বিশ্ব নবী সা: এবং যুব সমাজ
জ্ঞানে প্রবীণ এবং মৃত্যু ভয়ে ভীত বয়োবৃদ্ধদের হৃদয়ে ধর্মের আবেদন গভীরতর। এটা তিন হাজার বছর
ইন্টারনেট সার্চ করতে গিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম। একটা ব্যঙ্গচিত্র ‘ক্রাইমস অব মুহাম্মদ’ হেইডে একটা শুয়রের ছবি। তার গায়ে স্পষ্ট লেখা আরবি ও ইংরেজিতে ‘মুহাম্মদ’। আর শুয়রের পা একটা বইয়ের উপর যাতে লেখা আরবি ও ইংরেজিতে ‘কুরআন’। নবী (সা:)- ও কুরআনকে সমালোচনা করলেও তা তো হওয়া উচিত যৌক্তিক ও শালীনতা সম্পন্ন। ঘৃণা ও ব্যঙ্গ তো কোনো যুক্তি হলো না। নবী (সা:), কুরআন, ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি এত ঘৃণা প্রকাশ করার পরও মুসলমানদের উপরই আঘাত আসছে। মিয়ানমারের আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একটা তথ্য অনুযায়ী, শতকরা পঁচাত্তর ভাগ আরাকানি মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা জড়িত। আর নারী, শিশু ও পুরুষদের তো হত্যা করা হয়েছে, জ্বলন্ত আগুনেও পুড়িয়েও মারা হয়েছে। ঘরবাড়ি তো আগুনে নিঃশেষ করা হয়েছেই। এখনো নির্যাতন করা হচ্ছে। ইন্ডিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া অসম্ভবপর হতে পারে। মিয়ানমার মুসলিমশূন্য হতে চলেছে।
মুসলমান বিদ্বানরা গৌতম বুদ্ধকে গবেষণার মাধ্যমে অতি উচ্চ স্থান দিয়েছেন। কেউ কেউ তো বলেই ফেলেছেন যে, তিনি তো এক নবীর মতো জীবন ও বাণী রেখে গেছেন। তিনিই কি তবে কুরআনে বর্ণিত ‘জুল কিফল’ কিফলের অধিবাসী। উল্লেখ্য যে, আরবি বর্ণমালায় ‘প’ উচ্চারণ নেই। তাই ‘কিফল’ কি ‘কপিল’- ‘কপিলাবস্তু’? আল্লাহই ভালো জানেন। মুসলমানরা গৌতম বুদ্ধ, যীশুখ্রিষ্ট হজরত ইব্রাহিম (সা:), হজরত মুসা (আ:) প্রমুখ সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা রাখে। তবু এই জুলুম ও মানসিকতা কেন হজরত মুহাম্মদ (সা:) ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি? তথ্যে প্রকাশ, মিয়ানমারের বৌদ্ধ সেনাবাহিনী ইসরাইলের ইহুদি সেনাবাহিনীর ট্রেনিং নিয়ে এসেছে কিভাবে মুসলমান বিতাড়ন করা যায়। এদিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো আশানুরূপ ঐক্য দেখাতে না পারার ফলে দ্রæত এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
ইন্টারনেট সার্চ করলে নিম্নলিখিত বিষয় পাওয়া যাচ্ছে : ‘ক্রাইমস অব মুহাম্মদ’, ‘ডার্ক সাইট অব প্রফেট মুহাম্মদ’, ‘ক্রিটিসিজম অব প্রফেট মুহাম্মদ’। অবশ্য ‘প্রেইজ অব মুহাম্মদ’ নামেও তথ্য রয়েছে যা সুখপাঠ্য।
কেন হজরত মুহাম্মদ (সা:) কে নিয়ে এই নীতি বিগর্হিত প্রচারণা? কারণ সুস্পষ্ট। যদি মুসলমানদের মাথাটাই নির্মূল করা যায়, তাহলে তাদের দেহটা বেকার হবে। বিরুদ্ধবাদীরা নবী (সা:)-এর তথাকথিত ‘ডার্ক সাইড’ (কৃষ্ণ অধ্যায়) দেখল, বাকিটা দেখল না। এভাবে দেখলে তো পৃথিবীর বহু মহারথী কুপোকাত হয়ে পড়বেন?
নবী (সা:) ধর্মীয় সংঘাত এড়াতে নিজের দেশ ছাড়লেন। যখন সেখানেও বিধর্মীরা তাকে হত্যা করতে গেল, তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। আল্লাহ তাকে কথা দেন যে, তাঁকে তাঁর দেশে ফিরিয়ে আনা হবে, তাকে সামরিক ও ধর্মীয় বিজয় প্রদান করা হবে। এমনকি তিনি শূন্য হাতে শুরু করে সমগ্র আরবের শাসক, বাদশাহ হয়েছিলেন। তবে তার প্রাসাদ শুধু পর্নোকুটির, যেখানে চুলোতে মাসেও আগুন জ্বলত না। গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি এর চেয়ে উন্নততর ছিল?
প্রখ্যাত ফরাসি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক লামারটাইন মন্তব্য করেন, “যদি উদ্দেশ্যের মহত্ব, শক্তির অপ্রতুলতা এবং আশাতীত ফল লাভ করার মধ্যে মানবীয় প্রতিভার তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে, আমরা বর্তমান বিশ্বের ইতিহাসের যে কোনো মহাপুরুষকে মুহাম্মদ (সা:)-এর সাথে তুলনা করতে সাহস পাই কি? প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ শুধু অস্ত্রশস্ত্র, আইন এবং সাম্রাজ্যসমূহ গঠন করেছিলেন। তারা যদি কোনো কিছু গঠন করে থাকেন, তা জড় (বৈষয়িক) শক্তিছাড়া আর কিছু নয়, তাও কখনো কখনো তাদের চোখের সামনে ধসে পড়ে। এই ব্যক্তি (নবী সা:) শুধু সৈন্য পরিচালনা, আইন-প্রণয়ন, সাম্রাজ্য গঠন, জাতি ও শাসক-বংশসমূহ গঠন করেননি, তিনি পরিচালনা করেছেন লাখ লাখ মানুষকে। সে সময়কার বসতিপূর্ণ পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ এলাকাতে। তা ছাড়াও তিনি ধর্মের বেদীসমূহ, পূজা শক্তিসমূহ, ধর্মসমূহ ও ধারণাসমূহ, বিশ্বাসসমূহ এবং আত্মাসমূহ- সব কিছুই পালটিয়েছেন ...।
দার্শনিক, সুবক্তা, স্বর্গীয়দূত, আইন প্রণয়নকারী, যোদ্ধা, ধারণাসমূহ বশীভূতকারী, যুক্তিপূর্ণ মতবাদ, মূর্তিবিহীন ধর্মীয় প্রথার পুন:সংস্থাপনকারী, ২০টি আঞ্চলিক সাম্রাজ্যের এবং একটি আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা- এই ছিলেন মুহাম্মদ (সা:) যা দিয়ে মানবীয় মহত্তে¡র পরিমাপ করা চলে, তার সকল মানের বিচারেই আমরা যর্থাথই এই প্রশ্ন করতে পারি, মুহাম্মদ (সা:)-এর চাইতে মহত্তে¡র কোনো ব্যক্তি কি আছেন?” (‘হিস্টরি ডি লা তুর্কি’, প্যারিস, খন্ড-২, পৃ. ২৭৬-২৭৭)।
শুধু ইউরোপের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীরা নন, এই উপমহাদেশের অমুসলিম ব্যক্তিত্বের অনেকও নবী (সা:) ও ইসলাম নিয়ে সম্মানের সঙ্গে কথা বলেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুদের নিকট খুবই প্রিয়। তিনি অন্য ধর্মের হয়েও চমৎকার মন্তব্য করেছেন, “মুহাম্মদ (সা:) তাঁর জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন যে, মুসলমানদের ভেতর থাকবে আদর্শ সমতা ও ভ্রাতৃত্ব। প্রশ্ন উঠবে না রেস (বংশ), বর্ণ, ক্রিড (ধর্মমত) ও লিঙ্গ নিয়ে। তুরস্কের সুলতান আফ্রিকার বাজার থেকে একজন নিগ্রো খরিদ করতে পারেন এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তুরস্কে নিতে পারেন। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয়, তার যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতা থাকে, সে সুলতানের মেয়েকে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে। এটা তুলনা করুন যেভাবে কৃষ্ণকায় নিগ্রো ও আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে এই দেশে (যুক্তরাষ্ট্র) ব্যবহার করা হয়। আর হিন্দুরা কি করে? যদি আপনাদের কোনো ধর্ম প্রচারক হঠাৎ গোঁড়া কোনো হিন্দুর খাদ্য স্পর্শ করে, সে তা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আমাদের মহান দর্শন সত্তে¡ও আপনারা আমাদের কার্যাবলিতে ত্রæটি লক্ষ্য করবেন। কিন্তু আপনারা দেখবেন, অন্য জাতিসমূহের তুলনায় মুসলমানদের মহত্ত¡, যাতে রয়েছে সমতা; আদর্শ সমতা; রেস (বংশ) বা বর্ণ যাই হোক।”
(সূত্র: কমপ্লিট ওয়ার্কস অব স্বামী বিবেকানন্দ, খন্ড চার, লেকচারস এন্ড ডিসকোর্সেস : দ্য গ্রেট টিচারস অব দ্য ওয়ার্লড, শেকসপিয়র ক্লাব, প্যাসাডেনা, ক্যালিফোর্নিয়াতে ৩ ফেব্রæয়ারি, ১৯০০ সালে প্রদত্ত)।
স্বামী বিবেকানন্দ আরো বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, বাস্তববাদী ইসলামের সাহায্য ছাড়া বেদান্ত, তত্ত¡¡সমূহ যত চমৎকার ও আশ্চর্যজনক হোক, পুরাপুরি মূল্যহীন মানব জাতির বিশাল সংখ্যার নিকট। ... আমাদের মাতৃভ‚মির জন্য দুইটা বড় ব্যবস্থা, হিন্দুত্ব ও ইসলাম- বেদান্ত মস্তিষ্ক ও ইসলামী দেহ- এই হলো একমাত্র আশা।”
(সূত্র : দ্য কমপ্লিট ওয়ার্ক অব স্বামী বিবেকানন্দ, খন্ড ছয়)।
স্বামী বিবেকানন্দ নবী (সা:) ও ইসলাম সম্পর্কে কিছু ভালো কথা বলেছেন। তিনি ইসলামকে ধ্বংস করার কথা বলেন নাই, বরঞ্চ যুক্তরাষ্ট্রেও হিন্দুদের নিকট ইসলামের মহত্ত¡ই তুলে ধরেছেন। মুসলমানরা অবশ্য আগে থেকেই উদার- কারণ কুরআন বলে, ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। তবে ইসলাম অন্য কোনো মতবাদের সঙ্গে পারতপক্ষে মিশ্রিত হতে চায় না। কিন্তু উদারতা, সহনশীলতার কোনো কমতি নেই ইসলামে। অন্য ধর্ম বা তার অনুসারীদেরকে জোর করে নাস্তানাবুদ করার পক্ষে ইসলাম নয়। এটা খ্রিষ্টবাদ করেছে ইনকুইজিশনের মাধ্যমে। অন্যরাও অন্যভাবে।
আল্লাহ ও তার নবী (সা:)-এর নির্দেশ হলো মুসলমানদের একতাবদ্ধ থাকা। নেতারা কি তাই করছেন? আধুনিক যুগের মুসলিম নেতারা কি পথভ্রষ্ট? মুসলিম বিশ্বের, বিশেষ করে আরবদের দিকে তাকালে তাই মনে হয়। এরা প্রথমে ব্রিটিশদের ডেকে এনে ফিলিস্তিন তুলে দিলো তাদের হাতে। ব্রিটিশরা বেলফুর ঘোষণা বাস্তবায়ন করে ফিলিস্তিন ইহুদিদের দিলো। হালে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গোপনে ইসরাইলকে পরামর্শ দিলো হামাস- হেজবুল্লাহকে ঠেঙ্গাতে। এখন দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলের পরামর্শে সউদী আরব ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে বলেছে ইসরাইলের কথা মানতে। মিসরের প্রেসিডেন্ট জেনারেল সিসি, যিনি ইহুদি মাতার পুত্র, আগে থেকেই ইসরাইলভক্ত। আল আকসা মসজিদ মুক্ত করা যেখানে মুসলমানদের উপর ওয়াজেব হয়ে গেছে, এখন তো ইসরাইল দুই পবিত্র মসজিদের খাদেমের কাঁধে চেপে বসেছে। সাদ্দাম হোসেন ইরানকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজেই পরপারে চলে গেলেন। এখন ইসরাইল-সউদী-মিসর কোয়ালিশন ইরান ধ্বংসে মেতে উঠেছে। এই কি নবী (সা:)-এর শিক্ষা ও বাণীর বাস্তবায়ন? ইহুদিদের হাতে শেষ যুগে যে মুসলিম এলাকাগুলোর পতন হবে, তারই কি ইঙ্গিত এসব?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার লরেন্স অব এরাবিয়া এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে, যা পরবর্তীতে অবমুক্ত হয়ে, মন্তব্য করেন জানুয়ারি ১৯১৬ :
“আরব বিদ্রোহ (তুর্কিদের বিরুদ্ধে) আমাদের (অর্থাৎ ব্রিটিশের) জন্য মঙ্গলজনক, কারণ আমাদের আশু লক্ষ্যের সঙ্গে এটা সঙ্গতিপূর্ণ যা হলো ইসলামী ‘বøক’কে টুকরা টুকরা করা এবং উসমানি-তুর্কি সাম্রাজ্যের পতন ও ধ্বংস। আর কারণ হলো এর ফলে (মক্কার শরিফ হোসেন প্রমুখের) যে সব রাষ্ট্রের আবির্ভাব হবে, তুর্কিদের পরিবর্তে আমাদের জন্য সেগুলো ক্ষতিজনক হবে না। আরবরা তো তুর্কিদের চেয়ে কম স্থিতিশীল। যদি ঠিকমতো পরিচালনা করা হয়, এই আরব রাষ্ট্রগুলো হবে রাজনৈতিক মোজাইক কাচের মতো, অথবা পাতলা টিস্যু কাগজের মতো, ছোট ছোট ঈর্ষান্বিত আমিরাতসমূহ যাদের থাকবে না যোগ্যতা এক হওয়ার।”
একেবারে মোক্ষম কথাই বলেছেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার। পরিণতিতে ইসরাইল ছড়ি ঘুরাচ্ছে ফিলিস্তিন, মিসর, সউদী আরবসহ সমগ্র আরব মুলুকে। নবী (সা:)-এর শিক্ষা তাদের ভেতর থাকলে তাদের এই অমর্যাদাকর অবস্থা হতো না। আজ বিশ্ব নবী (সা:)-এর পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে পড়েছে। আর মুসলমানরা নবী (সা:)-এর শিক্ষা ও আদর্শ বাণী পালন না করে অপমানের সম্মুখীন হয়েছে।
লেখক : ইতিহাসবিদ ও গবেষক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।