Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিজয়ের মাসে বিশ্বস্রস্টারর প্রদর্শিত সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের লক্ষ্য

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এখন ডিসেম্বর মাস চলছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিসেম্বর বিজয়ের মাস হিসাবে পরিচিত। ঊনিশশ’ একাত্তরের এই মাসের ষোল তারিখে মহান মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের গৌরবময় যাত্রা শুরু হয়। সে নিরিখে বাংলাদেশে ডিসেম্বর একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসাবে বিবেচিত। ডিসেম্বর এলেই বিজয় দিবস কীভাবে উদযাপন করা যায় তা নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যায়।
তবে এবারকার ডিসেম্বর আমাদের জন্য শুধু বিজয় দিবসের স্মারক হিসাবেই আসেনি। ডিসেম্বরের ২ তারিখ ছিল বারই রবিউল আউয়াল অর্থাৎ বিশ্বনবীর জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী। বিশ্ব ইতিহাসের যে শ্রেষ্ঠ মানুষ বাস্তব ক্ষেত্রে মানুষকে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গেছেন তাঁর স্মৃতি এবারকার ডিসেম্বরকে বিজয় দিবসের স্মারক ছাড়াও বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে বিশ্বনবীর শিক্ষা দেয়া সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শের স্মারক দিবস হিসাবে।
কিন্তুু দু:খের সঙ্গে বলতে হয় উপরে উল্লেখিত দুই মহান ঘটনার স্মারক এবারকার এই ডিসেম্বরেই শুনতে হয়েছে একটি দু:সংবাদ : বাংলাদেশে আয়ের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে শতভাগ। এ তথ্য প্রকাশ করেছেন সেন্টার.ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত রবিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক ব্রীফিংয়ে তিনি এই তথ্য জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ এমনিতে পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশসমূহের অন্যতম। প্রদেশে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো যারা ধনী তারা আরও ধনী হয়েছে আর যারা দরিদ্র তারা দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে অসহনীয় পর্যায়ে নেমে গেছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এ তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের সঙ্গে এটা কতটা সঙ্গতিশীল? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তো লক্ষ্য ছিল এমন এক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা, যা শুধু রাজনৈতিকভাবেই স্বাধীন হবে না, স্বাধীন হবে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ভাবেও।
রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো বাংলাদেশের উপর অন্য কোন দেশেরই কোন কর্তৃত্ব থাকবে না। আজকের পৃথিবীতে অধিকাংশ দেশ ক্ষুদ্র ও দুর্বল হওয়ার কারণে বিভিন্ন শক্তিশালী ও বৃহৎ দেশের কর্তৃত্ব ও প্রভাবের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশ শুধু বৃহৎ প্রতিবেশী দেশসমূহের আধিপত্যবাদের শিকার নয়, একাধিক বৃহৎ আধিপত্যবাদী দেশের সমর্থন পেয়ে মিয়ানমারের মত দুর্বল দেশের সেনাবাহিনীও তাদের দেশের রোহিঙ্গা জনগৌষ্ঠীকে বাঙালী আখ্যা দিয়ে সে দেশ থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিচ্ছে। এভাবে জনবহুল বাংলাদেশের ঘাড়ে বাড়তি জন সংখ্যার বোঝা চাপিয়ে দেয়ার সাহস তাদের পক্ষে দু:সাহসই বলতে হবে।
সাংস্কৃতিভাবে স্বাধীন হওয়ার অর্থ নিজেদের জাতীয় সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র শক্তিশালীভাবে বজায় রাখতে সমর্থ হওয়া। বিশ্বায়নের এই যুগে আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বাংলাদেশের মত একটি দুর্বল ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন। সারা বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ পৃষ্ঠপোষিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা প্রচলিত থাকায় বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র ও দরিদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে পুঁজিবাদী প্রভাবের বাইরে থাকাও অসম্ভব। ফলে বাংলাদেশের মত দরিদ্র রাষ্ট্রের বাড়তি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আয়ের চেয়ে সম্পদের বিরাট বৈষম্য।
এসবের ফলে ডিসেম্বরের বিজয়ের গৌরব প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সুতরাং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের গৌরবকে সার্থক করে তুলতে হলে যেসব কারণে বিজয়ের গৌরব অর্থহীন হয়ে পড়ছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সন্ধান করে তার যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বিজয়ের গৌরবই শুধু অর্থহীন হয়ে পড়বে না, মুক্তিযুদ্ধের অগনিত শহীদের রক্তের সাথেও বেঈমানী করা হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে। আমাদের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানীরা লুটে পুটে খাচ্ছে, এ ধরনের অজুহাত দিয়ে আমাদের নেতাদের এখন আর পার পাবার উপায় নেই। তাছাড়া তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান তথা বর্তমানের পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে ভারত নামের রাষ্ট্রের মাধ্যমে দেড় হাজার মাইলের ব্যবধানে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র ভূখন্ডে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আধিপত্যবাদী প্রভাব বিস্তার করাও তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। সুতরাং অতীতের মত পাকিস্তানের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আমাদের ব্যর্থতার দায় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এখন বরং আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ভৌগোলিক সংলগ্নতার সুযোগে তার আধিপত্যবাদের স্বার্থে আমাদের জাতীয় স্বার্থের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করছে কিনা সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বিশেষ কর্তব্য। তাছাড়া সাতচল্লিশের যে পাটিশনের ফলে অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আজকের বাংলাদেশ (যা সেদিন তদানীন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসাবে পূর্ববাংলা নামের আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পায়) সে পাটিশনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ। সুযোগ পেলেই আজও যে তাদের আদিপত্যবাদী আগ্রাসন চালান তারা, এ সত্য তো অস্বীকার করার উপায় নেই।
এবার পুনরায় আমরা আমাদের সম্পদের বৈষম্য বহুগুণ (শত ভাগ) বৃদ্ধির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে গুরুত্বসহকারে আলোকপাত করতে চাই। স্বাধীনতা সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, স্বাধীনতা অর্জন করা যত কঠিন তার চাইতে ঢের বেশী কঠিন তা রক্ষা করা। কারণ স্বাধীনতা রক্ষা করতে যে দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা অনেক ব্যাপক ও কঠিন। একটা রাষ্ট্রের মধ্যে নানারকম লোক বাস করে। তাদের যেমন ধর্ম বিশ্বাস থাকে পৃথক পৃথক, তেমনি অর্থনৈতিক শ্রেণী, পেশা, রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা প্রভৃতি দিক দিয়েও তাদের মধ্যে থাকে নানা পার্থক্য। এতসব পার্থকের মধ্যে তাদেরকে একটা ঐক্য ও সংহতির সূত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে পারাটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বড় একটা ব্যাপার।
দেশের বিভিন্ন ধরনের লোক যখন একটা ঐক্যসূত্রে মিলিত হয়ে রাষ্ট্রের মঙ্গল চিন্তায় কাজ করতে সংকল্পবদ্ধ হয়, তখন সে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা সহজ হয়ে পড়ে। এর অভাবে রাষ্ট্রের অন্তনিহিত শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নানাভাবে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে ওঠে। একথা সত্য যে, বহির্বিশ্বের আগ্রাসনের কবল থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক। কিন্তুু সে সেনাবাহিনী যদি নিজেদের নাগরিকদের কোন অংশের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে, যেমন হয়েছিল একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানে, তখন সে রাষ্ট্রের ঐক্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
এখানে একটা কথা স্মরণ করা যেতে পারে দৃষ্টান্ত হিসাবে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত্রে টিক্কা বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের উপর যদি শংস আগ্রাসন না চালিয়ে বসতো, তাহলে এদেশের আপামর জনসাধারণ পাকিস্তানী বাহিনীর উপর এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতো না এবং বাংলার দামাল ছেলেরাও দলে দলে জান কবুল করে, মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো না। দেশের জনগণ যখন শাসকদের দু:শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়ায়, তখন পৃথিবীর কোন উন্নত সেনাবাহিনীও সে দেশকে রক্ষা করতে পারে না। তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত জনগণের সমর্থনধন্য অর্ধপ্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তি বাহিনীর হাতে একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মত বিশ্বের একটি প্রথম শ্রেণীর উন্নত সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয় বরণ।
পরিশেষে পুনরায় আমরা বলতে চাই, একটি পরিতুষ্ট জনগোষ্ঠী সম্পদের বৈষম্য শতভাগ বৃদ্ধিজাত অসন্তোষ জর্জরিত বিক্ষুব্ধ জনশক্তির তুলনায় রাষ্ট্রীয় সংহতি ও সমৃদ্ধির জন্য অনেক বেশী সহায়ক। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দেশে গণতন্ত্র চর্চা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জোরদার করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এদিকে লক্ষ্য রাখা শুধু গণতন্ত্রের নিরিখে নয়, ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শের নিরিখেও অত্যন্ত জরুরী। এবারকার ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তির স্বারক হিসাব মহান বিজয় দিবস ও বিশ্ব ঐতিহাসের মহত্তম মানব শেষ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী হিসাবে বারই রবিউল আওয়াল ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন থেকে যদি আমরা ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করতে চেষ্টা করি, তাহলে আমরা একই সাথে বাংলাদেশ ও বিশ্বমানবতার মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারব।
এর পরিবর্তনে আমরা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থে বৈষম্যবাদী পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে মানুষে মানুষে অসাম্য বাড়িয়ে তোলার কাজে আত্মমগ্ন থাকি, তবে আমরা শুধু জনগণের মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্যই বৃদ্ধি করে বসবো না, সমাজে শান্তি, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের পথ রুদ্ধ করার পরিণতিতে এক পর্যায়ে সমাজে অশান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টির দায়ে নিজেরাও বিশ্বস্রস্টার অভিশাপ কুড়িয়ে ইহজীবন থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হব এবং পরকালেও অন্তহীন শাস্তিভোগের দুর্ভাগ্য বরনে বাধ্য হব। তাই সময় থাকতেই আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে, আমরা সম্পদের লোভে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাব, না বিশ্বস্রস্টার নির্দেশিত সাম্য-ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সমাজ সৃষ্টির চেষ্টা করে দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি ও কল্যাণের পথে অগ্রসর হব?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ