Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফিরে যাচ্ছে পূর্বের অবস্থায়

আনিসুল হকের নেয়া মহৎ উদ্যোগ

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মরহুম মেয়র আনিসুল হকের উদ্ধার করা স্থান ও স্থাপনাগুলো ধীরে ধীরে দখল হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে তার নেয়া উদ্যোগগুলোর অবস্থাও বেহাল। মেয়রের অসুস্থতা ও পরে ইন্তেকাল, এরই মধ্যে প্রায় ৫ মাস পার হয়ে গেল। মেয়রের এই শূন্যতায় ঢিমেতালে দায়সারা গোছে চলছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নতুন- পুরনো সব কর্মকান্ড। অনেকটা রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে নাগরিক সেবার অন্যতম এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটির দৈনন্দিন কার্যক্রম। এমনকি নাগরিকদের সুরক্ষায় ও অধিক সেবা প্রদানের জন্য মেয়রের গৃহীত আলোচিত বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নেও নেই চোখে পড়ার মতো কোনো প্রচেষ্ট। কোনো কোনো উদ্যোগ ইতোমধ্যেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে দেখা যাচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ডিএনসিসির ২১ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর আলহাজ ওসমান গনি ইনকিলাবকে বলেন, মরহুম মেয়র আনিসুল হকের সব উদ্যোগকে আমরা যথাযথ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, মরহুম মেয়রের উদ্যোগ নেয়া অসমাপ্ত কাজগুলোও বাস্তবায়নের ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট আছি।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, আনিসুল হকের অসুস্থতা ও পরে ইন্তেকাল সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের অধিক সময় পার হয়ে গেলেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা সিটি কর্পোরেশনের স্বাভাবিক কাজে গতি ফেরাতে পারছেন না। প্যানেল মেয়র আনিসুল হকের নেয়া চলমান কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করে যাচ্ছেন ও নিয়মিত ফাইলে স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন। এর বাইরে কোনো কাজ করছেন না। এভাবে চলতে থাকলে ডিএনসিসির পূর্বের নেয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সার্বিক কর্মকান্ডের ওপর প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
সরেজমিন দেখা গেছে, ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মিরপুর ১০ নং গোলচত্বর, গুলশান, বনানীসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা যেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় এমন স্থান চিহ্নিত করেন। এসব স্থানে দখল করা ফুটপাথ ও রাস্তার দখল উচ্ছেদ চালিয়ে জনগণের চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। মেয়রের অনুপস্থিতিতে এসব স্থান ক্রমান্বয়ে দখল হতে দেখা যাচ্ছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ধীরে ধীরে রাস্তার ওপর বাস দাঁড় করিয়ে পূর্বের ন্যায় দখল করে রাখছেন পরিবহন শ্রমিকরা। এতে জনগণের চলাচলে প্রতিনিয়তই সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মোহাম্মদপুর আল্লাহ করিম মসজিদ মার্কেটের ব্যবসায়ী রফিক আহম্মেদ বলেন, মেয়র আনিসুল হক সাহেবের অনুপস্থিতিতে অনেক কাজেই আগের মতো গতি পাচ্ছে না। আগে বাসস্ট্যান্ডের এই রাস্তাটি প্রায় সবসময়ই খালি থাকলেও গত কিছুদিন যাবৎ আবার রাস্তার ওপর যত্রতত্র বাস দাঁড় করিয়ে যাত্রী তুলছে, যা পেছনের অন্য সকল যানবাহনের চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে সকালবেলা অফিসে যাওয়ার সময় এ সমস্যাটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
ডিএনসিসির মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও আশপাশের এলাকায় রাস্তার ওপর দূরপাল্লার বাস দাঁড় করিয়ে রাখত পরিবহন শ্রমিকরা। এর ফলে প্রতিনিয়তই রাস্তায় প্রচন্ড ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হতো। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আনিসুল হক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে সঙ্গে নিয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড ও এর আশপাশের এলাকাকে সম্পূর্ণ কার পার্কিং এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন, যা বাংলাদেশের প্রথম কার পার্কিং এরিয়া হিসেবে পরিচিত হয়। এ সময় রাস্তায় কোনো পরিবহন রাখা হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থারও হুমকি দেয়া হয়। দীর্ঘদিন এলাকাটি কার পার্কিং ফ্রি থাকলেও বর্তমানে মেয়র আনিসুল হকের অনুপস্থিতিতে স¤প্রতি মূল রাস্তার পাশাপাশি আশপাশের সব গলি ছাড়িয়ে তেজগাঁও শিল্প এলাকার ভেতরের বিভিন্ন ছোট ছোট রাস্তায়ও দূরপাল্লার বাস রাখতে দেখা যায়, যা গভীর রাত থেকে শুরু করে সকাল ১১টা পর্যন্ত এই এলাকায় শত শত বাস-মিনিবাস রাখতে ও যাত্রী ওঠাতে দেখা যায়। এর মাধ্যমে উক্ত এলাকার পরিবেশ প্রতিনিয়তই বিনষ্ট করছে। এসব পরিবহনের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা কোনো রকম মৌখিক নোটিস পর্যন্ত প্রদান করেন না ট্রাফিক বিভাগ বা ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। ফলে পুরনো অবস্থায় চলে গেছে কার পার্কিংমুক্ত এই এলাকা। একইভাবে ঘটা করে ঘোষণা করে কল্যাণপুর থেকে গাবতলী পর্যন্ত মূল সড়কও কার পার্কিংমুক্ত রাখতে পারছে না ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
আনিসুল হকের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী ছয়টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন-সবুজ-আলোকিত-মানবিক ঢাকা গড়তে কাজ শুরু করেছিলেন। তারই অংশ হিসেবে রাস্তার মিডিয়ান, ফুট ওভারব্রিজের ওপরে, বিভিন্ন ফুটপাথে ও উত্তরা মডেল টাউনসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবেশ রক্ষায় হাজার হাজার গাছ লাগাতে শুরু করেছিলেন তিনি। পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও পরিবেশবান্ধব ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব গাছ লাগানো হলেও রাস্তার আশপাশে গাছগুলোর অনেকটাই বেহাল। অনেক গাছ পরিচর্যার অভাবে মারা যাচ্ছে। গুলশান এলাকার রাস্তার অনেক গাছ প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। অনেক গাছের পাতা লাল হয়ে ঝরতে শুরু করেছে। ফুট ওভারব্রিজের গাছগুলোকেও যত্ম নিতে দেখা যায় না। অযত্মে আর অবহেলায় বেড়ে উঠছে এসব গাছ।
নিরপাদ ও স্বাস্থ্যকর ঢাকা গড়তে রাস্তার পাশের সকল খোলা ডাস্টবিন অতি দ্রুত সরানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন আনিসুল হক। এ জন্য ডিএনসিসি এলাকায় অর্ধ শতের বেশি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) তৈরি করলেও এখনও মেয়রের ঘোষণা অনুযায়ী রাস্তার ফুটপাথ থেকে খোলা ময়লার ডাস্টবিনগুলো আজও সরাতে দেখা যায়নি। এছাড়া এসটিএসগুলো নাগরিকদের চোখের নজরের বাইরে রেখে ও দুর্গন্ধমুক্ত পদ্ধতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার কথা থাকলেও বর্তমানে এসটিএসগুলোর কাছ দিয়ে গেলেই দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চেপে এলাকা পার হতে হয়। যা মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করছে। রাস্তায় ময়লা ফেলার ছোট ছোট ডাস্টবিন থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার হচ্ছে না। এমনকি এ নিয়ে উৎসাহমূলক কোনো প্রকার প্রচারণাও চালাচ্ছে না ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
জীবন বাজি রেখে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যুদ্ধ করে তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকার অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে দেন আনিসুল হক, যা রাজধানী ছাড়িয়ে দেশবাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছে। ডিএনসিসি ওখানে সকল প্রকার যানবাহন চলাচলের জন্য প্রশস্ত রাস্তা ও মিডিয়ান তৈরি করে দেন। এখন সেই রাস্তার দু’ধারে পূর্বের ন্যায় ট্রাক সারি করে রাখতে দেখা যায়। প্রথম প্রথম মধ্যরাতের পর থেকে সকাল বেলা পর্যন্ত এসব পরিবহন রাখা হলেও বর্তমানে দিনের বেলায়ও এসব স্থানে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান রাখতে দেখা যায়। জানা গেছে, আস্তে আস্তে এর মাধ্যমে পুনরায় এই স্থানটি দখলে নেয়ার পাঁয়তারা করছে একটি মহল।
মেয়র আনিসুল হক ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) ন্যায় অতি দ্রæত রাস্তায় এলইডি বাতি লাগানোর কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু গত ৬ মাসেও রাস্তায় নাগরিক নিরাপত্তা রক্ষায় অধিক আলোর বাতি তো দূরের কথা প্রকল্পটি নিজেই কোনো আলোর মুখ দেখতে পায়নি।
সূত্র জানায়, প্রকল্পে সরকারের অর্থ বরাদ্দ থাকলেও বর্তমান প্যানেল মেয়র বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছুই ভাবছেন না। ফলে নাগরিক দুর্ভোগ ক্রমেই বেড়ে চলছে। রাস্তায় আলো স্বল্পতায় প্রতিনিয়তই ঘটছে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিসহ নানা অপকর্ম। এ নিয়ে ডিএনসিসির যেন কোনো প্রকার নাগরিক দায়বদ্ধতাই নেই। গুলশান, বনানী, মহাখালী, উত্তরা, মিরপুরের বিভিন্ন স্থানসহ ডিএনসিসি এলাকার বিভিন্ন স্থানে কর্তৃপক্ষ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে বিভিন্ন সময় ফুটপাথ, রাস্তার পাশের ফাঁকা স্থান, প্রধান রাস্তার একাংশ দখলসহ অবৈধভাবে দখলে রাখা সকল স্থাপনা অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু স্থান উদ্ধার করে নাগরিকদের চলাচলে সহায়তা করতে উপযুক্ত করে দেয়। মেয়রের কঠোর মনোভাবের কারণে দখলদাররা নিজেদের গুটিয়ে নিলেও স¤প্রতি ডিএনসিসির বিভিন্ন স্থানে আবার এসব স্থান দখল করে টংঘর বা অস্থায়ী দোকান তুলে ভাড়া দিতে দেখা যাচ্ছে। ফুটপাথ দখল আবার পথচারীদের চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। একইভাবে দখল হওয়া পার্ক ও খেলার মাঠ উদ্ধারেও সফলতা আসছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্যানেল মেয়র সদস্য ও ডিএনসিসি’র ৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জামাল মোস্তাফা ইনকিলাবকে বলেন, মরহুম মেয়র আনিসুল হকের উদ্ধার করা কোনো স্থাপনা কোনো অবস্থাতেই পুনরায় দখল হতে দেয়া হবে না। এ ব্যাপারে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। তিনি বলেন, উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার যেসব স্থান কিংবা স্থাপনা মরহুম আনিসুল হক উদ্ধার করে গেছেন সেসব স্থান কিংবা স্থপনা পুনরায় দখল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি কেউ এ দুঃসাহস করে থাকে তাহলে আমরা তাৎক্ষণিক ডিএনসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে দখলদারদের আইনের আওতায় নিয়ে আসব।



 

Show all comments
  • হিমেশ ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ৩:৪৫ এএম says : 0
    সরকার, প্রশাসন এবং সিটি কর্পোরেশনের বাকীরা কী এগুলো দেখে না ?
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Shah Alam Khan ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ পিএম says : 0
    আনিসুল হক প্রকৃত পক্ষে ছিলেন একজন সমাজ সেবী। তিনি পারতেন সমাজকে আমূল পরিবর্তন করতে কিন্তু তিনি কখনও রাজনীতির পরিবর্তন আনতে পারতেন না এটাই সত্য। সামাজিক পরিবর্তন করার যে প্রচেষ্টা তিনি করে গেছেন সেটা নজির বিহীন উদাহরণ হয়ে থাকবে এটাও সত্য কথা। সংবাদে যা দেখলাম তাতে মন হচ্ছে, হয়ত তার করা পরিবর্তনের আজ থেকে কয়েক বছর পর চিহ্নই থাকবেই না কিন্তু ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে। তিনি যদি তার মেয়রের সময়কাল কাটাতে পারতেন তাহলে তিনি ঢাকা উত্তরের চেহারা পাল্টিয়ে দিতে পারতেন এবং সেটাই পরবর্তীতে চলতে থাকত এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে পরিবর্তন এনেছিলেন সেটা আমাদের মজ্জায় এখনও পাকা পোক্ত ভাবে বসেনি তাই এখন সেসব বিলীন হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ রাজনৈতিক ভাবে দুটা ভাগে বিভক্ত । তাই যারা সমাজের কাজ করতে চান তাদেরকে সক্রিয় ভাবে কোন দলের থাকতে নেই । আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সমাজের কাজ করার শক্তি দিন। আমীন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ