Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমার বিনির্মাণে রোহিঙ্গাদের অবদান

বিবিসির প্রতিবেদনে মোগল সম্রাট জাফরের কবর আবিষ্কার

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নোবেল বিজয়ী অংসান সুচি এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধরা দাবি করছেন রোহিঙ্গা মুসলিমরা আরাকানের নাগরিক নয় তারা বাঙ্গালী। অথচ ইতিহাস তা বলে না। ইতিহাসে দেখা যায় মুসলমানরাই এক সময় মিয়ানমারের শাসন করেছেন; ওই দেশ বিনির্মানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। গতকালও প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিবিসি বাংলা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রেঙ্গুনে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের কবর আবিস্কারের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। শুধু কি তাই? ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সুচির বাবার সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ মুসলিম অনেক নেতা রাজনীতি করেছেন এবং মিয়ানমারের নের্তৃত্ব দিয়েছেন। সু চির বাবা জেনারেল অং সানের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন আবদুল রাজ্জাক। তিনি ছিলেন বার্মা মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি ছিলেন জেনারেল অং সানের গঠিত বার্মার স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভার শিক্ষা ও পরিকল্পনামন্ত্রী। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুলাই অং সানের সঙ্গে যে ছয়জন মন্ত্রী খুন হন তাঁদের অন্যতম ওই রাজ্জাক। অং সান রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৩৩ সালে। ছাত্র সংগঠন আরইউএসইউ ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠার সময় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এম এ রাশিদ। অং সান আরইউএসইউতে ১৯৩৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আর সে বছর তাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এম এ রাশিদ। এম এ রশিদ ছাড়াও ১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত আরাকানের মুসলিম প্রধান এলাকা থেকে সুলতান মাহমুদ, আবুল বাশার, আবদুল গাফ্ফার, জোহরা বেগম এমপি নির্বাচিত হন। আকিয়াবের এমপি সুলতান মাহমুদ যে উ নুর নেতৃত্বে গঠিত ১৯৬০ সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। এমনকি ১৯৯০-এ যখন সামরিক বাহিনীর অধীনেই বার্মায় প্রথমবারের মতো বহুদলীয় নির্বাচন হয় সেখানে শামসুল আনোয়ার, মোঃ নুর আহমেদ, মোঃ ইব্রাহিম, ফজল আহমেদ এমপি নির্বাচিত হন। এরা সবাই মুসলিম এবং রোহিঙ্গদের পূর্বপুরুষ। অং সান সুচি এবং রোহিঙ্গা মুসুলিমদের ওপর নির্যাতককারী বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা যে রোহিঙ্গা মুসলিমরা ‘মিয়ানমারের নাগরিক নয়’ দাবী করছেন তা কার্যত মিথ্যার বেসাতি। বরং বৌদ্ধরাই শুধু নয়; ১৩৫ জাতিসত্ত¡ার দেশ মিয়ানমার গঠনে অন্যান্য জাতির চেয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভূমিকাই ছিল বেশি। অনুসন্ধান ও গবেষণা করে এ চিত্রই পেয়েছে গবেষক-ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
বিবিসি বাংলা গতকালও ইয়াঙ্গুনে শেষ মোগল সম্রাট জাফরের কবর আবিস্কারের কাহিনী তুলে ধরেছে। সেখানে বলা হয় এক শতাব্দীর ওপর শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে হঠাৎ করে তাঁর কবর আবিষ্কৃত হবার পর তাঁকে নিয়ে মানুষের মধ্যে আবার নতুন করে আগ্রহ দেখা দিয়েছে। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর নিজে একজন সুফি সাধক ছিলেন এবং ছিলেন ঊর্দু ভাষার প্রথিতযশা একজন কবি। তিনি সফল হয়েছিলেন কবি ও ঐক্যের প্রতীক হিসাবে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে। ১৮৬২ সালে তদানীন্তন রেঙ্গুনে (আজকের ইয়াঙ্গুন) একটা জরাজীর্ণ কাঠের বাড়িতে তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তাঁর পাশে ছিলেন পরিবারের গুটিকয় সদস্য। যে ব্রিটিশদের হাতে তিনি বন্দী ছিলেন, তাঁর ইনতেকালের দিনই তারা বিখ্যাত শোয়েডাগন প্যাগোডার কাছে এক চত্বরে অজ্ঞাত এক কবরে তাঁকে দাফন করে। পরাজিত, অপমানিত ও হতোদ্যম দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের জন্য সেটা ছিল ৩শ বছরের গৌরবোজ্জ্বল মোগল সাম্রাজ্যের গৌরবহীন পতনের এক অধ্যায়। তাঁর মোগল পূর্বপুরুষরা ৩শ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন বিস্তীর্ণ অঞ্চল- যার মধ্যে ছিল বর্তমানের ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং বাংলাদেশ। তাঁর পূর্বপুরুষ আকবর বা আওরঙ্গজেবের বর্ণময় শাসনকালের মত দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের শাসনকাল হয়ত তেমন গৌরবোজ্জ্বল ছিল না। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাকাল জড়িয়ে গিয়েছিল সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে। বিবিসির আনবারাসন এথিরাজন লিখছেন- ১৯৯১ সাল আকস্মিকভাবে তাঁর কবর উদ্ধার হবার পর অবিভক্ত ভারতের কিংবদন্তী শেষ মোগল সম্রাট আবার ফিরে আসেন মানুষের স্মৃতিপটে। ১৯৮০র দশকে ভারতের একটি টেলিভিশনে ধারাবাহিক নাটক প্রচার হয় তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে। দিল্লি এবং করাচিতে তাঁর নামে রাস্তা আছে, ঢাকায় একটি পার্কের নামকরণ হয় তাঁর নামে। ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডালরিম্পিল, যিনি লাস্ট মুঘল বইটির লেখক, তিনি বিবিসিকে বলেছেন জাফর একজন অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন। ‹ইসলামী শিল্পরীতিতে পারদর্শী, তুখোড় কবি, এবং সুফি পীর জাফর হিন্দু-মুসলমান ঐক্যকে গভীর গুরুত্ব দিতেন। জাফর কখনও নিজেকে বীর বা বিপ্লবী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, তাঁর ব্যক্তিত্বও সে ধরনের ছিল না, কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট আকবরের মত তিনিও ইসলামী সভ্যতার একজন আদর্শ প্রতীক ছিলেন। সে সময় ইসলামী সভ্যতা তার উৎকর্ষে পৌঁছেছিল এবং সেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ে, মি: ডালরিম্পিল লিখেছেন তার বইতে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিশাল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ওই অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হওয়ার পর সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার দায়ে মামলা করা হয়। তাঁকে বন্দী করা হয় ও ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানের মিয়ানমারে (সাবেক বার্মায়) তাঁকে নির্বাসন দেয়া হয়। বন্দী অবস্থায় ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো মরেনি। তিনি লিখতেন জাফর ছদ্মনামে। জাফরের অর্থ বিজয়। ১৭শ সালের শেষ নাগাদ বিশাল মোগল সাম্রাজ্য ছোট হয়ে আসে। ওই এলাকায় মোগলদের প্রতিপত্তিও কমতে থাকে। ১৮৩৭ সালে জাফর যখন সিংহাসনে বসেন তাঁর রাজ্য ছিল শুধু দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকা। কিন্তু তাঁর প্রজাদের কাছে তিনি সবসময়ই ছিলেন বাদশাহ্। অন্যান্য মোগল সম্রাটদের মত তিনিও মঙ্গোলীয় শাসক চেঙ্গিস খান এবং তৈমুর লং-এর প্রত্যক্ষ বংশধর ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি শাসককুলের অবসান ঘটে। সমর্থকদের তাঁর কাছ থেকে দূরে রাখতে ব্রিটিশরা তাঁর কবর নাম-পরিচয়হীন রেখে দেয়। তাঁর মুত্যুর খবর ভারতে পৌঁছায় দু’সপ্তাহ পরে এবং সে খবর প্রায় লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। এরপর একশ’ বছরের ওপর, বাহাদুর শাহ্ জাফরের স্মৃতি মানুষের মন থেকে প্রায় মুছেই গিয়েছিল। ইয়াঙ্গুনের নিরিবিলি এক রাস্তায় রয়েছে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের দরগাহ। ইতিহাসের অন্যতম সবচেয়ে আবেগময় একটা সময়ের নীরব সাক্ষী বহন করছে বাহাদুর শাহ্ জাফরের এই সমাধিসৌধ। স্থানীয় মানুষ যদিও জানতেন স্থানীয় সেনা ক্যান্টনমেন্ট চত্বরের ভেতর কোথাও কবর দেওয়া হয়েছিল ভারতের শেষ মোগল সম্রাটকে। কিন্তু ১৯৯১ সালের আগে কেউ জানতে পারেনি কোনটি ছিল তাঁর কবর। সেখানে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও কবর দেয়া হয়েছিল। সেখানে একটি ড্রেন পাইপের জন্য খোড়াখুড়ির সময় কিছু শ্রমিক একটি ইটের স্থাপনা দেখতে পায়, যেটি সাবেক সম্রাটের কবরের অংশ বলে জানা যায়। এরপর জনসাধারণের দানের অর্থ দিয়ে তা সংস্কার করা হয়। ভারতে জাফরের পূর্বপুরুষদের যেসব জমকালো সমাধি রয়েছে তার তুলনায় দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফরের এই সমাধিটি খুবই সাদামাটা। লোহার ফটকের গ্রিলে তাঁর নাম ও পরিচয় রয়েছে। একতলায় রয়েছে তাঁর একজন স্ত্রী জিনাত মহল এবং তাঁর নাতনি রৌনক জামানির কবর। সমাধিগৃহে এর নিচে রয়েছে জাফরের কবর- তার ওপর ভক্ত ও দর্শনার্থীরা এসে ছড়িয়ে দেন গোলাপ ও অন্য ফুলের পাপড়ি। মাথায় লম্বা ঝাড়বাতি, দেয়ালে তাঁর প্রতিকৃতি। পাশে একটি মসজিদ। ইয়াঙ্গুনের মুসলিমদের কাছে এই দরগাহ খুবই পবিত্রস্থান।ঐতিহাসিকরা বলছেন যখন জাতীয়তাবাদ আর মৌলবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে এমন একটা সময়ে জাফরের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার আদর্শ আরও বেশি করে সামনে আসা উচিত ছিল। ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়ে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর হয়ত তাঁর রাজ্য, ক্ষমতা ও উপাধি হারিয়েছিলেন, কিন্তু একজন সুফি-সাধক, কবি ও ঐক্যের প্রতীক হিসাবে মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে তিনি সফল হয়েছিলেন। অর্থাৎ সুচি এবং বৌদ্ধরা যে এখন দাবি করছেন রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাঙ্গালী; তা ধোপে টেকে না। বরং রোহিঙ্গা মুসলিমরাই হলেন রাখাইনের ভূমিপুত্র এবং মিয়ানমার বিনির্মাণে অন্যান্যদের মতো তাদের পূর্ব পুরুষদের অবদান রয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলিমরা ভূমিপুত্র না হলে তাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে মিয়ানমারের মন্ত্রী-এমপি হন?



 

Show all comments
  • আবির ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ৩:৪৪ এএম says : 0
    আশা করি এই নিউজ দেখে সুচি ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ