হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
গত ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছু বক্তব্য দেন। তার এই বক্তব্যের মধ্যে দুটি প্রসঙ্গ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবেন। দুই. আওয়ামী লীগকে তিনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ দুইটি বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গণে বেশ আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথার জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, যারা এ দেশে নষ্ট রাজনীতি করেছে, তারা এখন রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা বলে। বিএনপির মুখে এটা মানায় না। এটা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ ছাড়া কিছু নয়। তিনি এ কথাও বলেছেন, বিএনপি যে কাজ করেছে তা যদি বুড়িগঙ্গার পানিতে ধোয়া হয়, তবে এই পানি আরো দূষিত হবে। আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করার জবাব দিতে গিয়ে দলটির নেতারা বলেছেন, কে কাকে ক্ষমা করবে! আওয়ামী লীগ এমন কিছু করে নাই যে তাকে ক্ষমা করতে হবে। বরং জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন করার কারণে বিএনপিরই জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত। বেশ কিছু দিন ধরে দুই দলের মধ্যে এ নিয়ে বেশ বাহাস চলছে। প্রায় দেড় বছর পর সরকার বিএনপিকে রাজধানীতে একটি সমাবেশ করতে দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক এই বাহাসের সূত্রপাত হয়েছে। এর মাধ্যমে রাজনীতির প্রথাগত যে সংস্কৃতি তা কিছুটা হলেও ফিরে এসেছে। বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করেছে, আর সরকারি দল তার পাল্টা জবাব দিয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্য রাজনীতি নিয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক খুব একটা দেখা যায়নি। বিএনপিকে এই জনসভা করতে দেয়াকে বিশ্লেষকরা রাজনীতির ইতিবাচক দিক বলে বিবেচনা করছে। অবশ্য জনসভায় লোক ঠেকানোর জন্য সরকারের নানামুখী তৎপরতাও ছিল। অঘোষিতভাবে ঢাকাগামী প্রায় সব রুটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রাজধানীর ভেতরও গণপরিবহন সীমিত হয়ে পড়ে। এত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে বিএনপি ব্যাপক জনসমাবেশ করতে সক্ষম হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বিএনপিকে জনসমাবেশ করতে দিয়ে রাজনীতিতে একটি শুভ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে রাজনৈতিক দলের যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি তা পালনের বন্ধ দুয়ার ধীরে ধীরে খুলছে। সভা-সমাবেশে পারস্পরিক বিরোধিতা ও সমালোচনা থাকাই হচ্ছে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এসব বক্তব্য-বিবৃতি শুনে জনগণও বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে কোন দল সঠিক এবং কোন দল বেঠিক বলছে। এতে ভিন্নমত ও মুক্তচিন্তার প্রকাশ ঘটে। তাছাড়া একপাক্ষিক কোনো কিছুই ভাল নয়। খেলার মাঠেও নয়, রাজনীতিতে তো নয়ই। প্রতিপক্ষ ছাড়া নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করা যায় না।
দুই.
বিএনপির সমাবেশ নিয়ে পত্র-পত্রিকাগুলো বিভিন্ন ধরনের সংবাদ প্রকাশ করে। বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ নিয়ে ‘রাজনীতিতে নতুন মোড়’,‘গুমট কাটছে রাজনীতির’ এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনগুলোর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে অবাধ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। তবে এ কথা সত্য, দীর্ঘদিন কোনঠাসা থাকা অবস্থায় বিএনপি পরপর তিনটি শো-ডাউন রাজনৈতিক অঙ্গণে যেমন একটি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে, তেমনি ঝিমিয়ে পড়া বিএনপির নেতা-কর্মীরা কিছুটা হলেও উজ্জীবিত হয়েছে। কর্মসূচিগুলো সঞ্জীবনী সুধা হয়ে তাদের মধ্যে উৎসাহ, উদ্দীপণা ও প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনও উজ্জীবিত হয়েছেন। তিনি এখন এমন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগীয় শহরগুলো অভিমুখে রোড শো করার চিন্তাভাবনা করছেন। বস্তুত আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটাই এরকম। ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বিঘে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সভা-সমাবেশ করবে, এটাই কাক্সিক্ষত। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে এ ধারার ব্যত্যয় ঘটে। বিএনপি নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষমতাসীন দল তার উপর চড়াও হয়। দলটির ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন এতটাই তীব্র হয়ে উঠে যে এর নেতা-কর্মীরা দৌড়ের উপর থাকে। সভা-সমাবেশ দূরে থাক, হামলা-মামলার কারণে বাড়ি থেকেই বিতাড়িত হয়। অনেকে গুম-খুনের শিকার হয়। অনেকে জেলে যায়। একের পর এক মামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের আদালতে হাজিরা দিতে দিতে দিন পার করতে হয়। এখনও তাদের হাজিরা দিতে হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সনকে প্রতি সপ্তাহে হাজিরা দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হচ্ছে। সে সময় সরকার অতি কঠোর হয়ে, বিএনপিকে একটি প্রান্তিক পর্যায়ের দলে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলায়। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকেই বলতে শোনা গেছে, বিএনপি মুসলিম লীগে পরিণত হবে। এতসব নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যেও বিএনপি মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দেয়। বিএনপিকে নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন করার ক্রমাগত প্রক্রিয়ার মধ্যেই সরকারের মেয়াদ এখন শেষ প্রান্তে। আর আট-নয় মাস বাকি রয়েছে। এ অবস্থায় সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে সরকার যেন বিএনপিকে কিছুটা ছাড় দেয়া শুরু করেছে। তবে এটা যে বিএনপিকে নিয়ে সরকারের একটি ‘টেস্ট কেস’ তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানে। সভা-সমাবেশ ও রোড শো করতে দিয়ে সরকার মূলত ‘টোকা’ দিয়ে দলটির জনপ্রিয়তা নয়, সাংগঠনিক শক্তি কী অবস্থায় রয়েছে, তা পরীক্ষা করতে চাইছে। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও, জনসমর্থনের দিক থেকে শক্তিশালী। অর্থাৎ এত নিপীড়ন-নির্যাতনের পরও বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি কতটা মজবুত, তা জনসভা আয়োজনের অনুমতি দিয়ে সরকার বুঝতে চেয়েছে। যে তিনটি শো-ডাউন বিএনপি করেছে, তাতে মানুষের যে উপস্থিতি দেখা গেছে, তার মধ্য দিয়ে দলটি প্রমাণ করতে পেরেছে, সরকারের ক্রমাগত বাধা-বিঘœ সৃষ্টি এবং হামলা-মামলার মধ্যেও সাংগঠনিকভাবে দলটির ভিত্তি একেবারে দুর্বল নয়। সরকারও তা বুঝতে পেরেছে। বিএনপিকে যদি নির্বিঘে জনসভা করতে দেয়া হয়, তার সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন যে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, তা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ প্রেক্ষিতে, সরকার আগামীতে বিএনপিকে জনসভা বা রোড শো করতে দেবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ইতোমধ্যে পত্রিকায় খবার প্রকাশিত হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি জনসভা করতে চাইছেন। যদি এ জনসভা করার অনুমতি সরকার দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, সরকার ‘অনুমতির গণতন্ত্র’ থেকে বের হয়ে উন্মুক্ত গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে গণতন্ত্রকে সীমিত করে যে সরকার নির্বিঘে ক্ষমতার মেয়াদের শেষ প্রান্তে, সে কী উন্মুক্ত গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা এত সহজে বজায় রাখবে? কারণ বিনাভোটে নির্বাচিত সরকারের ভয় এবং দুর্বলতা হচ্ছে উন্মুক্ত গণতন্ত্র এবং বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি। এক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগই তার টিকে থাকার অন্যতম প্রধান অবলম্বন হয়ে থাকে। বিরোধী পক্ষকে দমন করে নিজের ক্ষমতা অক্ষত রাখতে সচেষ্ট থাকে। এ অবস্থায় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে ক্ষমতাসীন দল হয়তো নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তার এই কঠোর অবস্থান বজায় রাখতে পারে। অর্থাৎ বিএনপিকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার ক্ষেত্রে লাগাম টেনে ধরবে। মাঝে মাঝে জনসভা করতে দিয়ে বলা হবে, আমরা তো করতে দিচ্ছি। এ প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিএনপি যে আগামীতে ধারাবাহিকভাবে নির্বিঘে জনসভা ও রোড শো করতে পারবে, তার কোনো গ্যারান্টি নাই।
তিন.
বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা কেন বলেছেন? আর ক্ষমতাসীন দল কেনইবা তার সমালোচনা করছে? এর ব্যাখ্যা বিভিন্নভাবে হতে পারে। প্রথমত, আমাদের দেশের রাজনীতির ধারা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এতে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা বিদ্যমান। বিরোধী দল ক্ষমতাসীন হলে, ক্ষমতাচ্যুত দলের উপর চড়াও হয়। ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দলের ওপর কী ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে, তা স্মরণে রেখে সেও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় আসা এবং বিরোধী দলে থাকাকালে এ অপসংস্কৃতি দেখা গেছে। এখনও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অতীতে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তার নেতা-কর্মীর ওপর কী ধরনের নির্যাতন করেছে, তার বর্ণনা দেয়। বিএনপিও তার নেতা-কর্মীরা কীভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তা তুলে ধরছে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণ এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতেই হয়তো বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ক্ষমতায় গেলে এ ধরনের রাজনীতি করবেন না। এ কথাও বলেছেন, পুলিশসহ প্রশাসনে এখন যারা কর্মরত, তাদের চাকরিচ্যুত বা অন্য কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেবেন না। তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তার এ বক্তব্যকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা বলার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া কে? এ কথা বলার অধিকার কে তাকে দিয়েছে? তার মুখে কি এ কথা মানায়? পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে, মানাবে না কেন? বেগম খালেদা জিয়া, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। দেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বড় বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন, এ সরকারের আগের মেয়াদেও বিরোধী দলের নেত্রী ছিলেন। তার দল বিএনপি এখনো ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ ভোটের অধিকারী, যা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। খোদ ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ‘বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।’ সবদলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে, বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কাজেই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করার কথা খালেদা জিয়া অবশ্যই বলতে পারেন। একইভাবে ক্ষমতাসীন দলও তা বলতে পারে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কেবল এই দুই দলই সক্ষমতা রাখে। এ বাস্তবতা অস্বীকার বা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এক ব্যক্তিই রাজনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারেন। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলা একাই দেশটির রাজনীতি বদলে দিয়েছিলেন। সারা জীবন শ্বেতাঙ্গ শাসক গোষ্ঠীর দ্বারা জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়ে জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হয়েই রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তণ ঘটান। প্রতিহিংসার বশে বর্ণবাদী নেতা প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্কের বিরুদ্ধে কোনোরূপ বিদ্বেষ পোষণ করেননি। এমনকি ‘দ্য রেইনবো নেশন’ নীতির ঘোষণা দিয়ে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের সুরক্ষা দিয়েছেন। তিনি বর্ণবাদীর ধারক, পৃষ্ঠপোষক ও সমর্থকদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়া যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমার কথা বলেছেন, তা শুনতে আওয়ামী লীগের কাছে কর্কশ মনে হলেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপেক্ষা করার বিষয় নয়। ক্ষমতাসীন দল যতই ব্যঙ্গ-বিদ্রæপ করুক না কেন, খালেদা জিয়ার এ কথার যথেষ্ট গুরুত্ব ও গভীরতা রয়েছে। তিনি হয়তো এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি করবে না। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামে এক সমাবেশে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ক্ষমতা থেকে চলে গেলে পিঠ বাঁচানো যাবে না। যারা অগাধ অর্থকড়ির মালিক হয়েছে, তারা এ অর্থকড়ি নিয়ে পালাবার পথ পাবে না। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ৩০ লাখ লোক মারা যাবে। তাদের এসব কথার অর্থ হচ্ছে, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে, তবে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের কোনো উপায় থাকবে না। পালিয়েও বাঁচতে পারবে না। তারা এ বক্তব্য দিয়েছেন হয়তো এ কারণে যে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপর যেভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন, খুন-গুম, হামলা-মামলা এবং স্টিম রোলার চালানো হয়েছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তার কঠিন প্রতিক্রিয়া ও প্রতিশোধের শিকার আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও হতে হবে। মূলত ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যে আশঙ্কা করছে, তা অমূলক এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এ ধরনের প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধমূলক কোনো ব্যবস্থা নেবে না। সংঘাতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাবেন। বলা যায়, বর্তমানে রাজনীতিতে যে পারস্পরিক হিংসা-প্রতিহিংসা এবং নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ট্রেন্ড চলছে, দেশ ও জাতির কল্যাণে তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। এ উপলব্ধি থেকেই একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে বেগম খালেদা জিয়া কথাগুলো বলেছেন। তিনি রাজনীতির যে গুণগত পরিবর্তন ও ক্ষমার কথা বলেছেন, তা একই সূত্রে গাথা। একটি অপরটির পরিপূরক। কাজেই ক্ষমতাসীন দলের উচিত হবে না, খালেদা জিয়ার এসব কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া। কারণ ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। এক সময় ছাড়তেই হবে। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও যেহেতু বিএনপিকে নিঃশেষ করা যায়নি, বরং অক্ষত রয়েছে, তাই ক্ষমতাসীন দলের বিদায়ের সময় এই দলটিই থাকবে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই হয়তো খালেদা জিয়া ক্ষমা ও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তাই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের উচিত হবে, এ ব্যাপারে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহ অবস্থান সৃষ্টিতে যুগপৎভাবে কাজ করা।
চার.
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায়ই একটি কথা বলে থাকেন, দেশে এখন শান্তি বিরাজ করছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে বিএনপির সাথে আলাপা-আলোচনা ও সংলাপ করতে হবে। হ্যাঁ, আপাত দৃষ্টিতে দেশে কোনো রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষ নেই বটে, তবে এই শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রকৃত চিত্র নয়। দেশ সাধারণত দুই কারণে শান্ত ও স্থিতিশীল থাকে। এক. আক্ষরিক অর্থে দেশে সুশাসন, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন বলবৎ থাকলে। দুই. ভয়ের শাসন বজায় থাকলে। দেশে সুশাসন থাকলে মানুষের মধ্যে সুখ-শান্তি ও স্বস্তি বিরাজ করে। বিরোধী দলগুলোও সংঘাত-সংঘর্ষের রাজনীতিতে জড়ায় না। ফলে দেশ একটি স্থিতিশীল পরিবেশের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যায়। আর সরকার যদি বিরোধী দলকে বল প্রয়োগ ও নিপীড়ন-নির্যাতনের মাধ্যমে দমিয়ে রাখে, তবে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জনসাধারণের মধ্যেও এ ভয় সঞ্চারিত হয়। ভেতরে ভেতরে গুমরে মরলেও মুখ খুলতে সাহস পায় না। কেউ সরকারের বিরুদ্ধে উচিত কথা বললে ও সমালোচনা করলে গুম হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। এহেন বাস্তবতায় যেখানে বিরোধী রাজনীতির সুযোগ সীমিত, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার দাপট, সেখানে সাধারণ মানুষের চুপ না থেকে উপায় কি! ক্ষমতাসীন দলের কাছে এই পরিবেশকেই শান্তির পরিবেশ মনে হচ্ছে। তবে প্রকৃত শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ তখনই নিশ্চিত হবে যখন, দেশে মত প্রকাশ ও গণতন্ত্রের পূর্ণ চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সংঘাত ও প্রতিহিংসার রাজনীতির পরিবর্তে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবাধ সুযোগ থাকবে। এ কারণেই রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন এখন সময়ের দাবী।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।