বিশ্ব নবী সা: এবং যুব সমাজ
জ্ঞানে প্রবীণ এবং মৃত্যু ভয়ে ভীত বয়োবৃদ্ধদের হৃদয়ে ধর্মের আবেদন গভীরতর। এটা তিন হাজার বছর
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির নিকট, মহানবী (সা:) সম্বন্ধে একটি ঘোষণা বা একটি এলান করছেন। আমরা পবিত্র কুরআনের নবম সূরা, সূরা-তওবার ১২৮ নম্বর আয়াতের দিকে দৃষ্টি দেই। আরবি অংশ বাদ দিয়ে, শুধু দুইটি জায়গা থেকে বাংলা অনুবাদটি এখানে উদ্ধৃত করছি। প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (মার্চ ১৯৯০) অনুবাদ থেকে : ‘তোমাদিগের মধ্য হইতেই তোমাদিগের নিকট এক রাসূল আসিয়াছে। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে, উহা তাহার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদিগের মঙ্গলকামী, মোমিনদিগের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ দ্বিতীয়ত, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান কর্তৃক করা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থ ‘কানযুল ঈমান’ থেকে উদ্ধৃতি : ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তাশরিফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রাসূল, যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতি মাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।’ পবিত্র কুরআনের আরেকটি নাম কালাম-উল্লাহ বা কালাম-আল্লাহ শরিফ অর্থাৎ কিনা মহান আল্লাহর কথা, মহান আল্লাহ জবান। সেই মহান আল্লাহ মানুষের নিকট, বিশেষত বিশ্বাসীগণের নিকট উপস্থাপন করছেন তাঁর সম্মানিত বন্ধুকে, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর বন্ধুকে। ইংরেজি পরিভাষায় বলা যায়, ‘আল্লাহ ইজ ইনট্রোডিউসিং হিজ ফ্রেন্ড টু মেনকাইন্ড, পার্টিকুলারলি টু দি বিলিভার্স।’ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দ্যেতনায়, বিভিন্ন উপমায়, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্মানিত বন্ধুকে মানব জাতির নিকট পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই উপস্থাপনাটি বা এই ইনট্রোডাকশনটি, শুধুমাত্র ওইদিনের জন্য প্রযোজ্য নয়, যেই দিন আয়াতটি নাজিল হয়েছিল। এই উপস্থাপনাটি বা এই ইনট্রোডাকশনটি সার্বজনীনভাবে সর্বকালের জন্য। এই বিশ্বব্রহ্মাÐের তথা এই বিশ্বের যেখানে বসেই একজন পাঠক কুরআনের এই আয়াতটি পড়ুন না কেন, আয়াতটি তাঁর জন্যই প্রযোজ্য। রাসূল শব্দের আভিধানিক অর্থ বার্তাবাহক, ইংরেজি ভাষায় মেসেঞ্জার। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য বার্তা নিয়ে এসেছেন মুহাম্মদ (সা:); তাই তিনি বার্তাবাহক তথা মেসেঞ্জার তথা রাসুল। তবে দ্বীন ইসলামের প্রথম দিন থেকেই রাসূল বলতে মুহাম্মদকেই (সা:) বোঝানো হয়, তাই তিনি রাসূলুল্লাহ (সা:)। অতএব যেই রাসূল আমাদের কষ্টে কষ্ট পান, আমাদের উদ্বেগে উদ্বিগ্ন থাকেন, সেই রাসূল সম্বন্ধে জানাটা কি আমাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত নয়? এবং এটাও একটি প্রশ্ন, তিনি যদি জন্মগ্রহণ না করতেন, তা হলে আমাদের জন্য এইরূপ উদ্বিগ্ন কে হতেন? অতএব তাঁর জন্মদিনে আমি আনন্দিত হবো এটাই স্বাভাবিক; আমি খুশি হবো এটাই স্বাভাবিক; আমাদের প্রতি এতবড় দয়া করার জন্য মহান আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানাবো এটাই স্বাভাবিক। তাই আমি এই পত্রিকায় প্রকাশিত সাত-আটদিন আগের কলামে আবেদন রেখেছি, আজকের কলামেও আবেদন রাখছি, আসুন আমরা জানতে চেষ্টা করি। তা হলেই আমাদের ভালোবাসা দৃঢ়তর হবে, তা হলেই আমাদের আনুগত্য দৃঢ়তর হবে এবং আমাদের আনন্দ ও খুশি পরিপূর্ণতা পাবে।
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)কে জানার আরো অনেক প্রয়োজন যেমন আছে, তেমনই সুযোগও আছে। এই অনুচ্ছেদে সুযোগের যথার্থতা নিয়ে বক্তব্য রাখছি। একদম প্রথম অনুচ্ছেদে জানার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বলেছি; পরের অনুচ্ছেদেও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আর একটু বলব। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, মানুষের পক্ষে যে কোনো বিষয় জানা সহজতর হয়ে এসেছে। যদিও ইতিহাসকে সময়ের বা যুগের প্রসঙ্গে অনেক ভাগে ভাগ করা হয় যথা আধুনিক বা সা¤প্রতিক বা কনটেম্পোরারি, যথা মধ্যযুগীয় বা মিডাইভেল, যথা প্রাচীন বা এনশিয়েন্ট। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবন ব্যাপ্ত ছিল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দ, ৬৩ বছর। এর মধ্যে প্রথম ৪০ বছর তিনি জীবন যাপন করেছেন এবং ব্যস্ত ছিলেন মক্কা নগরীতে। তৎকালীন মক্কা নগরী গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। মক্কার মানুষ মূর্তি পূজা করতো এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য যে, সমগ্র আরবের উপাসনার কেন্দ্রীয় নগরী ছিল মক্কা। এটাও সত্য যে, মক্কার মানুষ সচেতন ইতিহাসপ্রেমিক এবং সাহিত্যপ্রেমিক ছিল। ৪০ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন এবং এর পরবর্তী ১৩ বছর মক্কাতেই কাটান। ইতিহাসবান্ধব পরিবেশে, সাহিত্যবান্ধব পরিবেশে মহানবী (সা:) এর জীবনের প্রথম ৫৩ বছর কাটে। তাই তাঁর মক্কা-জীবনের পূঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড বা বর্ণনা বা স্বাক্ষ্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জীবিত আছে। ৫৩ বছর বয়সে, নবুয়তের ১৩তম বছরে মহানবী (সা:) মদীনায় হিজরত করেন। এই ঘটনাটি ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরানো একটি ঘটনা। এই ঘটনাটিকে এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলিকে দুইটি স¤প্রদায় আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করেন; প্রথম স¤প্রদায় হলো মক্কাবাসী অবিশ্বাসীগণ এবং দ্বিতীয় স¤প্রদায় হলেন মদীনার অরিজিনাল অধিবাসীগণ, যাদের মধ্যে গিয়ে মহানবী (সা:) স্থিত হলেন। দুইটি স¤প্রদায়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন। মক্কার মানুষদের উদ্দেশ্য ছিল মুহাম্মদ (সা:)কে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেন তিনি মক্কার প্রতি হুমকি হতে না পারেন বা হুমকি হতে চেষ্টা করলেও তাঁকে দমন করা যায়। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি তাদের উদ্দেশ্য ছিল অনেকটা এরকম যে, মানুষটি ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে এবং কী করে দেখি। মদিনা জীবনের চার-পাঁচ বছরের মাথায় তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্য এবং রোমান সাম্রাজ্য, মদিনায় বিকাশমান নতুন রাষ্ট্রের প্রতি দ্রষ্টি দেয়। অতএব সেই সময় থেকে তিনটি ভিন্ন স¤প্রদায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। এই জন্যই বিনা দ্বিধায়, বিনা বিতর্কে কথাটি স্বীকৃত যে, মহানবী (সা:)-এর জীবন ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ আলোকেই যাপিত হয়েছিল। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে, তাঁর জীবনী জানা ভীষণ কঠিন কোনো কাজ নয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সচেতন বা শিক্ষিত মানুষ জানতে পারছেন বলেই, মানুষ সেই কর্মময় জীবন দ্বারা উৎসাহিত হচ্ছেন; সেই মহান ব্যক্তি দ্বারা প্রচারিত জীবন দর্শন দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছেন। সেইরূপ উৎসাহ এবং প্রভাবের কারণেই, প্রচুর সংখ্যক মানুষ দ্বীন ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। অতএব, আমরা যারা অটোমেটিক্যালি দ্বীন ইসলামে প্রবিষ্ট আছি, আমাদের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, মহানবী (সা:)-এর জীবন ও কর্ম জানতে চেষ্টা করা, তাঁর জীবনের কর্মগুলোকে মূল্যায়ন করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া।
২০০২ সালে ঢাকা মহানগরে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল; সেটার পূর্ণ নাম ‘ইনিসটিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড প্রোপাগেশন অফ দি টিচিংস অফ হজরত মুহাম্মদ (সা:)’। সংক্ষিপ্ত নাম হলো ইনিসটিটিউট অফ হজরত মুহাম্মদ (সা:)। পূর্ণ নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ‘হজরত মুহাম্মদ (সা:)-এর জীবনের শিক্ষাগুলোর গবেষণা ও প্রচারের ইনিসটিটিউট। প্রতিষ্ঠার প্রথম আড়াই বছর, আমি এটির প্রেসিডেন্ট বা সভাপতি ছিলাম। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থ এটা বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ার পেছনে যিনি সবচেয়ে উদ্যমী, উৎসাহী এবং নির্বাহী ছিলেন তার নাম আহমদ শফি মাকসুদ। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এত জড়িত ছিলেন এবং আছেন। আমি একজন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যাওয়ার সুবাদে, ইনিসটিটিউটের নিয়মিত কার্যক্রম থেকে দূরত্বে এসে গেছি, যদিও আন্তরিক আনুগত্য রয়েছে। উদাহরণটি দিলাম এই জন্য, আমাদেরকে সুনির্দিষ্টভাবেই তথা পরিকল্পনা করেই মহানবী (সা:)-এর জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিক প্রথমে নিজেরা জানতে হবে, অতঃপর অন্যদেরকে জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আজকের কলাম শেষ করার পূর্বে, একটি সাবধান বাণী উপস্থাপন করছি। সাবধান বাণীটি হলো, ইন্টারনেটের লেখকগণ সম্বন্ধে, উইকিপিডিয়ায় লেখকগণ সম্বন্ধে। উপযুক্ত জহুরি ছাড়া যেমন মনি মুক্তা চেনা মুশকিল তেমনই হৃদয়ে সঠিক জ্ঞান ও ভালোবাসা না থাকলে, অথেনটিক লেখকের লেখা আইডেনটিফাই বা চিহ্নিতকরণ করাটাও দুষ্কর। বিধর্মীগণ বা মুসলিম বিদ্বেষীগণ, নিজ নামে বা মুসলমান নাম নিয়ে রচনা লেখেন এবং উপস্থাপন করেন। লেখা বা উপস্থাপন করাটা অপরাধ নয়; অপরাধ হলো ভুল তথ্য, ভুল রেফারেন্স, ভুল অনুবাদ, ভুল ব্যাখ্যা বা তীর্যক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা। ইন্টারনেটে, মুসলিম বিদ্বেষী, মুসলিম ইতিহাস বিদ্বেষী, মুসলিম সংস্কৃতি বিদ্বেষী, কুরআন বিদ্বেষী, রাসূল বিদ্বেষী, ন্যায় ও সত্য বিদ্বেষী এবং জ্ঞান অর্জন বিদ্বেষী ব্যক্তিগণ ভুল তথ্য ও অপব্যাখ্যা মিষ্টি মিষ্টি কথার আবরণে উপস্থাপন করেন। সঙ্কট বা সমস্যাটি হলো এইরূপ ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা সকলের জন্য সহজ নয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।