Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুল জীবন ও সৃষ্টিতে আমাদের শেষ নবী

শেখ দরবার আলম | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

\ এক \

আমাদের প্রিয় নবী আখেরি নবী যখন এই দুনিয়াতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের মধ্যে আসেন, সেই দেড় হাজার বছর আগে পরিবেশ-পরিস্থিতি একরকম ছিল না। আর এখন থেকে এক শ’ সতেরো-আঠারো বছর আগে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যখন আবির্ভাব হয়, তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি ছিল আরেক রকম। আর এখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি হয়ে গেছে সম্পূর্ণ অন্যরকম।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সময়কার পরিবেশ-পরিস্থিতির কথাটাই আগেই উল্লেখ করি!
কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন সেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জনসাধারণ ইংরেজদের জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে সম্মানজনক জীবিকার এবং সম্মানজনক জীবিকার্জনের সহায়ক শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিলেন অধিকারবঞ্চিত। সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের পাঁচ বছর আগে শেরে বাংলা আবুল কাসেম ফজলুল হক যখন অবিভক্ত মুসলিম প্রধান বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তখনো এ. আ. পি., সিভিক গার্ডের মতো যে সব চাকরিতে লেখাপড়া জানার বিশেষ দরকার হতো না, সেসব চাকরি-বাকরি পাঁচ শতাংশও মুসলমানও পাচ্ছিলেন না। ১৮৭১-এ প্রকাশিত ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার অফিস-আদালতে দু-একটা পিয়ন ও চাপরাশি ছাড়া কোনো মুসলমান চাকরিতে ছিলেন না। মুসলমানদের চাকরির ব্যাপারে আমি যে সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের পাঁচ বছর আগের খবরটা দিয়েছি, সেটা আছে ২৩ জুলাই ১৯৪২ তারিখের ইংরেজি দৈনিক ‘স্টার অব ইন্ডিয়া’-র পঞ্চম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় কলামে। এই খবরটা দেখে সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের আগের মুসলমানদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে।
মুসলমান সমাজ তখনো ছিল হতদরিদ্র ও অশিক্ষিত প্রধান, অসচেতন ও অসংগঠিত একটা সমাজহীন সমাজ। তৌহিদবাদী মুসলমানদের, আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী মুসলমানদের, আল্লাহর ওয়ারনেসে বিশ্বাসী মুসলমানদের কোনো জাতীয়তাবাদ থাকতে নেই বলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের কোনো জাতীয়তাবাদ তখন ছিল না। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদও নয়।
কোনো ধর্মনিরপেক্ষতাও তখন ছিল না। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা তখন কামনা করতেন অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থান। সে কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগেরও দাবি ১৯৪৭-এর ২ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউনব্যাটেনকে বাধ্য না করা পর্যন্ত ছিল সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের কনস্টিটিউশনাল গ্যারান্টি অর্থাৎ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি সাক্ষ্য দেয় যে, তিনিও ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই সাম্য ও সহাবস্থানকামী মানুষ। তার অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবং তিনি সবার কবি হতে চেয়েছিলেন বলে সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হওয়ার সুযোগ তাঁর হয়নি ঠিকই। কিন্তু মুসলমানদের দাবির সঙ্গে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দাবির সঙ্গে তাঁর চিন্তা-ভাবনার কোনো বিরোধ ছিল না। মুসলমানদের চাকরি-বাকরি সংরক্ষণের দাবি এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভায় আসন সংরক্ষণের দাবি তাঁর কাছে কখনো অসঙ্গত ও অযৌক্তিক মনে হয়নি। দল-মত নির্বিশেষে মুসলিম তরুণদের ওপর এবং মুসলিম নেতাদের অন্তত বেশির ভাগের ওপর তাঁর যে প্রভাব ছিল, সে প্রমাণ তাঁর সে সময়কার লেখা থেকেই পাওয়া যায়। তাঁর জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় অন্তত মুসলিমপ্রধান বাংলায় নজরুল কারো চেয়ে কম জনপ্রিয় ছিলেন না। তবে মানুষ তাকে কবি হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন; রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়। ১৯২৯-এর পর নজরুল নিজেও কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। সম্ভাবত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনৈতিক সংগঠন করার মানুষিক যোগ্যতা তার নেই। রাজনৈতিক সংগঠন করার জন্য অন্যরকম মানসিকতা দরকার হতো।
সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের আগে সে সময়ে মুসলমান ঘরের সন্তানরা মুসলমান পরিচয় নিয়েই বাঁচতেন। তাঁর জীবদ্দশায় সুস্থাবস্থায় নজরুলও বাঁচতে চেয়েছেন আল্লাহর বান্দা এবং নবীর উম্মত হিসেবে। মুসলমানদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের, ইসলামি সংস্কৃতির পরম্পরার এবং মুসলিম জাতিসত্তার আশ্রয়েই তিনি বাঁচতে চেয়েছেন।
\ দুই \
কিন্তু সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের নব্বই শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হিন্দু সমাজপ্রধান স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা তাদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্তে¡র কর্মসূচির মুখে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উভয়দিক দিয়েই অনেক মুসিবতে আছেন। সেটা উগ্রধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকামী এবং উগ্রধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোপকামী আরএসএসের শাখা সংগঠন বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়েছে।
অন্যদিকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের ১০ শতাংশ জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত মুসলিমপ্রধান দেশের মুসলমানরা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের, অঞ্চলভিত্তিক জাতীয়তাবাদের এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবে পড়েছেন। এই পরিবেশ-পরিস্থিতিতে লেখাপড়া জানা লোকদের মধ্যে যাদের শৈশব, বাল্য, কৈশোর ও প্রথম যৌবন অতিবাহিত হয়েছে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এখন আর তাদের মুসলিম পরিচয় ধারণ করেন না। এদের অনেকেই এ দেশে অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। দেশে মসজিদ যতই বাড়–ক, এদের সংখ্যাও বাড়ছে। এদের কারো কারো বক্তব্য লক্ষ্য করা যাক :
\ তিন \
অধ্যাপক ডক্টর গোলাম মুর্শিদের বক্তব্য : কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিমিটেডের জানুয়ারি-মার্চ ২০১৭-র ‘বইয়ের দেশ’-এ দেখছি, হর্ষ দত্তের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্বনামধন্য সাবেক অধ্যাপক ডক্টর গোলাম মুর্শিদ বলেছেন :
‘প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আমি একজন মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। দেখি-ও। এর বাইরে আমার আরেকটা পরিচয় আছে, বাংলা আমার মাতৃভাষা এবং সেই সুবাদে আমি ‘বাঙালি’। কোনো রাষ্ট্রীয় অথবা রাজনৈতিক পরিচয়ে আমি চিহ্নিত হতে চাই না।’
অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামানের বক্তব্য : জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৭’র ‘বইয়ের দেশ’-এ দেখছি, দেবব্রত বন্দোপাধ্যায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান বলেছেন :
‘আমি নিজেকে উদারনৈতিক এবং একই সঙ্গে বাঙালি ও বিশ্ববাসী বলে মনে করি।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখ মঙ্গলবারের ঢাকার বহুল প্রচারিত দৈনিক কাগজ ‘প্রথম আলো’র সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার বিষয়ে সাংবাদিক সোহরাব হাসানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সহ-সভাপতি হুমায়ুন কবীর বলেছেন :
‘বাংলাদেশের সমাজে নাগরিক বা সিভিক জাতীয়তাবাদকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকা সত্তে¡ও সামাজিকবোধ ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।’
যাদের বক্তব্য পেশ করলাম, এরা সবাই অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্তত কৈশোর থেকে তাদের মানসিক গঠনের কাজটা হয়েছে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্টের পর থেকে। এদের বক্তব্য পড়ে বুঝার চেষ্টা করা দরকার যে, এরা তাদের মুসলিম পরিচয়ের উত্তরাধিকার ধারণ করেন কি-না। আমি বুঝার চেষ্টা করি। আমার মনে পড়ে, বিশেষ করে যখন আমার কাছ থেকে কোনো পত্রিকার জন্য ইসলাম সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে লেখা চাওয়া হয়। তখন আমার কাছে পরিবেশ-পরিস্থিতির এরকম অনেক কিছু অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক মনে হয়।
\ চার \
আমার শৈশব, বাল্য এবং কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে আমাদের প্রতিবেশী বড় জাতীয়তাবাদী সমাজপ্রধান স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙলাভাষী হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী হিন্দুরা সেখানে নিজেদেরকেই কেবল বাঙালি, হিন্দু এবং ভারতীয় বলেন। বাঙলাভাষী সংখ্যালঘু মুসলমানদের তারা কেবল মুসলমানই বলেন। সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের পর আমি সেখানে মুসলামান হিসেবেই বড় হয়েছি, বাঙালি হিসেবে নয়। ওখানকার ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদীদের কাছে এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোপকামীদের কাছে বাঙালিত্ব, হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব সমার্থক। দুর্গাপূজা তাদের কাছে বাঙালির উৎসব। আর এটাই যখন বাস্তবতা, তখন আমি বাঙালি হবো কীভাবে?
২৭ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৯, এই ঠিকানাস্থিত পুস্তক বিপণি থেকে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১-এ প্রকাশিত সুজিত সেন সম্পাদিত ‘সাম্প্রদায়িকতা : সমস্যা ও উত্তরণ’ শীর্ষক গ্রন্থের ‘মুসলমান বাঙালির কালচার’ শিরোনামের নিবন্ধে ১২২ পৃষ্ঠায় গোপাল হালদার লিখেছেন :
‘হিন্দু ঐতিহ্যের ওপর গঠিত বাঙালি সংস্কৃতি। ....মানবতাবাদ হিন্দুত্বের কাঠামোর মধ্যে বাঁধা পড়ে না।’
\ পাঁচ \
সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের আগে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলার, মুসলমানরা মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলার বিভাজন রোধ করতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন অবিভক্ত মুসলিমপ্রধান বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি শেষ পর্যন্ত শরৎ বসুদের সঙ্গে চুক্তি করে এই বিভাজন ঠেকানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। শরৎ বসু সেই সময় মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে এ বিষয়ে কিছুদিন যাবত পত্রালাপ করেছিলেন। শরৎ বসুর ২৩ মে ১৯৪৭ তারিখের চিঠির জবাবে ২৪ মে ১৯৪৭ তারিখে বিহারে পাটনা থেকে গুজরাটী ভাষী মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাংলাকে অখন্ডিত রাখার একটা শর্ত তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোপকামী সমাজের তরফে তার দেয়া শর্ত প্রসঙ্গে একপর্যায়ে তার কথা এভাবে উল্লেখ করেছিলেন :
“খসড়াতে এমন কিছু নেই যার থেকে মনে করা যেতে পারে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কিছু করা যাবে না। প্রত্যেক আইনের জন্য কার্যনির্বাহীদের এবং আইনসভার হিন্দু সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকতে হবে। খসড়া চুক্তিতে এ স্বীকৃতি থাকতে হবে যে, বাঙলার একটি সাধারণ সংস্কৃতি আছে এবং তার মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা।”
মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী গুজরাটের লোক। গুজরাটী ভাষা তার মাতৃভাষা। সেই তিনিই বাংলাভাষী শরৎ বসুকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন: ‘খসড়াচুক্তিতে এ স্বীকৃতি থাকতে হবে যে, বাংলার একটি সাধারণ সংস্কৃতি আছে এবং তার মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা।’
মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর এই বক্তব্যটা উপলব্ধি করতে হলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ তারিখে বোম্বেতে তার মালাবার হিলসের বাড়িতে আলোচনাকালে এবং ওদিনই সন্ধ্যায় তাকে লেখা তার চিঠির বক্তব্য স্মরণ করতে হবে। মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বোম্বেতে ওদিন তার থাকার জায়গায় ফিরে সন্ধ্যায় কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে চিঠিতে লিখিছিলেন :
“আলোচনাকালে আপনি অত্যন্ত আবেগের সাথে ওকালতি করেছেন যে, ভারতে হিন্দু ও মুসলমান, দুটো জাতি আছে। ভারত হিন্দুদের মতো মুসলমানদেরও আবাসভ‚মি। আপনার যুক্তি যত বেশি এগিয়ে যাচ্ছিল, আপনার ছবিটা আমার কাছে তত বেশি শঙ্কাজনক মনে হচ্ছিল।...ইতিহাসে এমন কোনো নজির নেই যে, ধর্মান্তরিতরা এবং তাদের বংশধররা তাদের মাতৃ-পিতৃক‚ল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একটা জাতি বলে দাবি করেন। ইসলাম আসার আগে ভারতীয়রা ছিল একজাতি, তাদের সন্তানদের একটা বড় অংশ ধর্মান্তরিত হওয়ার পরও একজাতিই থাকবে।”
\ ছয় \
মুসলমানদের স্মরণীয় বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস উপলক্ষে দৈনিক ইনকিলাবের তরফে আমাকে যখন লিখতে বলা হয়, তখন ভারতীয় উপমহাদেশের আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ কায়েম করার লক্ষ্যেই যে, সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের বিভাজনটা ঘটানো হয়েছিল, এ রকম তারিখ তথ্যভিত্তিক সব কথা মনে পড়ে।
সাতচল্লিশের ১৪ আগস্ট থেকে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ১০ শতাংশের মতো জায়গায় সাময়িকভাবে (অর্থাৎ এরপরও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের আলাদা কোনো জাতি হিসেবে স্বীকার না করার একতরফা শর্তে) যে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করা হয়েছিল সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্ত¡া সংশ্লিষ্ট কোনো সাহিত্য সঙ্গীত পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অবশ্য পাঠ্য ছিল কেবল হিন্দু সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্ত¡া সংশ্লিষ্ট সাহিত্য-সঙ্গীত। “বৈষ্ণব পদাবলী” এবং “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” ও অবশ্যপাঠ্য ছিল। কিন্তু সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সঙ্গীতও অবশ্য পাঠ্য ছিল না। আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ১৭৫৭’র ২৩ জুনের পলাশীর ষড়যন্ত্রমূলক যুদ্ধ যুদ্ধ প্রহসনের সময় থেকে ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত (অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের ভারত বিভাগের সময় পর্যন্ত), এই একশ’ নব্বই বছরের ইতিহাসেও ভারতীয় উপমহাদেশের ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠ্য ছিল না। কেন ছিল না এটা আমরা কখনো খতিয়ে দেখি না। মুসলমানদের কোনো স্মরণীয় দিবস উপলক্ষে লেখার সময় এসব আমার মনে পড়ে। সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টি বিষয়ক পড়াশোনার এবং লেখালেখির সময়ও এ সব আমার মনে পড়ে। এ সব এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। কিন্তু দেখি এ সব এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব আমাকে খুব খষ্ট দেয়। আমার মনে হয়, তা হলে আমাকে ইসলাম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লিখতে বলা হয় কেন?
\ সাত \
সাম্য ও সহাবস্থানের কবি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কেবল মুসলমানের কবি নন, তার জীবন ও সৃষ্টিতে সব ধর্মীয় সমাজের মানুষের কবি হতে চেয়েছিলেন। তিনি তা হয়েছিলেনও। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, ইসলাম কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, সব মানুষের জন্যই এসেছে। সেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের সহযোগী সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীর লোক হিসেবে ভাতরীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের বাংলাভাষী বড় বড় কবি সাহিত্যকরা মুসলমানদেরকে তাদের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্তে¡র প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের ও ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্ত¡ার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন।
অন্য দিকে নজরুল কিন্তু ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করে নয়। অর্থনৈতিক সাম্য, সামাজিক সাম্য ও বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আইনগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের নীতিতে।
কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের প্রতিপক্ষ ও শত্রু হিসেবে শনাক্ত করার কোন সংস্থান নেই। সমস্যা হয় তখনি, যখন কোনো জনগোষ্ঠীকে “উচ্চতর স্তরের সুবিধা ভোগ” করার লোক দেখিয়ে জাতীয়তাবাদী এবং একজাতিতত্ত¡ আরোপকামী করা হয়।
ইসলামের সাম্য ও সহাবস্থানকামী জীবন ব্যবস্থা নজরুলকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। যখন যে পরিবেশ পরিস্থিতিতেই তিনি থাকুন না কেন, তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করতেন যে, তিনি কেবলমাত্র আল্লাহর বান্দা এবং শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মত। আমাদের শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন তাঁর কাছে সব চেয়ে বড় আদর্শ মানুষ। তাই তাঁর জীবনী ‘মরুভাস্কর’ শিরোনামে প্রথমে কাব্যে অনেকখানি লিখেছিলেন। শেষ নবী হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে অজস্র কবিতা গান তো লিখেছিলেনই। পরে গদ্যে লিখেছিলেন ‘বিশ্বনবী’ শিরোনামে। বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা এবং চিন্তা-ভাবনা করেই এ বিষয়ে লিখছি। এই ‘বিশ্বনবী’ আর একজন কবি ছাপার ব্যবস্থা করতে নিয়ে গিয়ে ১৯৪২-এর অক্টোবরে কবি কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার সময় নিজের নামে ছেপে নিয়ে সাতচল্লিশের মধ্য-আগস্টের পর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশে নজরুলের প্রতি মিথ্যা নিন্দা-অপবাদ এবং কুৎস্যা রটিয়ে নজরুলচর্চার পথ আর একদিক দিয়ে রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন।
লেখক : নজরুল গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন