হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মায়নমারের বর্তমান রাখাইন (সাবেক আরাকান) রাজ্যে মুসলিমরা শাসনক্ষমতায় ছিল অন্যূন দু’শো বছর।। ১৪৩০ সালে তৎকালীন বাংলার মুসলিম শাসকের সাহায্যে এই শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেখান থেকে বিতাড়িত বৌদ্ধরাজ নরমিখলা। ১৪০৪ সালে তিনি প্রথম আরাকানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বৈবাহিক বিবাদে জড়িয়ে পার্শ্ববর্তী বর্মী রাজার আক্রমণে ১৪০৬ সালে সেখান থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন বাংলার রাজধানী গৌড়ে। এরপর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিজের নাম রাখেন সোলায়মান শাহ। পরবর্তীকালে আরাকান রাজ্যে মংস মোয়ান নামেও পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার গড়া সাম্রাজ্য ১৪০০ থেকে ১৬৩১ সাল পর্যন্ত আরাকানে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসে যেটা ব্রাউক রাজবংশ নামে পরিচিত। বাইশ হাজার বর্গমাইল ভৌগোলিক আয়তনের এই সাম্রাজ্য বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৫৪ সালে তারা নিজস্ব মুদ্রাও প্রচলন করেছিলেন, যা বৃহত্তর বাংলায়ও ব্যবহৃত হতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পরবর্তীকালে আরাকানকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে এনে শাসন করেছিল। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে আরাকান। তখন সেখানে মুসলিম শাসনেরও পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। নিজ ভূমে আজ তারা পরবাসী। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আখ্যায়িত করে সেখানে তাদের ওপর সমানে চলছে অকথিত নির্যাতন। চলছে নৃশংস হত্যালীলা। এর জেরে গেল ক’মাসে দেশছাড়া হয়েছে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অধিকাংশই নারী এবং শিশু। তাদের হাহাকার এবং আর্তনাদে বিষাদগ্রস্ত সভ্য মানবসমাজ। এ জন্য মায়ানমার সরকারের নিন্দা-সমালোচনায় মুখর হয়েছে সমগ্র বিশ্ব। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদীরাও সক্রিয় তাদের স্বভাবসুলভ অপপ্রচারে। সন্ত্রাসী কর্মের জন্য রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা বলে রীতিমতো অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে ফ্যাসিবাদের দোসররা।
মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবৈধ জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার মূল ষড়যন্ত্র করেছিল ব্রিটিশ। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরাকানের ক্ষমতা দখল করার পর সেখানকার বাসিন্দা ১৩৯টি জনগোষ্ঠীর এক তালিকা তৈরি করে। কিন্তু ওই তালিকায় তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত না করে তখনই ষড়যন্ত্রের পেরেক পুঁতে রাখে। এরপর স্বাধীন মায়ানমার সরকারও তাদের অনুসরণে ১৩৫টি জনগোষ্ঠীর আরেকটি তালিকা তৈরি করে এবং ওই তালিকায়ও বাদ পড়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। ১৯৪৮ সালে মায়ানমারের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর প্রথম ক’বছর সেখানকার শাসনব্যবস্থার অংশীদার ছিল রোহিঙ্গা মুসলিমরা। ১৯৬২ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এলে তাদের ওপর নির্যাতন অকথিত রূপ ধারণ করে। এই নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ সাম্প্রতিককালে সব সীমা অতিক্রম করায় গোটা বিশ্বই এখন এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। এজন্য মায়ানমার সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে জাতিসংঘ। আমেরিকা, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, ইরান ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাইসহ অন্যরাও এই হত্যা-হিংসা বন্ধের জন্য সরব হয়েছেন। এছাড়া মায়ানমারের চলতি ঘটনাবলির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন উত্তর-পূর্ব ভারতের আমিরে শরিয়ত আল্লামা তৈয়ীবুর রহমান এবং বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ আহমদ সয়ীদ গোবিন্দপুরির মতো ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও। আমিরে শরিয়ত বলেছেন, মানবতার এই ভয়াবহ পতনের সময় বিবেকমান কোনও মানুষ চুপ করে বসে থাকেত পারেন না। জাতিসংঘের সূত্রে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছরের অক্টোবর মাস থেকে এ পর্যন্ত ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে।
ইতিহাসের সূত্রে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে তারা সেখানকার এক সুপ্রাচীন সংকরজাত জনগোষ্ঠী। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম এবং স্থানীয় আরাকানিদের সংমিশ্রণে খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকে তাদের উদ্ভব। কথিত আছে, সে সময়ের চন্দ্রবংশীয় রাজা মহত ই চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) সমুদ্রে রামব্রি দ্বীপের কাছে আরব বণিকদের এক জাহাজ দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়। সেখান থেকে জীবন্ত উদ্ধার হওয়া একদল আরবকে আরাকানে বসতি গড়তে দেন রাজা। বলা হয়, জাহাজ ধ্বংস হওয়ার পর তারা আরবি ভাষায় রহম রহম বলে উদ্ধারের আর্জি জানিয়েছিল। সে থেকে রোয়াম, রোসাং, রোসাঙ্গ থেকে অবশেষে তারা রোহিঙ্গা পরিচিত লাভ করে। এরপর তারা স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সেখানেই থেকে যাওয়ায় ক্রমে বংশবিস্তার এবং ইসলাম ধর্ম প্রসার লাভ করে। অবশ্য রোহিঙ্গা পরিচিতির আরও একাধিক ঐতিহাসিক সূত্র পাওয়া যায়। পাশপাশি তারাই যে আরাকানের আদি জনগোষ্ঠী এবং সপ্তদশ শতক পর্যন্ত তারা কীভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তারও নানা তথ্য পাওয়া যায়। বলা হয়, ১৬৬০ সালে মোগলসম্রাট শাহজাহান-পুত্র তথা তৎকালীন বাংলার সুবেদার শাহ সুজা সপরিবারে পালিয়ে আরাকানে আশ্রয় গ্রহণের সঙ্গেও জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাদের ক্রমবিস্তৃতির ইতিহাস। তখন আজকের চট্টগ্রাম ছিল আরাকানের বন্দর শহর। শাহ সুজা তার পরিবারসহ অনুগত প্রায় অর্ধলক্ষ লোক নিয়ে নিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সবাইকে নিয়ে তিনি আরাকানের রাজধানী স্রোয়াং যেতে পারেননি। ফলে যেসব মোগল সৈন্য তখন চট্টগ্রামে থেকে গিয়েছিল, তারা পরবর্তীতে স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে সেখানে বসতি স্থাপন করে এবং মুসলিমদের বংশবিস্তার ঘটায়। অন্যদিকে, আরাকানে আশ্রিত সুজা পরিবারের সঙ্গে তখনকার বৌদ্ধধর্মী রাজা চন্দ্রসুধরমর বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস এখনও জ্বলজ্বল করছে। এরপর ১৬৬০ সালে পিতৃহত্যার বদলা নিতে গিয়ে করুণ পরিণতির শিকার হয়েছিলেন সুজা-পুত্র। এজন্য সুজা-পুত্র তিন বছর সেখানে থেকে স্থানীয়দের সহযোগে নিজস্ব সৈন্যদলও গঠন করেছিলেন। এর মাধ্যমেও সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবস্থানের কথা সুস্পষ্ট।
আসলে মায়নমারে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নপর্ব কার্যত শুরু হয়েছে ১০৪৪ সাল থেকে। কট্টর বৌদ্ধধর্মী রাজা আনহাওতা বৌদ্ধাদের বসতি গড়ার জন্য প্রথম রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করেন। মুসলিম রাজত্বকাল বাদ দিলে এই বিতাড়নপর্ব চলতে থাকে। ১৭৮০ সালে কট্টর বৌদ্ধধর্মী রাজা বাদাওফায়া আরাকান দখল করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন আরও বাড়িয়ে তোলেন। ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের এক পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ত্রিশ লক্ষ রোহিঙ্গা নিহত হয়। এর পর স্বাধীন মায়নমারে ১৯৭৮ সালে সামরিক বাহিনীর অপারেশন কিং ড্রাগনের সময় হত্যা করা হয় আরও কয়েক হাজার। তখন অন্তত দু’লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এছাড়া ১৯৯১-৯২ সালের জাতিদাঙ্গার সময় পালিয়ে আসে প্রায় আড়াই লক্ষ। সময়ে সময়ে এরা আশ্রয় নেয় সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায়। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত ও বিপন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে গণ্য রোহিঙ্গারা। ন্যূনতম নাগরিক অধিকার অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক কিংবা সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাস সারাবিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীও সশস্ত্র বাহিনী ছিল। ব্রিটিশকে ভারতছাড়া করতে এই বাহিনীও সশস্ত্র কার্যক্রম চালিয়েছিল। ব্রিটিশকে ভারতছাড়া করতে এই বাহিনীর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। মায়ানমারেও রোহিঙ্গা মুসলিমরা অধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন করছে। তাদের মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা সেলভেশন আর্মি সংক্ষেপে আরসা নামে এক চরমপন্থী দলও রয়েছে আর সেই দলের কার্যকলাপের দায়ে নির্বিচারে নিরীহদের হত্যা ও দেশত্যাগে বাধ্য করা মোটেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এরকম ঘটনা আগেও যারা ঘটিয়েছে, তারাও মানবতার নীতিকে ভূলন্ঠিত করেছে। তাই অতীতের বিচারে এখন যারা রোহিঙ্গা নিধনকে পরোক্ষ সমর্থন করতে চাইছে তাদের স্বার্থ এবং দৈন্য চিন্তার জন্য করুণা প্রদর্শন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।