Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুরিয়ারে ইয়াবা পাচার

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পণ্য পরিবহনের আড়ালে অবাধে দেশি-বিদেশি কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর মাধ্যমে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগসাজশে গড়ে উঠেছে ইয়াবা পাচারের বিশাল সিন্ডিকেট। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ওই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একাধিকবার উচ্চপর্যায়ে রিপোর্ট পাঠানো হলেও সক্রিয় রয়েছে জড়িতরা। ৫টি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার করা হচ্ছে বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এসএ পরিবহনের শান্তিনগর কুরিয়ার সার্ভিসের কাউন্টার থেকে দুটি হারমোনিয়াম বুঝে নেয়ার পর মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি দল ওই হারমোনিয়ামের ভেতর থেকে ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করে। এ সময় জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর মতিঝিলস্থ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টেকনাফ থেকে ইয়াবা আনার সময় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি দল ৫ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেফতার করে। খাবার পরিবেশনের বাটির মাধ্যমে ওই ইয়াবা পাচার করা হয়েছিল। সরেজমিন রাজধানীর মতিঝিল, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, শান্তিনগর ও কাকরাইলের বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস ঘুরে দেখা গেছে, পার্সেলে লেখা প্রেরক ও প্রাপকের ঠিকানা যাচাই-বাছাই ছাড়াই কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর এন্ট্রি খাতায় লিখে রাখা হচ্ছে। কোনো কুরিয়ার সার্ভিসেই মালামাল স্ক্যানের কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভেতরে কী ধরনের মালামাল আছে তা নেড়েচেড়েও পরীক্ষা করে দেখা হয় না। এমনকি পার্সেলের গায়ে লেখা প্রেরকের মোবাইল নম্বরটি ভুয়া কিনা তাও পরীক্ষা করে দেখা হয় না।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় চোরাকারবারিরা ইয়াবা, বিদেশি বিয়ার ও ফেনসিডিলের পাশাপাশি জঙ্গি অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং ও অস্ত্রসহ অবৈধ পণ্য পরিবহনে কুরিয়ার সার্ভিসকে টার্গেট করেছে। দেশীয় কোনো কুরিয়ার সার্ভিসে পণ্য গ্রহণ বা প্রাপকের হাতে তুলে দেয়ার আগে স্ক্যান করে দেখা হয় না। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানে স্ক্যানার নেই। তাছাড়া টাকার লোভে কুরিয়ারের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের সহযোগিতা করছেন। ফলে এ মাধ্যমে সহজেই অবৈধ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে চোরাকারবারিরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়া হলেও কেউ তা মানছে না। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে সহজেই ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক পাচার হচ্ছে। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, দেশের বাইরেও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদক পাচার করা হচ্ছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি দ্রæত নির্দেশনা পাওয়া যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত পরিচালক (গোয়েন্দা) নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে যেসব কুরিয়ার সার্ভিস কাজ করছে তাদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো নিজ উদ্যোগে স্ক্যানার মেশিন দিয়ে স্ক্যান করে দেখলে সহজেই এসব অপরাধ ধরা পড়ে বলে তিনি উল্লেখ করেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক ও অবৈধ পণ্য পাচারের সাথে শুধু দেশীয় কুরিয়ার সার্ভিস নয়, বিদেশি কুরিয়ারের মাধ্যমেও আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্রের সদস্যরা মাদক পাচার করছে। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে কুরিয়ারে আসা সাড়ে ৭শ’ গ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়। এ বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বাতেন খাঁর মোড়ে একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যালয় থেকে পুলিশ বিদেশি পিস্তল, ১৬ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগজিন উদ্ধার করে। ফলের কার্টনে ভরে এগুলো পাচারের চেষ্টা চলছিল। চলতি বছরের ১ ফেব্রæয়ারি কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে নারায়ণগঞ্জে কুরিয়ার সার্ভিসে আনা ফ্রিজ থেকে চার হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ এ ঘটনায় ২ জনকে গ্রেফতার করে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তাদের কাছে গোপন সংবাদ ছিল যে কক্সবাজার থেকে এসএ পরিবহনের শান্তিনগর কুরিয়ার সার্ভিসের কাউন্টারে পার্সেলের মাধ্যমে দুটি হারমোনিয়াম পাঠানো হয়েছে। হারমোনিয়ামে ইয়াবা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কাউন্টার থেকে হারমোনিয়াম দুটি গ্রহণ করে নিয়ে যাওয়া হবে কাকরাইলে একটি প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়ে। পরে সেখানে দু’জন ব্যক্তি এসে হারমোনিয়াম দুটি নিয়ে যাবেন। সূত্র জানায়, হেলাল নামে এক ব্যক্তি হারমোনিয়াম দুটি পাঠিয়েছেন। প্রাপক ছিলেন জসিম নামের এক ব্যক্তি। চক্রটিকে ধরার জন্য গত বুধবার ভোর থেকে অধিদপ্তরের ঢাকা গোয়েন্দা অঞ্চলের তত্ত¡াবধায়ক ফজলুর রহমান খান, পরিদর্শক রুকনুজ্জামানসহ সাত সদস্যের একটি দল এসএ পরিবহনের ওই কাউন্টারে অবস্থান নেয়। দুপুরে একব্যক্তি নিজেকে জসিম পরিচয় দিয়ে হারমোনিয়াম দুটি সংগ্রহ করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আটক করে হারমোনিয়াম দুটি তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিতে প্রতিটি হারমোনিয়ামে দুটি করে প্যাকেটে মোড়ানো অবস্থায় ১০ হাজার করে ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, জসিম পরিচয়ে হারমোনিয়াম নিতে আসা ব্যক্তির নাম ইসহাক হোসেন। তিনি কাকরাইলে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল হারমোনিয়াম দুটি নিয়ে গিয়ে শাহীন ও জসিম নামে দু’জনের কাছে হস্তান্তর করা। পরে ইসহাকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, শান্তিনগর থেকে শাহীন ও জসিমকে আটক করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইয়াবার প্রবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অতীতের চেয়ে এখন বেশি তৎপর। ২০১৬ সালে এক কোটির অধিক পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হলেও শুধু চলতি বছরের ৮ মাসেই প্রায় তিন কোটি পিস এরও বেশি ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, কোস্টগার্ড দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে আটক করে এই ইয়াবার চালান। এর পরেও ঠেকানো যাচ্ছে না ভয়ঙ্কর এই মাদকের অনুপ্রবেশ। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের ১৫টি স্থানে ৩৭টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। যেখান থেকে সাগর ও সড়কপথে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, নয়াপাড়া, সাবরাং, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়া, জলিলেরদিয়া, লেদা, আলীখালী, হৃলাসহ অন্তত ১১টি পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবার চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এসব ইয়াবা তৈরি ও পাচারে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ী যেমন জড়িত রয়েছে তেমনি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের গডফাদারও রয়েছে। যারা সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বিজিবি, কোস্টগার্ড, র‌্যাব কিংবা পুলিশে চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা পাচার করে আসছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইয়াবা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ