Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নন্দিত মেয়র আনিসুল হক ‘ঝরে গেল নক্ষত্র’

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বদলে গেছে গাবতলী বাস টার্মিনালের চিত্র। বদলে গেছে তেজগাঁওয়ের সাতমাথার দৃশ্য। নেই কোনো যানবাহনের জটলা। গাবতলী বাসস্ট্যান্ড পার হতে যানবাহনকে এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। তেজগাঁয়ের ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন ফার্মগেট-সাতরাস্তা চার লেন সড়কের মাঝখানে এখন নান্দনিক আইল্যান্ড। লাগানো হয়েছে নানা ধরনের গাছ ও ফুলের চারা। শত শত ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো সেই দৃশ্য, তীব্র যানজট, স্যুয়ারেজের পানিতে কাদাঘিঞ্জি অবস্থা এখন চোখে পড়ে না। তকতকে, ঝকঝকে এই সড়কে এখন স্বস্তিতে চলছে যানবাহন, হেঁটে যাচ্ছেন পথচারী। গাবতলীকে যানজটমুক্ত এবং নতুন দৃশ্যের ফার্মগেট-সাতরাস্তা সড়কের রূপকার হলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিনম্র সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক মেগাসিটিতে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রথীন্দ্র নাথ রায়ের ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে/রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’ মতোই পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
জনগণ কাজে নিবেদিতপ্রাণ মানুষের অভাবের এই দেশে কিসের সঙ্গে আনিসুল হকের তুলনা করা যায়? রাজনীতিতে অকপটতা-হিংসা-বিদ্বেষের চর্চা; প্রশাসনে অনিয়ম, আমলাদের ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটতন্ত্র-দলদাসের বাড়বাড়ন্ত; জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ বৃদ্ধির কাতরতা; ব্যবসায়ীদের মধ্যে কর ফাঁকি দিয়ে কানাডায় বেগমপল্লী, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। দেশের এই অবস্থাকে যদি অন্ধকার কালো রাতের সঙ্গে তুলনা করা হয়; তাহলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক হচ্ছেন অন্ধকার রাতের দূর আকাশে আলো ছড়ানো ছোট্ট নক্ষত্র। ২০১৫ সালের ৬ মে ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কাজ করার স্পৃহা এবং কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কঠোরতা এবং আন্তরিকা তাকে দিয়েছে ‘নন্দিত মেয়র’ এর খেতাব। মেয়র হিসেবে নাগরিক সুবিধা বাড়াতে তিনি হয়তো একশ’ ভাগ সফল হননি; নির্বাচনী প্রতিশ্রæতির অর্ধেকই পালন করতে পারেননি; কিন্তু তেজগাঁওয়ে সড়কের উপরে থাকা অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, গাবতলীর সড়ক থেকে হকার উচ্ছেদ করে রাস্তা প্রশস্তকরণ, গুলশান-বনানী-বারীধারার বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের অবৈধভাবে নির্মিত নিরাপত্তা স্থাপনা সরিয়ে ফুটপাথ উন্মুক্তকরণ এবং উত্তরা এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে মেয়র হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ-বাস্তবায়ন এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দলবাজিকে প্রশ্রয় দেননি। কঠিন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বাধার মুখে পড়েছেন, কিন্তু ঝুঁকি নিয়েই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। যা অতীকে কোনো মেয়রের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
‘যেতে নাহি দিব হায়/তবু যেতে দিতে হয়/ তবু চলে যায়’ কবির এই অমোঘ বাণীর মতোই না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। কিন্তু কিছু কাজের জন্যই বেঁচে থাকবেন রাজধানী ঢাকায় বসবাস করা অগণিত মানুষের হৃদয়ে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আনিসুল হক মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ব্যস্ত থেকেছেন নগরের ভালো-মন্দ দেখভালে। ব্যবসায়ী হিসেবে সামলেছেন বাণিজ্যের গতিময় জগত। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর সংস্কৃতিমনা এক আলোকিত মানুষ। চিন্তা-চেতনার সঙ্কীর্ণতার এই যুগে সদা হাস্যোজ্জ্বল এই মানুষটি সবক্ষেত্রে কর্মে দ্যুতি ছড়িয়েছেন; ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিলিয়েছেন দুর্নিবার আলো। তার নির্মিত টিভি অনুষ্ঠান ‘অন্তরালে’ ‘এখনই’ ‘জলসা’ ‘বলা না বলা’ ‘সবিনয়ে জানতে চাই’ দর্শকরা এখনো মনে রেখেছে। ঈদে তিনি বিটিভির বেশ কয়েকটি ঈদের ‘আনন্দমেলা’ উপস্থাপনা করেছেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আনিসুল হক ব্যবসার পাশাপাশি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি বিজিএমই-এর সভাপতি, এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এবং সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও নানা সেবামূলক কর্মকাÐে জড়িয়েছেন। এ অঙ্গনের বিপদে আক্রান্ত মানুষদের জন্য সবসময়ই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। গরিব-দুস্থ শিল্পীদের সহায়তার জন্য সমাজের বিত্তবানদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম। ওই সংগঠন থেকে শিল্পী লাকী আখান্দ, আলাউদ্দিন আলী, শাম্মী আখতারসহ অসংখ্য বরেণ্য শিল্পীদের এককালীন আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। আর বিভিন্ন দুস্থ বা রোগাক্রান্ত শিল্পীকে যার যেমন প্রয়োজন; সে অনুযায়ী কাউকে মাসিক টাকা কাউকে চিকিৎসার খরচ দিয়েছেন। দেশে শিল্পীদের জন্য এ ধরনের মহতি উদ্যোগ আনিসুল হকই প্রথম গ্রহণ করেন। সাংবাদিকদের পাশেও সবসময় থেকেছেন আনিসুল হক।
যতদূর জানা যায়, আনিসুল হক ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দিলেও রাজনীতি থেকে অনেক দূরেই ছিলেন। ২০১৫ সালে হঠাৎ করেই তাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। মেয়র প্রার্থী হন তিনি। ভোটের আগে মেয়র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী ইশতেহারে নানা ধরনের প্রতিশ্রæতি দেন এবং ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী গড়ার স্বপ্ন দেখান নগরবাসীকে। ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি মানুষের বসবাস করা প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো এই নগরীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেননি তিনি। রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক মেগাসিটিতে রূপান্তরিত করতে পারেননি। রাজধানীর গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, পানিবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পার্ক ও খেলার মাঠ দখলমুক্ত করা, বৃষ্টি হলেই হাটু পানি, যানজট নিরসনসহ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। কিন্তু ঢাকা উত্তরে বেশ কিছু কাজের দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। নগরবাসীর সেবাদান সহজ করতে ডিজিটাল প্রযুক্তির নগর অ্যাপ চালু করা হয়েছে; এয়ারপোর্টে চলন্ত সিঁড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা পারাপারের জন্য নির্মাণ হয়েছে ফুটওভারব্রিজ; শহরকে সুন্দর করে সাজাতে পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ; যানজট নিরসনে ইউলুপ নির্মাণ (এখনো কাজ অসমাপ্ত); হলিডে মার্কেট চালু, গুরুত্বপূর্ণ স্পটে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিনামূল্যে গাছের চারা সরবরাহ, ছাদে বাগান করতে নাগরিকদের উৎসাহিত করাসহ কিছু সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়েছেন। নগরীর অনেক এলাকায় জনদুর্ভোগ আগের মতোই দেখা গেলেও তার নেয়া অনেকগুলো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আনিসুল হক ঘোষণা অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কারওয়ানবাজার স্থানান্তর করতে পারেনি; যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে পরিচিত এই বাজারটি সরিয়ে নিতে মহাখালী, আমিনবাজার ও যাত্রাবাড়ীতে নতুন মার্কেট নির্মাণ করেছেন। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে নগরবাসীর যাতায়াত সমস্যা সমাধানের জন্য ২০১৭ সালের মার্চ মাসের মধ্যে তিন হাজার পাবলিক বাস চালুর ঘোষণা দিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক। কিন্তু এ পর্যন্ত এর দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। তবে অন্য একটি প্রকল্পে ‘ঢাকার চাকা’ নামে বনানী থেকে গুলশান রুটে পাবলিক বাস সার্ভিস চালু করেছেন। সিটি করপোরেশনের ভেতরে গণপরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে বর্তমানে বিভিন্ন রুটে চলা ১৯০টি বাস কোম্পানিকে পাঁচটি কোম্পানিতে রূপান্তর করার তার উদ্যোগের তেমন অগ্রগতি হয়নি।
ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ছিলেন বিনম্র সততা ও মল্যূবোধ জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তিনি চেয়েছিলেন নিরাপদ, আধুনিক নারীবান্ধব ঢাকা গড়তে। পদে পদে বাধার সন্মুখীন হয়েছেন। ক্ষমতাবান প্রভাবশালীরা তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। অবৈধ দখলদার আর প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু সে কাজগুলো অসমাপ্ত রেখেই ইন্তেকাল করলেন। দৃঢ় মনোবল নেতৃত্বে ইস্পাতকঠিন অমায়িক বন্ধুবৎসল এবং আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক মানুষটির কর্মযজ্ঞ নিয়ে নিয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভির টকশো, নানা অনুষ্ঠান, পত্রপত্রিকায় অনেকেই স্মৃতিচারণ করছেন। লন্ডন থেকে তার লাশ আজ ঢাকায় আসবে। সর্বস্তরের শোকের ছায়ার মধ্যেই তাকে সম্মান জানানোর নানা রকম প্রস্তুতি চলছে। সম্মান জানানোর এই প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে; তাকে এক নজর দেখতে হয়তো মানুষের ঢল নামবে। কিন্তু তাকে প্রকৃত সম্মান জানানো হবে তখনই যখন ‘নন্দিত মেয়র আনিসুল হকের’ অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার উদ্যোগ কার্যকর হবে।



 

Show all comments
  • আবু নোমান ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৪:২৫ এএম says : 0
    প্রকৃত সম্মান জানানো হবে তখনই যখন ‘নন্দিত মেয়র আনিসুল হকের’ অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার উদ্যোগ কার্যকর হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • সাব্বির ২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৪:২৫ এএম says : 0
    অসাধারণ সুন্দর একটি লেখা । লেখককে মোবারকবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আনিসুল হক

১২ ডিসেম্বর, ২০১৭

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ