হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আশা এমন এক জিনিস, যা মৃত্যুর শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত বেঁচে থাকে। আশায় বার বার প্রলোভিত হয়েও মানুষ তাকেই আঁকড়ে ধরে। আশাবাদী মানুষ আবার সব দেশে একরকম হয় না। একেক দেশের মানুষের আশার মাপকাঠি ভিন্ন ভিন্ন হয়। বাংলাদেশের মানুষ পৃথিবীর সব দেশের মানুষের চেয়ে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী। তারা আশায় আশায় দিন কাটায়। ব্যর্থ হলেও হতাশ না হয়ে পুনরায় আশায় বুক বাঁধে। এমনটিই দেখা গেছে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জরিপ প্রতিষ্ঠান উইন-গ্যালপ-এর করা এক জরিপে। জরিপে উল্লেখ করা হয়, নতুন বছর নিয়ে সার্বিকভাবে শীর্ষ আশাবাদী বা সুখী দেশ বাংলাদেশ। শীর্ষ হতাশাবাদী দেশ ইতালি। বিষয়টি একটু অদ্ভুতই মনে হতে পারে। যেখানে বাংলাদেশের মানুষ নানা দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বসবাস করে, তারাই কিনা ইতালির মতো ধনী দেশের চেয়ে সবচেয়ে বেশি সুখী! অবশ্য জরিপ বা পরিসংখ্যান সবসময় সঠিক সূচক নির্দেশ করে না। এ নিয়ে বিতর্ক থাকে। তবে জরিপের ফলাফল ধরে নিলেও এ কথা সত্য, বাংলাদেশের মানুষের ধৈর্য্য অনেক বেশি। তারা শত দুঃখ কষ্টেও ‘ভালো কিছু হবে’-এ আশায় থাকে। পুরোপুরি ‘ভালো কিছু’ না পেলেও আশার কিছু অংশ পূরণ হলেই তারা বেজায় খুশি হয়। আশার এই কিছু অংশই তাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। একে বলে অল্পতেই তুষ্ট এবং যা পেয়েছি আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকর গুজার করা। তারা মনে করে, এই অল্পই একদিন অনেক বেশি হয়ে দেখা দেবে। আশার এই খেয়ালি আচরণ তারা মনে নিয়েছে। তা না হলে বাংলাদেশে যেসব অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটে, এসব ঘটনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় দেশটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো, তা অনুমান করা কঠিন নয়। এজন্য আমরা বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন দলগুলো থেকে বলতে শুনেছি এবং এখনও শুনি, অমুক সরকার এই করেছে বলে দেশের এই অবস্থা হয়েছে। এই না করলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যেত। এখন তারা এই অবস্থা থেকে টেনে তুলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা একটুও ভাবে না, তারা আশাভঙ্গের অনেক কাজ করলেও জনগণের আশাবাদী ও অল্পতে তুষ্ট হওয়ার অনাদিকালের চরিত্রের কারণেই বাংলাদেশের আশা টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। যদি অল্পতে তুষ্ট না হতো, তবে সরকার যেসব ভুল করে, তাতে দেশে বছরের পর বছর গোলোযোগ লেগেই থাকত। জনগণের পরিমিত আশার কারণেই নানা সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশ অগ্রসরমান। তবে মাঝে মাঝে এমন কিছু দুর্ঘটনা ঘটে যা বোধসম্পন্ন মানুষের মন দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। ¯্রফে দুর্ঘটনা হলেও, মানতে বড় কষ্ট হয়। এমন দুর্ঘটনা প্রতিদিনই বাংলাদেশে ঘটে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে কিছু দুর্ঘটনা সব দুর্ঘটনার ‘মুখ’ হয়ে উঠে। এ নিয়ে কিছুদিন আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর থেমে যায়। এমন আরেকটি দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত চৈতন্য জাগ্রত হয় না। অথচ এই চলমান দুর্ঘটনা জাতীয় জীবনে দুর্যোগ হয়ে রয়েছে। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের যেন কোনো উপায় নেই।
দুই.
গত শনিবার রাজধানীতে ৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনা দুটিকে দুর্ঘটনা না বলে হত্যাকা- বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ বেপরোয়া বাস চালক চাপা দিয়েই মানুষ মেরে ফেলেছে। একটি দুর্ঘটনা ঘটে মৎস্য ভবনের সামনে। আরেকটি শাহবাগের মোড়ে। এক কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সাবিহা আক্তার ও খাদিজা আক্তার নামে দুটি কোমল প্রাণ কেড়ে নেয় বাস দুটির বেপরোয়া চালক। জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া সাবিহা আক্তারের স্বপ্ন ছিল সে ডাক্তার হবে। তার বাবা রংমিস্ত্রি জাকিরের সব স্বপ্ন ও আশা ছিল মেয়েকে নিয়ে। মেয়েকে আদর করে সোনালি বলে ডাকতেন। সেগুনবাগিচার বেগম রহিমা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৫ সালের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণের পথেই ছিল সোনালি। তার সে স্বপ্ন ও আশা কেড়ে নেয় বেপরোয়া চালক। ময়নাতদন্তের পর মেয়ের লাশ বুঝে নেয়ার আগে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন জাকির। কাঁদতে কাঁদতেই বলছিলেন, ‘দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমার স্বপ্ন ছিল। ছেলে সাজ্জাদ হোসেন নরসিংদী পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছে। মেয়েটা আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখত। বলত, বাবা তোমার সব কষ্ট দূর করে দেব। আমার সেই স্বপ্নকে লাশ বানিয়ে দিল বাস। জানি বিচার পাব না। বিচার হবে না।’ সোনালি তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। শনিবার সকাল আটটায় সেগুনবাগিচার বাসা থেকে বের হয়েছিল নতুন স্কুলে ভর্তির কাজ সারতে। একই দিনে বাবা নতুন জামা কিনে দেবে বলে বলেছিলেন। সোনালির ভর্তি হওয়াও হয়নি, নতুন জামাও পরা হয়নি। জাকির কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, নতুন কাপড় কিনলাম ঠিকই, কিনলাম কাফনের কাপড়। খাদিজা কুমিল্লা থেকে ঢাকা এসেছিল বোনের বাড়ি বেড়াতে। প্রাথমিকে জিপিএ-৫ পাওয়া খাদিজার শখ ছিল শিশু পার্ক যাবে। রাস্তা পার হওয়ার সময় বাস তাকে চাপা দিয়ে তার আশা-আকাক্সক্ষা পিষে ফেলে। হৃদয় বিদীর্ণ করা এ দুটি ঘটনা মনে করিয়ে দেয় প্রায় পাঁচ বছর আগে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হামিমের কথা। সেও বাবার হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছিল। বেপরোয়া বাস হামিমকে বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিষে ফেলে। রাস্তার উপর পড়ে থাকা হামিমের লাশের ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কাপড় দিয়ে ঢাকা হামিমের দেহ ঢাকা গেলেও, তার কচি দুটি পা যেন কোনো কিছুই ঢেকে রাখতে পারেনি। এ ছবি দেখে তখন অনেকের চোখ ছলছল করে উঠে। হৃদয় হাহাকার করে। সেই হাহাকার যেন আবার ফিরিয়ে আনল সোনালি ও খাদিজা। আমাদের যেন নিয়তিই হয়ে দাঁড়িয়েছে, একশ্রেণীর ড্রাইভার নামক দানবের কাছে স্বপ্ন ও আশাকে বন্ধক রাখতে হবে। তারা যখন খুশি তখন, তা কেড়ে নেবে। এদের প্রতিরোধের যেন কেউ নেই। সরকারের তরফ থেকে কত প্রতিশ্রুতি, কত উদ্যোগের কথা শুনি! মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটলে এক মন্ত্রীকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই। পত্র-পত্রিকায় যখন বেপরোয়া চালকদের ঘাতক বলা হয়, তখন তিনি প্রতিবাদ করে বলেছেন, তাদের ঘাতক বলা যাবে না। প্রবল সমালোচনার মুখে যখন ঘাতক ড্রাইভারদের শাস্তির জন্য কঠোর বিধান করা হয়, তখনও তাকে আপত্তি তুলতে দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত সরকার শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে আইন করে। তখন ‘গুরু পাপে লঘু দ-’ হিসেবে সমালোচিত হলেও, তাতে কর্ণপাত করা হয়নি। এর ফলে ভুয়া লাইসেন্সধারী বেপরোয়া চালকরা এক ধরনের দায়মুক্তি পেয়ে যায়। তারা ডেমকেয়ার হয়েই গাড়ি চালাতে থাকে। তাদের এই বেপরোয়া আচরণে প্রতিদিনই দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে রক্ত ঝরছে। কত আশা, কত স্বপ্ন নিমেষেই কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। পরিবারগুলোর হাহাকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। যে বেপরোয়া চালকের কারণে পরিবারগুলোর আশা ও স্বপ্ন চুরমার হচ্ছে, তারা ঠিকই ধরাছোঁয়ার বারইরে থেকে যাচ্ছে। তাদের টিকিটিও ধরা যাচ্ছে না।
প্রতি বছরই সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ও হতাহতের পরিসংখ্যান বের হয়। মূলত এ পরিসংখ্যান মানুষের আশা ও স্বপ্ন হত্যারই পরিসংখ্যান। বছরে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং কত মানুষের আশা সমাধিস্থ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখলে শিউরে না উঠে পারা যায় না। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনটি এক সংবাদ সম্মেলন করে গত দুই বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে। সংগঠনটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালে মৃত্যু হয়েছে ৬৫৮২ জনের। আহত হয়েছে, ১০ হাজার ৭৭০ জন। ২০১৫ সালে মৃত্যু হয়েছে ৫০০৩ জনের। আহত হয়েছে ৬ হাজার ১৯৭ জন। সংগঠনটির তরফে এ কথাও বলা হয়েছে, এই তথ্য শুধু পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এর বাইরেও আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা কোনো মিডিয়ায় উঠে আসেনি। তার অর্থ হচ্ছে, দুর্ঘটনায় আহত-নিহত হওয়ার সংখ্যা অবধারিতভাবেই আরও বেশি। যদি একবার ভাবা যায়, যে পরিবারের একমাত্র উপাজর্নক্ষম ব্যক্তি ও উজ্জ্বল নক্ষত্র হওয়ার সম্ভাবনাময় যে সন্তানটি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে, সে পরিবারটি কী অবস্থায় রয়েছে, তাহলে কি কোনো মানুষের সুস্থির থাকা সম্ভব? সড়ক দুর্ঘটনায় কি শুধু একটি পরিবারেরই ক্ষতি হয় নাকি দেশ ও অর্থনীতিরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়? এ প্রশ্নের উত্তর বিভিন্ন সময়ে পরিসংখ্যানে দেয়া হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় শতকরা ৭৫ ভাগ কর্মক্ষম ও কর্মরত মানুষের মৃত্যু হয়। এদের বেশির ভাগই তরুণ। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় একজন কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু মানে একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলে ব্যক্তিটি পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়। এ বোঝা শুধু পরিবারের নয়, রাষ্ট্রের এবং অর্থনীতিরও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর জিডিপির শতকরা ১.৬ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা যে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সর্বোপরি অর্থনীতির উন্নতির আশা করছি, এ হারে যদি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, তাহলে এ আশা কি কুহকীনিতে পরিণত হচ্ছে না?
তিন.
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে বহু কথা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। বাস্তবে দেখা গেছে, এতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। মাঝে মাঝে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাকডাক দিয়ে কাজ শুরু করলেও, কিছুদিন না যেতে তার কোনো খবর থাকে না। আরেকটি মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনা ঘটলে বা কোনো বিশিষ্ট জনের মৃত্যু হলে, পুনরায় তোড়জোড় শুরু হয়। দুর্ঘটনার মূল কারণ যে বেপরোয়া চালক ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, তা অনেক আগেই চিহ্নিত হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটি। নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে লাইসেন্সকৃত গাড়ির সংখ্যা ২১ লাখ এবং অবৈধ গাড়ির সংখ্যা ১০ লাখ। আরেক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের গাড়ি চালকদের শতকরা ৮০ ভাগেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স নাকি ভুয়া। এই ভুয়া লাইসেন্সধারীরা আবার মন্ত্রী-এমপিদের পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে। এই যদি হয় পরিস্থিতি, তবে দুর্ঘটনার সংখ্যা কি কমার কোনো কারণ আছে? আশা ও স্বপ্নের সমাধি হওয়া কি ঠেকানো যাবে? অনেকে ভাবতে পারেন, এই পরিস্থিতিতে প্রতিদিন সড়ক-মহাসড়কে লাশের পর লাশ পড়ে থাকার কথা! এ তুলনায় তো কমই হচ্ছে। রুঢ় হলেও বাস্তবতা এটাই। এই বাস্তবতা কচু গাছ কাটতে কাটতে ডাকাত হওয়ার মতো। অর্থাৎ নবিশ ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকরা দুর্ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে দক্ষ হয়ে উঠেছে। যাকে বলে স্বশিক্ষিত। স্বশিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতদের মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে, তা ঐসব বেপরোয়া গাড়ি চালকরা মানতে চায় না। তারা মনে করে, আমি গাড়ি চালাতে পারছি, এটাই তো যথেষ্ট। তারা এটা মনে করে না, গাড়ি চালাতে আইন-কানুন এবং মানসিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এই দুইয়ের সমন্বয় না হলে দুর্ঘটনা অবধারিত এবং তাই তাদের দ্বারা ঘটে চলেছে। এটা অনেকটা শিশুর হাতে ছুরি তুলে দেয়ার মতো। তাদের এই ছুরিই এলোপাতাড়িভাবে অসংখ্য মানুষের আশা ও স্বপ্ন কচুকাটা করে চলেছে। যদি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা যায় তবে হয়তো দেখা যাবে, সোনালি ও খাদিজাকে যে দুই বাস চালক চাপা দিয়েছে, তাদের চালকদের একজনেরও বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
বলা হয়, খোদ রাজধানীতে যদি যানজট না থাকত, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যে কত মানুষের প্রাণহানি ঘটত, তা কল্পনাও করা যায় না। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও এআরআইয়ের সাবেক পরিচালক সামছুল হক যথার্থই বলেছেন, ঢাকার চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। বাসে বাসে ধাক্কাধাক্কি হয়। ফুটপাত দখল হওয়ার কারণে মানুষ যেভাবে সড়ক ধরে হাঁটে, তাতে হতাহতের সংখ্যা যে আরও বেশি হয় না, সেটাই ভাগ্য। যানজট কিছুটা বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার এ কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঢাকা শহর যদি যানজটমুক্ত থাকত এবং যেসব চালকের হাতে এখন গাড়ির স্টিয়ারিং, তাতে রাজধানীর সড়কগুলো লাশের মিছিলে পরিণত হতো। গাড়ি চালকদের এই বেপরোয়া মনোভাবের সাথে যুক্ত হয়েছে সড়ক-মহাসড়কের ত্রুটিপূর্ণ সংস্কার ও নির্মাণ কাজ। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, দেশব্যাপী দুর্ঘটনা প্রবণ প্রায় পাঁচ শতাধিক বিপজ্জনক এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, এলাকা চিহ্নিত হয়েছে ঠিকই, তবে সেগুলোর সংস্কার কাজ এগোয়নি। মহাসড়কে অবৈধভাবে হাট-বাজার বসার পাশাপাশি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে নসিমন, করিমন, ভটভটি, অটোবাইক, ট্রলি ইত্যাদির চলাচলকেও দায়ী কার হয়েছে। কয়েক মাস আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করলেও। তাতে কোনো কাজ হয়নি। অবাধেই এসব যানবাহন চলাচল করছে। এছাড়া মহাসড়কের সাথে বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য সরুপথ যুক্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশে যেগুলোকে মহাসড়ক বলা হয়, আদতে সেগুলো মহাসড়ক নয়। কারণ মহাসড়কের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া তাতে কোনো ধরনের এলাকাভিত্তিক রাস্তা যুক্ত হবে না। উন্নত বিশ্বের মহাসড়ক লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেগুলোতে এলাকাভিত্তিক কোনো রাস্তা এসে যুক্ত হয়নি। এগুলো শাখা-প্রশাখাহীন একক সড়ক। বাংলাদেশে এ ধরনের মহাসড়ক নেই। দেখা যায়, হুট করেই পাশের কোনো এলাকা থেকে গাড়ি এসে মহাসড়কে উঠে পড়ছে। এতে যে গাড়িটি দ্রুত গতিতে চলছে, তার পক্ষে গতি নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে অবধারিতভাবেই দুর্ঘটনা ঘটে।
চার.
আমরা আশাবাদী জাতি। যেটুকু আশা ও স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সেটুকুও যদি বাঁচিয়ে রাখতে না পারি, তাহলে কিভাবে এগোবো? বেপরোয়া গাড়ি চালকরা অফুরন্ত আশা, স্বপ্ন ও মেধা পিষে মারবে, এটা কিছুতেই হতে পারে না। দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই, এটা যেমন সত্য, তেমনি ভুয়া লাইসেন্সধারী ও বেপরোয়া গাড়ি চালকদের হাতে মানুষ আহত-নিহত হবে, তা মেনে নেয়া যায় না। আমরা যদি বছর দুয়েক আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরিডুবিতে কয়েকশ’ মানুষের মৃত্যুর ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখব এ দুর্ঘটনায় কারোই হাত ছিল না। তারপরও দুর্ঘটনার দায় নিয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী পদত্যাগ না করুক, অন্তত দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার কার্যকর পদক্ষেপ নিক, এটুকু তো আশা করতে পারি। সড়ক দুর্ঘটনা যে মহাদুর্যোগে পরিণত হয়েছে, এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। উপলব্ধি করলে নিশ্চয়ই কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হতো। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের পদক্ষেপ আমরা দেখছি না বলেই একের পর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। দুর্ঘটনায় মেধাবীদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশ ক্রমেই মেধাশূন্যতার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার নামে কর্মক্ষম ও কর্মজীবী মানুষের মৃত্যুতে তার পরিবার যেমন নিঃস্ব হচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি হচ্ছে। প্রশ্রয়প্রাপ্ত যেসব বেপরোয়া চালক দেশের এই অপূরণীয় ক্ষতি করে চলেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কিছু সংখ্যক বেপরোয়া চালক মানুষের আশা ও স্বপ্ন কেড়ে নেবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বেপরোয়া চালকদের বোঝা উচিত এবং তাদের বোঝাতে হবে, তাদের এই ধরনের আচরণে তারও মৃত্যু হতে পারে। তার আশা ও স্বপ্নের মৃত্যু হয়ে পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। সোনালি ও খাদিজার বাবা-মায়ের যে স্বপ্নের মৃত্যু হলো, তা কি কোনোদিন পূরণ হবে? আমাদের সবার এ জায়গাটুকুতে মনোযোগ দিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।