Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অনুপম আদর্শ প্রিয়নবী (সা:)

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম | প্রকাশের সময় : ১ ডিসেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরিফ আনেন সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য, সমগ্র বিশ্বজগতের কল্যাণের জন্য। মূলত তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তামাম কায়েনাত-সমগ্র সৃষ্টির সূচনা করেন। নূরে মুজাসসামের মাটির পৃথিবীতে আশরাফুল মাখলুকাত মানব সুরতে তশরিফ আনার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটে। তাঁর নূর মুবারক সৃষ্টি করে আল্লাহ জাল্লা শানুহু সৃষ্টির সূচনা করেন। মূলত তাঁর নূর মুবারকই সমগ্র সৃষ্টির উৎস। তাঁর থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন খালিক-মালিক আল্লাহ। তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন- বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তাঁর মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ-অনুপম আদর্শ। কবি শেখ সাদী (র.)-এর ভাষায়: ‘হাসুনাত জামি’উ খিসালিহি’। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে অনুপম আদর্শ”। (সূরা আহ্জাব : আয়াত ২১) প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পৃথিবীতে তশরিফ আনলেন এমন এক যুগকালে, যখন সমগ্র পৃথিবীতে মানবতা ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, অজ্ঞতা আর শিরক-কুফরে সারা পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল। আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই ঘনকালো অমানিশা দূর করতে, মানবতাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে, সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি এলেন মুক্তিদাতা হিসেবে। তিনি রাউফুর রাহিম, আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর নিজের গুণে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন। প্রিয়নবী (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন :

“অবশ্যই তোমাদের মাঝ থেকেই তোমাদের কাছে এক রাসূল এসেছেন। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য খুবই কষ্টের হয়। তিনি তোমাদের কল্যাণকামী, মুমিনদের প্রতি তিনি অত্যন্ত স্নেহশীল পরম দুয়ালু।”
প্রিয় নবী (সা:)-এর মহান আখলাকে সমস্ত গুণের সমাবেশ ঘটেছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন :
“আর আপনি অবশ্যই সুমহান আখলাকের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত” (সূরা কলম : ৪)। একবার এক সাহাবি উম্মুল মুমিনিন হজরত ‘আয়িশা সিদ্দিকা (রা:)-এর কাছে প্রিয় নবী (সা:)-এর আখলাক সম্পর্কে জানতে চাইলে হজরত ‘আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বললেন; কুরআন মজিদই তাঁর আখলাক। হজরত ‘আয়িশা সিদ্দিকা (রা:)-এর এই একটি ছোট্ট উক্তির মধ্যে প্রিয় নবী (সা.)-এর মহান জীবনাদর্শের সার্বিক চেহারা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, “মহান আখলাকসমূহ পূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছ।”
কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে :
“আল্লাহর নিকট হতে এক নূর ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এর দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান” (সূরা মায়িদা; ১৫-১৬)।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আখলাক, তাঁর জীবনাদর্শ আল্লাহ জাল্লা শানুহুই গড়ে তুলেছেন। তিনি যা কিছু বলেছেন, তা সবই আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বলেছেন এবং তিনি যা কিছু করেছেন, তা সবই আল্লাহু হুকুম বাস্তবায়নের জন্য করেছেন। আল্লাহ তাঁকে যা করতে আদেশ করেছেন, তিনি তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করেছেন। যা করতে আল্লাহ জাল্লা শানুহু নিষেধ করেছেন, তা আদৌ করেননি। আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নির্দেশ মুতাবেকই তিনি মানুষের সামনে হিদায়াতের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষকে সত্য ও সুন্দর পথের দিশা দান করেছেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে :
“এবং তিনি নিজের থেকে কিছুই বলেন না, তাঁর কাছে যে ওহি আসে তিনি সেই ওহিই বলেন।”
তিনি মহান আখলাকসমূহকে নিজে যেমন আমল দ্বারা পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করেছেন, তেমনি তাঁর সাহাবীগণ তাঁকে হুবহু অনুসরণ ও অনুকরণ করে সেই মহান আখলাকের গতিধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যার প্রবাহ যুগে যুগে শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শরূপে গতি সঞ্চারিত করে আসছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা:) আল্লাহর রাসূল’- কালেমা তাইয়িবার এই চিরন্তন সত্য তাঁর জীবনাদর্শের মূল চেতনা, তাওহিদ ও রিসালাতের সুদৃঢ় বুনিয়াদের উপর তা সংস্থাপিত। সে জীবনাদর্শের সালাত, সিয়াম হজ, জাকাত বিধানের সমুজ্জ্বল ধারা মানবিক মূল্যবোধকে বুলন্দ করেছে, আল্লাহ্র সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক সুনিবিড় করে দিয়েছে।
প্রিয় নবী (সা:) আল্লাহর জিকর অধিক পরিমাণে করবার তাকিদ বয়ে আনলেন। আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করলেন :
“নিশ্চয় আল্লাহর জিকর অন্তরে প্রশান্তি আনে।”
একদিন এক ব্যক্তি প্রিয় নবী (সা:)-এর দরবারে আরজ করলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! ইসলামের বহু হুকুম-আহকাম আছে যা অবশ্যই পালন করতে হবে। তবুও আমাকে এমন একটি বিষয়ে শিক্ষা দিন যা প্রাণপ্রিয় সাক্ষী করে রাখতে পারি। প্রিয় নবী (সা:) বললেন : “জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার জিহŸা যেনো আল্লাহ্র জিকরে সিক্ত থাকে”। প্রিয় নবী (সা:)-এর জীবনাদর্শে তাবত গুণের সমাবেশ ঘটেছে। তিনি যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, তেমনি তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টির পূর্বে তাঁরই নূর অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদি সৃষ্টি করেন। হজরত আদম (আ:)-এর জন্মেরও বহু পূর্বে আল্লাহ তায়ালা হজরত মুহাম্মদ (সা:)-কে নবুওয়াত দান করেন।
সত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁকে অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। মক্কার কাফির-মুশরিকরা তাঁর ওপর চালিয়েছে অকথ্য জুলুম-নির্যাতন। তাঁকে তারা উপহাস করেছে, আবার নানা রকম প্রলোভনও দেখিয়েছে সত্য প্রচার থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা থেকে একটুও নিবৃত্ত হননি। নির্ভীকচিত্তে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেছেন : “আল্লাহর কসম, আমার এক হাতে সূর্য আর এক হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমার ওপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করা থেকে আমি পশ্চাৎপদ হবো না।”
প্রিয় নবী (সা:) অতি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। খেজুরপাতার ছাউনি দেয়া একটি ছোট্ট কুটিরে তিনি থাকতেন। কোনোদিন মিহি আটার রুটি খাননি। তাঁর গৃহে খাদ্যাভাব প্রায়ই লেগে থাকত। জীবনে কখনো আরাম বিছানায় শয়ন করেননি। হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ (রা:) বর্ণিত একখানি হাদীস থেকে জানা যায়, মহানবী (সা:) খেজুরপাতার মাদুরের উপর শয়ন করতেন। তাঁর জিসাম মুবারকে মাদুরের দাগ বসে যেত। একদিন হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ (রা:) প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে বললেন; ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আপনি যদি ইযাজত দেন, তাহলে মাদুরের উপর কিছু বিছিয়ে দেই। এ কথা শুনে প্রিয় নবী (সা:) বললেন : “আমি তো একজন মুসাফিরের মতো, সে ক্ষণিক সময়ের জন্য একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে আবার সব ছেড়ে চলে যায়।”
তিনি কারো অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে তাকে দেখতে যেতেন। তিনি বলেছেন : “রোগীর সেবাকারী নিজ গৃহে ফিরে না আসা পর্যন্ত জান্নাতের পথে চলতে থাকে”।
প্রিয় নবী (সা:) ক্রীতদাস প্রথার শেকড় উৎপাটন করেন, গরিব-দুঃখি ও অসহায় মানুষের পৃথিবীতে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : “ধনীদের ধনসম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের ন্যায্য অধিকার রয়েছে”।
প্রিয় নবী (সা:) শিশুদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ, ইয়াতিমদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম দরদ। এমনকি জীবজন্তু, গাছপালার প্রতিও তিনি ছিলেন দারুণ দরদী, তাঁর জীবনাদর্শ ‘উস্ওয়াতুত্ হাসানা’, তা গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীতে সুখ-শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধি আসতে পারে।
‘ইসলাম হার মরাল অ্যান্ড স্পিরিচ্যুয়াল ভেলু’ গ্রন্থে মেজর আর্থার গøায়ন লিউনার্ড বলেছেন : “নবী হিসেবেই তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ নন, বরং একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সুযোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে, দুনিয়াবি ও রূহানি নির্মাতা হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ। তিনি সংস্থাপন করেছেন একটি শ্রেষ্ঠ বসতি ও সাম্রাজ্য। এই তিন মাহাত্ম্য ছাড়াও তাঁর সংস্থাপিত দীন আজো সর্বশ্রেষ্ঠ। তা ছাড়া তিনি যে সত্য কায়েম করেন তার যথার্থ কারণ হচ্ছে তিনি নিজের কাছে নিজে সত্য ছিলেন, তার জনগণের নিকট বিশ্বস্ত ছিলেন, সর্বোপরি তাঁর রবের অনুগত ছিলেন”।
জর্জ বার্নাড শ’র ভাষায় বলা যায় “ওভ ধষষ ঃযব ড়িৎষফ ধিং ঁহরঃবফ ঁহফবৎ ড়হব ষবধফবৎ গঁযধসসধফ ড়িঁষফ যধাব নববহ ঃযব নবংঃ ভরঃঃবফ সধহ ঃড় ষবধফ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষবং ড়ভ াধৎরড়ঁং পৎববফং, ফড়মসধং ধহফ রফবধং ঃড় ঢ়বধপব ধহফ যধঢ়ঢ়রহবংং.”
-“পৃথিবীর নানা ধর্ম-মত, ধর্ম-বিশ্বাস ও চিন্তাধারার লোককে শান্তি ও সুখের পথে পরিচালিত করার জন্য গোটা পৃথিবীটাকে একত্র করে যদি নেতা খোঁজা হয়, তাহলে সর্বোত্তম ও যোগ্যতম ব্যক্তি হবেন হজরত মুহাম্মদ (সা:)।”
লেখক : মুফাসসিরে কুরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন