Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারে ভিন্ন কৌশলে চলছে নির্যাতন

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা নির্মূলে মিয়ানমারের সেনারা নতুন কৌশলের নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তা সহ্য করতে না পেরে দলে দলে রোহিঙ্গারা জারিকেন নিয়ে সাঁতারিয়ে এবং জারিকেন ও বাঁশের তৈরী ভেলা ভাসিয়ে প্রায় দু-শতাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্তের শাহপরীরদ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। তারা অনেক দিন মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করেছিল। সেখানে খাদ্য সঙ্কট ও তীব্র পানির সঙ্কট দেখা দিলে তারা বাংলাদেশে দিকে চলে আসছে। আবার অনেক রোহিঙ্গা এত দিন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রভাবশালী মগদের অর্থ দিয়ে নিজ বাড়িতে থাকতে পারলেও এখন চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ সেনা সদস্যরা এখন রোহিঙ্গাদের বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছে না তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখছে। বের হলেই প্রাণে মেরে ফেলা হচ্ছে। দীর্ঘ দিন বাড়িতে অবরুদ্ধ থেকে অনেকেই না খেয়ে মারা যাচ্ছেন। এ কারণে নতুন করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দেয়ায় কান্তি, অসুস্থতা ও ক্ষুধা সব মিলিয়ে সব রোহিঙ্গাই বিধ্বস্ত। অনেকে হাঁটতেই পারছিলেন না। এ সময় অনেক রোহিঙ্গাকে কুলে করে নয়াপাড়া ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসেন।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে নিরুৎসাহিত করার জন্য সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে বিজিবি। একইভাবে রোহিঙ্গাদের সাথে ইয়াবা ও অস্ত্র আসছে এমন খবরও চাউর হওয়াতে আরো বেশি সতর্ক হয় বিজিবি। এ জন্য সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজিবি সদস্যরা ব্যাপক তল্লাশি চালান, কিন্তু কারো কাছে এমন কিছু পাওয়া যায়নি বলে বিজিবি সূত্র জানায়।
সূত্র মতে, রাখাইনে এখন পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। তবে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের কাছ থেকে দুই জন করে বিনা পয়সায় শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হবে। না হয় তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালিয়ে মেরে ফেলা হয়।
বর্তমানে রাখাইনের পরিস্থিতি শান্ত থাকার পরও কেন তারা বাংলাদেশে চলে আসছেন জানতে চাইলে ভেলায় ভেসে পালিয়ে আসা বুচিডং কর্নারিকোয়াপাড়ার সলিম উল্লাহসহ অনেকে বলেন, আরাকানে এখনো যারা আছেন তারা সবাই অবরুদ্ধ। কাউকে ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না সেনারা। খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেকে অনাহারে মারা যাচ্ছেন। কিছু কেনার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেই তাদের হত্যা করা হচ্ছে। মিয়ানমার সেনারা চায় সবাই না খেয়ে মরুক। এমন অবস্থা থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা একজোট হয়ে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।
তারা জানান, বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে মানুষ বেশি থাকলে মিয়ানমার সেনারা আক্রমণ করে না, কিন্তু অল্পসংখ্যক লোক হলে প্রত্যেককেই হত্যা করছে তারা। কোনো কোনো এলাকায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার জন্য এখনো মাইকিং করছে সেনারা। যেসব সম্পদশালী রোহিঙ্গা সেনাদের অর্থ দিয়ে রাখাইনে থাকতে চেয়েছিলেন তারাও এখন চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এমন একজন সচ্ছল রোহিঙ্গা জাবেদ। বুচিডং টাউনশিপের আলিআংয়ে তার বাড়ি, দোকান, জমিজমা সবই ছিল। এত দিন তিনি নিজ বাড়িতে থাকার জন্য লাখ লাখ কিয়াত দিয়েছেন মিয়ানমার সেনাদের, কিন্তু তাকেও শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে হয়েছে।
সে আরো জানায়, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় মতাবানদের টাকা দিয়ে এত দিন তিনি নিজ এলাকায় থেকে গিয়েছিলেন। তবে এখন টাকা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। সব কিছু ফেলে তিনি পরিবারের ৫ জন নিয়ে ১০ দিন হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন।
এছাড়া আরাকানের বুছিদং এলাকার রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে জোর করে বাঙ্গালী বলে কার্ড নিতে বাধ্য করা এবং তাদের খাবার সংকটের কারণে এতদিন ধরে ওখানে খেয়ে না খেয়ে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা এখন পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান এই পারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সেনাদের ক্যাম্পে রোহিঙ্গা লোকজনদের ডেকে এনে বর্মী ভাষায় বাঙালী লেখা কার্ড নেয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করছে। সেনাবাহিনীর জার নয়া কৌশল অনুমান করতে পেরে শিক্ষিত রোহিঙ্গারা এসব কার্ড গ্রহণ করছেনা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বর্মী সেনারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে গরু, ছাগল, হাস, মুরগি, ধান, চাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়ী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবং মেরে ফেলার হুমকি প্রদর্শনের মত হিংসাত্মক আচরণে বুচদিং এর ২০টি গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যে কারণে রোহিঙ্গারা দলে দলে এপারে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে। মিয়ানমার সেনারা এবার শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে না। তবে বাড়িঘরের মালামাল লুটপাট করছে। বিতরণ করছে বাঙ্গালী লেখা সাদা কার্ড। কার্ড নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাদের হাতে থাকা বন্দুক তাক করে রাতারাতি দেশত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছে।
এসব কারণে রোহিঙ্গারা নৌকা না পেয়ে জারিকেন নিয়ে সাঁতারিয়ে এবং জারিকেন ও বাঁশের ভেলা ভাসিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা টেকনাফ শাহপরীরদ্বীপে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। গত দুই দিনে প্রায় দু’শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
তারা বিশেষ করে রাখাইনের বুছিডং ও রাশিডং থানার বাসিন্দা। ভেলায় ভেসে আসা রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। তারা মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া ও দমংখালী এলাকায় অবস্থান করেছিল এবং ভেলায় ভাসিয়ে বইঠা চালিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া ও জেটিঘাটে পৌঁছেন।
আগত রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, গত দুই মাস যাবৎ দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটলেও গত কয়েকদিন ধরে এপার থেকে রাখাইন সীমান্তে কোন নৌকা না যাওয়ায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে আছে। বর্তমান সময়ে মিয়ানমার থেকে পালাতে নৌকার সংকট দেখা দেওয়ায় দু’শতাধিক রোহিঙ্গা এপারে আসে। কিন্তু এবার প্রথম নারী-শিশু ও পুরুষ ভেলায় ভেসে এসেছে।
এ ব্যাপারে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে.কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানায়, মিয়ানমারে এখনো কৌশল পাল্টিয়ে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তাই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের দিকে চলে আসছে। পালিয়ে আসাদের তল্লাশী করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ