হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
রোহিঙ্গা সমস্যা, অনুষ্ঠিতব্য ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি প্রধান বিচাপরতি সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে, যা এখনো শেষ হয়নি। মুখরোচক অনেক কথাই ইথারে ভেসে এসেছে। আইনজীবীদের পাশাপাশি পক্ষে-বিপক্ষে জোরদার অবস্থান নেয় মিডিয়া। বুদ্ধিজীবীরাও কম যাননি। বিপদে ছিল জনগণ এই ভেবে যে, প্রকৃতপক্ষে প্রধান বিচারপতি সিন্হা কি সুস্থ না অসুস্থ? তিনি কি স্বেচ্ছায় ছুটিতে গিয়েছেন না তাকে জোরপূর্বক বা কূটকৌশলে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে? এখন আলোচনায় রয়েছে তার পদত্যাগ কি স্বেচ্ছায় না চাপের মুখে? ইতোমধ্যে বঙ্গভবনে আপিল বিভাগের বিচারপতিদের দাওয়াতের পরিমাণটিও বৃদ্ধি পেয়েছে যা ইতোপূর্বে কখনো লক্ষ করা যায়নি। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণের বরাতে মিডিয়াতে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি প্রদানের ঘটনা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি। যদি একটু পিছনে ফিরে দেখি তবে দেখা যায় যে, সরকার ও আওয়ামী ঘরানাদের বক্তব্য মতে, একজন সাধারণ উকিল, পাকিস্তান সমর্থিত শান্তি কমিটির সদস্য, একজন ঘুষখোরসহ নানা উপাদানে ভ‚ষিত ব্যক্তিকেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার।
প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মূর্তি বানিয়ে এক বির্তকের জন্ম দিলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে তার স্বোচ্চার ভ‚মিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তাছাড়াও আদালতের ঘুনেধরা প্রশাসনিক পদ্ধতিকে তিনি সংস্কার করার চেষ্টা করেছেন। মি. সিন্হা নিজেকে যদিও আওয়ামী লীগার হিসেবে প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি, পক্ষান্তরে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করেছেন সিদ্ধহস্তে। কিন্তু বিধি বাম হলো একটি রায়ের অবজারবেশনের কারণে। ভবিষ্যৎ তার রাষ্ট্রপতির আসন অলংকৃত করার আভাষ-ইঙ্গিত ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতেও দেখা গেছে। বর্তমানে দেশ পরিচালনায় ভারতীয়দের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। প্রধান বিচারপতির নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে উড়িয়ে দেয়ারমত নয় বলে অনেকই মনে করছেন, যদিও কাগজে-কলমে দেয়ার মতো এখানে কোন প্রমাণ নেই। কাগজে-কলমে সব প্রমাণ থাকার কথাও নয়, সাক্ষ্য আইনের বিধান মতে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যই ক্ষেত্র বিশেষে যথেষ্ট।
পাঠকের স্মরণে থাকতে পারে, রায়ের পরেই প্রকাশ পেলো যে, সিন্হার বিরুদ্ধে ১২৬টি অভিযোগ দুদকে জমা পড়েছে, যা খতিয়ে দেখছে দুদক। দুদক চেয়ারম্যান রাজনৈতিক নেতার মতোই দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন যে, এ মর্মে দুদক স্বচ্ছ থাকবে। তবে রাষ্ট্রপতির হাতে ছিল ১১টি অভিযোগ, যা দেখে আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ সিন্হার সাথে আপিল বিভাগের বেঞ্চে একত্রে না বসার জন্য প্রভান্বিত হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পূর্বে দেয়া প্রধান বিচারপতি সিন্হার বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ। পালিয়ে যাচ্ছি না, দেশে অবশ্যই ফিরে আসবো।’ সিন্হার এ বক্তব্য দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব শুনেছে। সিন্হার বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে রাষ্ট্রপতির নিকট দাখিলকৃত অসুস্থতার কারণে ছুটির দরখাস্ত মিথ্যা। অন্যদিকে সরকারের বক্তব্য যদি সত্য হয় তবে প্রধান বিচারপতি মিথ্যা বলেছেন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যদি ‘সত্য-মিথ্যা’ অর্থাৎ ‘চোর-পুলিশ’ খেলা হয় তবে অসহায় জনগণ আস্থার স্থানটি কোথায় পাবে?
স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিতে হবে যে, নিশ্চয় রাষ্ট্রপতি স্থির নিশ্চিত হয়েই ১১টি অভিযোগ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিকট শুধু উপস্থাপন করেননি বরং এ উদ্দেশ্যে করেছেন যাতে তার বাস্তবায়ন হয়। অতএব, সামাজিক আচার-বিচারের মতো সিন্হার বিচার আপিল বিভাগের বিচারপতিরা করে ফেলেছেন সিন্হার সাথে একত্রে না বসার ঘোষণা দিয়ে। কিন্তু মি. সিন্হার আইনগত বিচার বা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম শুরু হবে কি হবে না এটাও নির্ভর বরছে সরকারের ইচ্ছার ওপর।
বিচারপতি সিন্হা এজলাশে বসে এমন কথাই বলতেন যা থেকে তার আপোসহীন চরিত্রের গুণাবলী লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ঘটনা অথবা প্রভাব যাই হোক বিদেশ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে আপোসহীন সিন্হার ‘আপোসহীনতার’ মৃত্যু ঘটেছে। নিরাপত্তা অথবা জেল হাজতের ভয়েই কি দেশে ফেরা তার সুদূরপরাহত? (যে ভাষায় বলেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল সে ভাষাতেই বলা হলো)। কিন্তু আলোচনার দ্বার এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে জাতিকে আরো গভীরে যাওয়া দরকার, বিচার বিভাগের বহু আলোচিত ‘স্বাধীনতা’ হালকা না গভীর তা পরখ করার জন্য।
আগামী ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬(১) মোতাবেক বিচারপতি সিন্হার অবসরে যাওয়ার কথা। সরকারি ভাষ্যমতে, গত ২ অক্টোবর তিনি শারীরিক অসুস্থতার জন্য এক মাসের ছুটিতে গেছেন। ‘অসুস্থতার’ বিষয়টি যে মিথ্যা, তার প্রমাণ ১৩ অক্টোবর নিজ স্বাক্ষরিত ও নিজ হাতে বিলিকৃত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দৃঢ়তার সাথে প্রকাশ করেছেন, তখনো তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি। সিন্হা ১০ নভেম্বর দেশে ফেরার বিষয়টি বার বার মিডিয়াতে নিশ্চিত করলেও ৯ নভেম্বর সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ‘পদত্যাগ’ করেছেন যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে ১৪ নভেম্বর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরিত হয়েছে। সরকার বলছে, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ, বিরোধীদের দাবি- প্রচÐ চাপের মুখে এই পদত্যাগ। এ ‘চাপ’টি কি তা খুঁজে বের করা দরকার, নতুবা প্রধান বিচারপতি বিদায়ের যে কলংকিত নজির সৃষ্টি হলো তা মুছা যাবে না।
যে যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। সে স্বচ্ছতা প্রমাণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। দুদক তো সরকারের ক্রীড়ানক হিসেবে পূর্বেও ছিল, বর্তমানেও এর ব্যতিক্রম নেই, বরং সরকারপ্রীতি নগ্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাপক চুরি ও আত্মসাতের জন্য বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করলেও ব্যাংকের চেয়ারম্যান আ. হাই বাচ্চু ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ ধরনের অনেক প্রমাণ দেয়া যাবে যেখানে দুদক সরকারের প্রভাবশালীদের ছাড় দিয়েছে। কোচিং সেন্টারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক মাঠে নেমেছে। অথচ গরীব কৃষকের ভ‚মি জোরপূর্বক ভ‚মি দস্যুরা দখল ও বালু ভরাট করে আবাসন প্রকল্প বানিয়ে প্লট আকারে অন্যত্র বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নিচ্ছে সে ব্যাপারে দুদক নিরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছে। কারণ ভ‚মি দস্যুরা সরকারি ঘরানার লোক। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, আড়াইহাজার থানা ঘুরে এলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের সম্পত্তির হিসাব চেয়ে দুদক গত ২০১০ সালের ১৮ জুলাই একটি নোটিশ প্রদান করে। প্রধান বিচারপতি সিন্হার নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেলের অফিস থেকে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত না করার জন্য নির্দেশনামূলক চিঠি’কে গত ১৪ নভেম্বর প্রদত্ত এক রায়ে বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিম সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ বাতিল ঘোষণা করেছেন। ফলে সিন্হার ১২৬টি অভিযোগের তদন্ত করতে অন্য কোন বাধা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সিন্হা জাতীয় সংসদকে DIS FUNCTIONALবলে যে মন্তব্য করেছেন তার সুরাহা হবে কীভাবে? তবে কি DIS FUNCTIONAL হওয়ার রায় হতে পারে মর্মে সরকারের ‘ভয়’, অন্যদিকে দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে যাওয়ায় প্রধান বিচারপতির ‘ভয়’ কি এখানে আপোস ফর্মুলা তথা পদত্যাগের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে? অ্যালজেবরার থিউরি যথা মাইনাসে মাইনাসে প্লাস থিউরির বাস্তবায়ন এখানে হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। Dis functional হওয়ার ভয় প্লাস দুদকের মামলায় আসামী হওয়ার ভয় পদত্যাগে ফায়সালা হয়েছে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে এ ঘটনায় যে কলংকিত নজির সৃষ্টি হলো তা মুছা যাবে কীভাবে?
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।