হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
পত্র পত্রিকার রিপোর্ট মোতাবেক আগামী ৮ নভেম্বর বুধবার সিপাহী জনতার বিপ্লব দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার জন্য বিএনপি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট অনুমতি চেয়েছে। ৫ নভেম্বর রবিবার রাতে যখন এই কলামটি লিখছি তখন পর্যন্ত জনসভার অনুমতি পেয়েছে বলে জানা যায়নি। অগ্রিম কোনো কথা বলা যায় না, উচিৎও নয়। কিন্তু ৮ তারিখে যেখানে জনসভা হওয়ার কথা সেখানে ৭ তারিখে অনুমতি দিলে সেই জনসভা হবে কিভাবে? আমার মনে হয় সেই অনুমতি মিলবে না। এ প্রসঙ্গে গত বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসের কথা মনে পড়ে। সেদিনও বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করার জন্য পুলিশের কাছে দরখাস্ত করে। কিন্তু পুলিশ এ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ কঠোর হুঙ্কার দিয়েছিলেন। তিনি সেদিন সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বিএনপিকে ৭ নভেম্বরের কর্মসূচি পালন করতে দেয়া হবে না’। জনাব হানিফ আরও বলেছিলেন, পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বরের ঘটনা আড়াল করতে সিপাহী বিপ্লবের নামে পঁচাত্তরের ঘাতক গোষ্ঠি তথাকথিত বিপ্লব দিবস পালন করে। এই দিন তারা হাজারও সেনাবাহিনী সদস্য হত্যা করেছে। এই সেনাবাহিনী হত্যাকারীদের মাঠে নামার কোন সুযোগ দেয়া হবে না। তাদেরকে কঠোরভাবে প্রতিহত করা হবে। বিপ্লবের নামে এই ঘাতকদের আশ্রয় প্রশ্রয় দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর ফাঁসি দাবি করে হানিফ বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার নেপথ্যে ছিলেন জিয়াউর রহমান। এই খুনি জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের মাধ্যমে ৭৫ এর ৩ নভেম্বরের কলঙ্কের কিছুটা হলেও মোচন হবে।
সেদিন জনাব হানিফ যেসব কথা বলেছিলেন তারপরে ঠিক এক বছর পার হলো। এই এক বছরে, হানিফের ভাষায়, হাজার হাজার সেনা সদস্যের ‘হত্যার’ কোনো বিচার হয়নি। হানিফ সাহেব মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর ফাঁসি দাবি করেছিলেন। মরণোত্তর ফাঁসি তো দূরের কথা, তার কোন রূপ বিচার অনুষ্ঠানেরও বিন্দুমাত্রও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাহলে এসব সিরিয়াস কথা এসব সিনিয়র নেতা কেন বলেন? আপনি যদি রাজনীতি নিরপেক্ষ হন, আপনি যদি দল নিরপেক্ষ হন, তাহলে গণতন্ত্র দাবি করে যে, প্রত্যেককে তাদের কথা বলার অধিকার দিতে হবে। আওয়ামী লীগ জিয়াউর রহমানসহ বিএনপিকে জেল হত্যার দায়ে অভিযোগ করেই যাচ্ছে। হাজার হাজার সেনা সদস্যের হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছে। গত ৯ বছর থেকে আওয়ামী লীগ ৩রা নভেম্বর পালন করছে। তারা ৭ই নভেম্বরকে হত্যা দিবস হিসেবে পালন করছে। ঠিক আছে, তারা করুক। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রত্যেককেই তাদের নিজ নিজ কথা বলার অধিকার দিতে হবে।
তাহলে সেই একই যুক্তিতে বলা যায় যে, বিএনপি তথা অন্যান্য বিরোধী দলকেও ৭ই নভেম্বরে তাদের কথা বলতে দিতে হবে। তারা ৭ই নভেম্বরকে সিপাহী জনতার বিপ্লব দিবস হিসেবে মনে করে। আওয়ামী লীগ ৭ই নভেম্বরকে হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে। তাহলে বিএনপিসহ বিরোধী দলকেও ৭ই নভেম্বর বিপ্লব দিবস হিসেবে পালন করতে দেওয়া হোক। আপনি শুধু আপনার কথা বলবেন। আর আপনার প্রতিপক্ষ তাদের কথা বলতে গেলে তাদেরকে সভা করার পারমিশন দেবেন না, রাস্তায় মিছিল করতে দেবেন না, পোষ্টার মারতে দেবেন না। এগুলো কেমন কথা? গণতন্ত্রের কোন নীতিটি এখানে মানা হচ্ছে? এটি হত্যা দিবস নাকি বিপ্লব দিবস, আখেরে তার চ‚ড়ান্ত বিচার কে করবে? সেই বিচার তো করবে জনগণ। আপনারা জনগনের কাছে যাচ্ছেন, কিন্তু অন্যেরা জনগনের কাছে যেতে চাইলে বাধা দেবেন। এটা কোন ধরণের গণতন্ত্র?
\দুই\
৩রা নভেম্বর ও ৭ই নভেম্বরকে নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলই শুধু নয়, প্রধান দুই রাজনৈতিক ক্যাম্পের মধ্যেও রয়েছে দু’ রকম অবস্থান। একটি উত্তর মেরুর অবস্থান, আরেকটি দক্ষিন মেরুর অবস্থান। ইংরেজিতে যাকে বলে Poles apart. ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা সংঘঠিত হয়েছিল, কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু এই ৩রা নভেম্বরই তো জারি হয়েছিল দ্বিতীয় মার্শাল ল’। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে মেজর জেনারেল হিসেবে প্রমোশন দেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে ঘোষনা করেন। সাফায়েত জামিলকে কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার পদে প্রমোশন দেন। তারা দু’ জন প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও চিফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিষ্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ দেন, মার্শাল ল’ জারি করেন, সংবিধান বাতিল করেন এবং জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। তিনি মন্ত্রীসভাও ভেঙ্গে দেন। বিচারপতি সায়েম ছিলেন দ্বিতীয় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তার সময়কালেই জারি হয় দ্বিতীয় মার্শাল ল’।
বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে তিন বার। সিএমএলএ এসেছেন তিনজন। প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি সামরিক আইন জারি করলেও সংবিধান বাতিল করেননি বা স্থগিতও করেননি। তার আমলে সংবিধান কার্যকর ছিল। সংসদও চালু ছিল। তিনি যে মন্ত্রী সভা গঠন করেছিলেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য। কিন্তু মোশতাকের ক্ষেত্রে গোড়ায় যে গলদটি ছিল সেটি ছিল এই যে, যেহেতু সংবিধান চালু ছিল তাই প্রেসিডেন্ট পদে তার সমাসীন হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভাইস প্রেসিডেন্টকে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করার কথা। আর সেটি না হলে স্পিকার প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন।
৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ছিল চরম বিভ্রান্তি ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিস্থিতি। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে কর্নেল ফারুকের ট্যাঙ্ক বাহিনীকে বঙ্গভবন থেকে হটিয়ে দেয়া হয় এবং ব্যাংকক পাঠিয়ে দেয়া হয়। খন্দকার মোশতাক আহমেদ সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন এবং এই দুই সামরিক অফিসারের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন। মোশতাকের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ছিল না। তাকে প্রেসিডেন্ট পদে বসান কর্নেল ফারুক, কর্নেল রশিদ ও মেজর ডালিম সহ ১৭ জন সামরিক অফিসারের নেতৃত্বাধীন সেনা বাহিনীর ঐ অংশটি যারা ১৫ অগাষ্ট সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন। দৃশ্যপট থেকে সামরিক বাহিনীর এই অংশটি অপসারিত হলে খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর অপর অংশ ক্ষমতা দখল করেন। তারা কি করবেন, সেটি নিয়ে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। তাই তারা ৩ ডিসেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত খন্দকার মোশতাককেই প্রেসিডেন্টের গদিতে রাখেন। ৬ তারিখ রাতে তারাই মোশতাককে সরিয়ে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসান। এই তিনদিন কার্যত বাংলাদেশ ছিল সরকার বিহীন এবং দেশে বিরাজ করে চরম অরজকতা। আসলে খন্দকার মোশতাক এবং বিচারপতি সায়েম ছিলেন সেনাবাহিনীর ফারুক রশিদ গ্রুপ এবং খালেদ মোশাররফ গ্রুপের শিখন্ডি। বিচারপতি খায়রুল হক এবং বিচারপতি ফজলে কবিরের ডিভিশন বেঞ্চ যদি এ বিষয়টি আরো ভালভাবে বর্ণনা করতেন তাহলে হয়তো সব দোষের জন্য মোশতাক এবং সায়েমকে ‘নন্দ ঘোষ’ হিসেবে চিহ্নিত হতে হতো না।
ফারুক-রশিদ যে কাজটি মোশতাককে দিয়ে করাননি সেই কাজটি খালেদ-জামিল সায়েমকে দিয়ে করিয়েছেন। মোশতাককে দিয়ে সংবিধান বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু খালেদ-জামিলরা সংবিধান স্থগিত করেন। মোশতাককে দিয়ে জাতীয় সংসদও বহাল রাখা হয়েছিল। কিন্তু খালেদ-জামিল জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন। সুতরাং যাকেই স্কেপগোট বানানো হোক না কেন, নেপথ্য নটরাজকে বের করতে না পারলে ইতিহাস বিকৃত হবে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাচ্ছে যে, ১৫ অগাষ্ট খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল সেটি সংবিধান সম্মত ছিল না। কিন্তু তা সত্তে¡ও ইতিহাস থেকে এটিও দেখা যাচ্ছে যে, সরকার গঠনের পর ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে ওই সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর, রক্ষী বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী প্রধানগণ। সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত এবং আমেরিকাসহ পৃথিবীর সমস্ত রাষ্ট্র। উচ্চ আদালতের রায়ে ক্ষমতার অবৈধ দখলদারদের তালিকায় এসেছে তিনটি নাম। সেই তিনটি নাম হলো- খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রধান বিচারপতি সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান। বিচারপতি সায়েম দৃশ্যপটে এসেছেন ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা রাতে। জেনারেল জিয়া দৃশ্যপটে এসেছেন ৭ই নভেম্বর দিনের বেলায়। কিন্তু মাঝখানে একটি ছোট্ট সময় রয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে যে, সেই সময়টি মহামান্য আদালতের সুদীর্ঘ ও সারগর্ভ রায় থেকে হারিয়ে গেছে।
\তিন\
আমি একটু অবাক হই, যখন দেখি যে উচ্চ আদালতেও সামরিক শাসন এবং সামরিক প্রশাসক নিয়ে বেশ কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। কয়েকটি বিষয়ে কোন বিভ্রান্তি থাকা উচিৎ নয়। এগুলো হলো, (১) খন্দকার মোশতাক সামরিক শাসন জারি করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হননি। (২) তিনি সামরিক আইন জারি করেছিলেন, কিন্তু সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করেননি। (৩) তিনি সামরিক আইন জারি করেছিলেন, কিন্তু সংসদ ভেঙ্গে দেননি। (৪) তিনি সামরিক আইন জারি করেছিলেন, কিন্তু সংসদ সদস্যদেরকে দিয়ে মন্ত্রী সভা গঠন করেছিলেন। (৫) খালেদ মোশাররফ দ্বিতীয় সামরিক আইন জারি করেছিলেন। (৬) খালেদ মোশাররফ সংসদ ভেঙ্গেছিলেন, সংবিধান বাতিল করেছিলেন এবং মন্ত্রী সভা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। (৭) প্রধান বিচারপতি সায়েম বাংলাদেশের প্রথম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। (৮) জিয়াউর রহমান কোন সামরিক আইন জারি করেননি। তবে বিচারপতি সায়েমের পর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।