থাকে শূন্যের কোঠোয়। জনগণ হয়ে উঠে তাদের প্রতিপক্ষ আর প্রশাসন যন্ত্র হয়ে ওঠে সবচেয়ে আপন এবং বড় হাতিয়ার। জনগণকে চুপ রাখার জন্য যে ধরনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাই করা হয়। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থায় জনগণের প্রবেশাধিকার থাকে না এবং জনগণ বলতে প্রশাসনের লোকজনকেই বোঝায়। এসব লোকজনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এমনভাবে ভাসিয়ে দেয়া হয় যে, তারাও আর সরকারকে সুরক্ষা দিতে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সরকার বিরোধী শক্তি বা ব্যক্তিÑযেই হোক, তাদের দমন করতে কণ্ঠাবোধ করে না। সরকারের আরামে যাতে কেউ ব্যঘাত বা আঁচড় কাটতে না পারে, এ জন্য চারপাশে দেয়াল গড়ে তোলে। এই দেয়াল ভেদ করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এই দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকা সরকার নিজেকে জনকল্যাণের বলেও দাবী করে। দেয়ালের ওপার থেকে উন্নয়নের ফানুস উড়িয়ে বলা হয়, দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। এই উন্নয়নের ধরণ এমন যে, এক বিষয়ে লেটার মার্ক, বাকি সব বিষয়ে ফেল। আমাদের দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য যে, তাদের হাইব্রিড বা সেন্টুরাস ডেমোক্রেসির মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে, যেখানে তাদের কষ্টকর জীবনযাপনের দায়দায়িত্ব সরকার খুব একটা বহন করছে না। সরকার জনগণের কল্যণের পরিবর্তে জনগণের কাছ থেকে তার কল্যাণ প্রত্যাশা করছে। জনগণই তার সেবা করবে, এমন মনোভাব তার মধ্যে স্পষ্ট।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।