ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
(গতকাল প্রকাশিতের পর)
মনে হলো আমাদের প্রতিক্ষায় সে আছে। ওর চোখে পরিতৃপ্তির ছাপ। সম্ভবত: গোসল করেছে, ঠোঁটে হাসি। পরনে হাফ-প্যান্ট হাফ শার্ট- তাও সম্ভবত: আমাদেরই দেয়া। বলল, সে আমাকেই খুঁজছিল। উদ্দেশ্য, আমাদের দেখানো তাকে কেমন দেখাচ্ছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম একটা ধাপে পাশাপাশি দাঁড়ালাম। সেন্টু আর তিতাস ওরা যার যার স্মার্ট ফোনে ছবি তোলে। বুঝতে পারছিলাম, ফটো তোলার জন্যে তৌহিদও আকুপাকু করছে। কিন্তু কমলাপুর রেলস্টেশনে ঠিক ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে ওর হাত থেকে এক ছিনতাইকারী মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে দিলো দৌড়। তখন আর কিছু করার ছিল না। যাহোক, ফটো তোলা হলো। এক সময় কাশেমের কচি হাতটা ছেড়ে দিয়ে আরও উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। কাশিমও পিছু পিছু কয়েক ধাপ উপরে ওঠে। অতঃপর শত মানুষের ভিড়ের মধ্যে তাকে আর দেখা গেল না। একটা আনন্দে ভিতরে ভিতরে আমার শরীর রোমাঞ্চিত হলো। সমস্ত মন প্রাণ আপ্লুত হলো। ভাবলাম হয়ত একটি শিশুর মুখে ক্ষণিকের জন্য হাসি ফুটাতে পেরেছি। বহু কষ্ট করে এখানে আসা, তাহলে সামান্য হলেও বুঝি সার্থক হলো। কাশেমের মত ছোট বড় হাজার হাজার শিশু আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে রক্ষা করতে হবে। সদ্য বিধবা তরুণী নারীদের অশ্রু মোচনের চেষ্টা করতে হবে। মুসলমান হিসাবে আরেক মজলুম মুসলমানের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানের দাবি। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরানে এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কি হয়ছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য সংগ্রাম করবে না? যারা বলছে, হে আমাদের রব! এ অত্যাচারী শাসকের দেশ হতে আমাদের অন্যত্র নিয়ে যাও এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার নিকট হতে কাউকে আমাদের সহায় করো।’ (সুরা নিসা: ৭৫)
মুসলিম জাহান আজকে কোথায়? কোথায় মহাপ্রতাশালী, বিপুল ধন সম্পদের অধিকারী প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজা-বাদশা সুলতানগণ? এইসব কাশিমদের রক্ষার ভার তাদেরই নিতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র একাকী অপারগ- তাই উম্মাহর সকলের এগিয়ে আসা চাই। এইসব কাশিমই হয়ত: নয়া বিন কাশিম হয়ে একদিন উম্মাহর খিদমতে জান কুরবান করতে খাড়া হবে। কিন্তু আজকে এই কাশিমের জীবনের নিশ্চয়তা কোথায়? কে দেবে খাদ্য, ঔষধ, কীভাবে পাবে শিক্ষার সুযোগ, কে দেখাবে বেড়ে ওঠার পথ- মসৃণ সিঁড়ি আর নিরাপত্তা? রোহিঙ্গারা মুহাজির। মদিনার আনসাররা মক্কার মুহাজিরদের কীভাবে সাহায্য করেছিলেন, ভাই বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন তা থেকে মুসলমান হিসেবে, রসূলের (স.) উম্মত হিসেবে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। এই রোহিঙ্গা মুসলমানেরাও তো আমাদের ঈমানী ভাই। এসব ভাবছি আর এলোমেলো পায়ে কাদা-পানি মাড়িয়ে হাঁটছি শত মানুষের মিছিলের সাথে। এসব মানুষের প্রত্যেকের রয়েছে একটা করে গল্প, আছে বেদনাবিধূর কাহিনী, বুকে প্রিয়জন হারানো ব্যাথায় ভরা দগদগে স্মৃতি, চৌদ্দ পুরুষের প্রিয় বাস্তুভিটা ছাড়ার অসীম কষ্টকর অভিজ্ঞতা। এগুলো ঘটনা জড়ো করলে বহু খন্ড মহাকাব্য- নয়া শাহনামা, রচিত হতে পারে, লেখা যাবে নতুন রোহিঙ্গানামাহ।
এই ক্যাম্পে এসে দু’টো বিষয় আমাকে যুগপৎ বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে। এর একটা হচ্ছে- প্রায় শতকরা ১০০% ভাগ নারী হিজাবধারী, নেকাব আঁটা। দেখলাম কাঠফাটা রোদের মধ্যে নানা বয়সী শত শত নারী লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ত্রাণের অপেক্ষায়। তাদের কারো কোলে কচিবাচ্চা, আরেকজনের কোলে এক বাচ্চা আর দু’জন মায়ের জামা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শিশু খাদ্য নিয়ে ইউনিসেফের গাড়ি আসবে সেই আশায় এই মায়েদের দাঁড়িয়ে থাকা। একজন মহিলাকে দেখলাম কয়েক মাস বয়সী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে লাইনের ফাঁকে বসে পড়েছেন, দু’পাশে দুটি ৩-৬ বয়সী সন্তান। মহিলার পরনে কালো বোরকা মুখ আধখোলা, কাছে গেলে প্রথমে মুখটা ফিরিয়ে নেন। পরে অনুরোধ করলে কয়েক বাক্য কথা বলেন। তার বয়স ত্রিশের মত হবে। তার সন্তান তিনটি, স্বামীর নিজস্ব ট্যাক্সি ছিল। কামাই রোজগার বেশ ভালো হতো। কিন্তু একদিন সকালে মিলিটারি গ্রাম ঘিরে ফেলে। তার স্বামীকে নাস্তার টেবিল থেকে টেনে হিঁচড়ে উঠানে নিয়ে তারা গুলি করে। বাচ্চা তিনটাকে নিয়ে বারান্দার এক কোণায় লুকায় মা। স্বামীর গায়ে গুলি লাগলেও বেঁেচ ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে এক বৌদ্ধ সন্ত্রাসী এসে দায়ের এক কোপ দিয়ে ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলে। এসব দেখে ক্রন্দনরত সন্তানদের হাত ধরে পালাতে থাকেন। অনেক পথ পায়ে হেঁটে দু’দিন আগে পৌঁছায় ঘাটে। বলেন, এদেশের মানুষ ভালো। আমার বাচ্চাদের কোলে নিয়ে পানি পার করে বেড়িবাঁধে উঠিয়ে দিয়েছে। কোথায় হারিয়ে গেল তার স্বামী, সুখের ঘর- সংসার। আর কথা বলতে পারছিল না। তার দু’চোখে বেয়ে অশ্রুধারা নামে।
চলতে চলতে চোখে পড়লো অদূরে দাঁড়ানো এক মহিলার দিকে। মহিলা ২/৩ জন ছেলে মেয়েকে নিয়ে এক চিলতে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। স্পষ্টত: এরা একই পরিবারের। আপাদমস্তক বোরকা ঢাকা, নেকাব আঁটা। সাথের কিশোরী কন্যাও বোরকাবৃত। দামি সৌখিন বোরকা। অন্য বাচ্চাদের পোশাকও চমৎকার, চেহারায় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ, তবে ক্লান্ত। ওদের সকলের লেবাস-লেহাজ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এরা সাধারণ কেউ নয়- ধনাঢ্য/সম্ভ্রান্ত লোক। হয়ত বাড়ি গাড়ি ফ্রিজ টিভি, জমিজমা ব্যবসাপাতি সবই ছিল। কয়েকদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম মংডু ও আকিয়াব বন্দরে বিশিষ্ট মুসলমান ব্যবসায়ীদের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীরা খুঁজে খুঁজে নির্বিচারে হত্যা করেছে। হয়তো এরা তাদেরই কোনো একজনের পরিবার পরিজন। নরপশুদের হামলায় সবকিছু ফেলে ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে অনিশ্চিত পথে যাত্রা করেছেন। এদের অবস্থা মনে হয় আরও বেশি খারাপ। কেননা এরা কারও কাছে হাত পাততেও পারছেন না, রিলিফের আশায় লাইনে দাঁড়াতেও সংকোচ। শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে (?) আজ সর্বস্ব হারিয়ে এই লাখ লাখ মানুষ পথের মানুষে পরিণত হয়েছেন- এদের একটাই পরিচয় রোহিঙ্গা রিফিউজি। কিন্তু ইসলামী আদব কায়দাকে তাই বলে তারা পরিত্যাগ করেননি। এদের দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়, আবার সমবেদনায় প্রাণটা ভেতরে ভেতরে কেঁদে উঠে। এতো দুঃখ কষ্ট, এতো বেদনার মধ্যেও ইসলামী রীতিনীতি ঐতিহ্যকে ওরা ভুলে যাননি, ইসলামের বিধি-বিধান পরিহার করেন নাই। কমেনি ধর্মানুরাগ, ভুলে যায়নি যে, আমি একজন মুসলমান। এদের ঐতিহ্য চেতনা ও ধর্মপরায়ণতা থেকে আমাদের অনেকটা শেখার আছে বৈকি।
আর যে দ্বিতীয় বিষয়টি আমাকে হতাশ করেছে তা হচ্ছে যুবক ও তরুণদের লক্ষ্যণীয় অনুপস্থিতি। হাজারও নারী আছেন, বৃদ্ধরাও আছেন, শিশুরাও আছেন, কিন্তু দেখা মিলছে না যুবাবয়সীদের। এমনকি তরুণী (অনুঢ়া) মেয়েদের সংখ্যাও অনেক কম মনে হয়। একটা ডাটাবেস যদি জলদি তৈরি করা হয় তবে প্রকৃত চিত্রটি ধরা পড়বে, এটা খুবই জরুরি। প্রায় প্রত্যেক মহিলার সাথে ২/৩ এমনকি চারটি নাবালক সন্তান রয়েছে, কিন্তু পিতা বা পুরুষ অভিভাবকেরা অনুপস্থিত। আমি বিষয়টি বুঝবার জন্য রোহিঙ্গাদের কয়েকজনের সাথে কথাবার্তা বলেছি। তাতে দু’টো মত পাওয়া যায়- কেউ বলেন মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা পরিকল্পিতভাবে যুবকদের তথা সক্ষম পুরুষদের বেছে বেছে হত্যা করছে। এমনকি তরুণীদেরও ধর্ষণের পরে হত্যা করছে (যারা সম্ভাব্য মা হতে পারে), পুড়িয়ে মেরেছে। যারা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে সক্ষম তাদেরই বর্মীরা টার্গেট করে মারছে। নবীন যুবক ও আলেমদের ডেকে নিয়ে নিয়ে হত্যা করছে। আর এই গণহত্যার প্রমাণ যাতে না থাকে সেজন্য লাশ বুলডোজার দিয়ে মাটি চাপা দিয়ে দেয়। সোভিয়েত রাশিয়াও আফগানিস্তানে বিগত আশির দশকে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায়। তারাও আফগানদের লাশ মাটি চাপা দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে গ্রামের জীবিত নারী শিশুদের বন্দুকের ব্যারেলের মাথায় জড়ো করে বলতো, আসছে মৌসুুমে এখানে আলুর চাষ ক’রো, ফলন ভালো হবে। মায়ানমারেও একই রকম ঘটনা ঘটাচ্ছে। অবশ্য আগ্রাসী রুশবাহিনী ৯ বছরের মাথায় শত শত সৈন্যের লাশ পিছনে ফেলে হাজার হাজার আহত সৈনিককে নিয়ে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে চলে গিয়েছিল। রোহিঙ্গা যুবকরা কোথায় এ সম্পর্কে অন্য মতটিই হচ্ছে: যারা জানে বেঁচে গেছে তারা পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রথমোক্ত মতটিও বেশি জোরালো- যুবকদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাই অক্ষম বৃদ্ধ ও নারী শিশু ছাড়া সামর্থ্যবান পুরুষরা প্রায় নিখোঁজ। মনে হচ্ছে বর্মীরা অত্যাচারী ফেরাউনকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফেরাউন বনী ইসরাইলের পুরুষ শিশুদের খুঁজে খুঁজে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। ঐ জালিমের করুণ পরিণতি আমাদের জানা আছে। জানি না কি পরিণতি আল্লাহ বর্মিদের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছেন।
(সমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।