Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফেঁসে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ প্রস্তুত করছে দুদক

হাওরে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম

প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম | আপডেট : ৮:১৮ পিএম, ২১ অক্টোবর, ২০১৭


মালেক মল্লিক : সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষাবাঁধ নির্মাণে দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়মের ঘটনায় ফেঁসে যাচ্ছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ১৩ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের বিষয়ে সুনিদিষ্টভাবে অভিযোগ প্রস্তুুত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগুলো চূড়ান্ত হলেও মন্ত্রনালয়ে পাঠাবে কমিশন। এরপরই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়। পয়েন্টাকারে তথ্য-প্রমাণ চাওয়ার পর অভিযোগগুলো তৈরি করতে শুরু করে দুদক। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পয়েন্ট ভিত্তিতে অভিযোগগুলো তথ্য-প্রমাণসহ জানতে চেয়েছেন। তদন্ত টিম অভিযোগনামা তৈরি করছে। যা দ্রæত সময়ের মধ্যে মন্ত্রনালয়ে পাঠাবে দুদক। এরপর জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে পারে মন্ত্রনালয়।
চলতি বছরের ২ জুলাই হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে ৬১ জনকে আসামি করে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। একই সঙ্গে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল দুদকের অনুসন্ধান টিম। ইতোমধ্যে প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারও কয়েছে দুদক। অন্যান্যদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়ার অব্যাহত রেখেছে দুদক।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি যদি যথাসময়ে কমিশনে পাঠানো হতো, তা হলে হয়তো হাওরের বিপর্যয় ঠেকানোর চেষ্টা আরো দৃঢ় হতো। গত ২৪ মে দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন নিয়ে প্রেসিডেন্ট এর সঙ্গে দেখা করতে গেলে দুদক চেয়াম্যানকেও হাওর অঞ্চলের দুর্নীতির বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশও দেন বলে জানা যায়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জে হাওর রক্ষাবাঁধে ফাটল ও কোথাও বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়ে যাওয়ার পেছনে পাউবোর স্থানীয় কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল একটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই মতো দুদকের একজন মহাপরিচালক অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষাবাঁধে ভাঙনের বিষয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি প্রতিবেদন চান। কাদের দুর্নীতির কারণে হাওরের বাঁধ ভেঙে কৃষকের সর্বনাশ হচ্ছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়ার পর মন্ত্রণালয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কমিটি করার জন্য বলে। পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত বছর এপ্রিলেই দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে। প্রতিবেদনটি চলতি বছরের ফেব্রæয়ারির শেষ সপ্তাহে দুদকে আসে। কিন্তু তাতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে কৃষকের ফসলহানির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়, বন্যা, আগাম বৃষ্টি ও ইঁদুরে বাঁধ কেটে দেয়ার কারণে হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রধান কার্যালয় থেকে গঠিত ওই তদন্ত কমিটি দুর্নীতির কথা গোপন করায় প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগ আনে দুদক। হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলি জমি তলিয়ে যাওয়া নিয়ে দেশজুড়ে হইচইয়ের পর দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুর্নীতির ঘটনা স্বীকারও করে নেন।
জানা গেছে, ২০১২-১৩ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হাওরের ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। ৩৬টি হাওর রক্ষায় ৪৫ থেকে ৮০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যম সোচ্চার হলে দুদকের পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের টিম হাওর এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে। তারা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আসে। ৭৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশসহ কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করে। পরবর্তীতে ৬১ জনের নাম দুদক মামলা করেন। এছাড়াও মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশে করা হয়।
১৩ কর্মকর্তা হলেন-পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ আলী খান, যুগ্মসচিব (উন্নয়ন-১, হাওর) নুজহাত ইয়াসমিন, যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা অনু বিভাগ) মন্টু কুমার বিশ্বাস, পাউবোর মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর কবির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওন) একেএম মমতাজ উদ্দিন। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কমিটির সাতজন হলেন যুগ্ম সচিব কাজী ওবায়দুর রহমান, শামিম আরা খাতুন, মো. খলিলুর রহমান, উপ সচিব নন্দিতা সরকার, মুহম্মদ হিরুজ্জামান, সহকারী প্রধান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ রাসেল ও মো. সিদ্দিকুর রহমান। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে দুদকে সুপারিশ আমলে নিয়ে মন্ত্রণালয় ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা অভিযোগনামা চায় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওই চাহিদার বিপরীতে তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগনামা তৈরি করা হচ্ছে। যা শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন নিশ্চিত করেছে।
সুপারিশে বলা হয়েছিল, ১৩ কর্মকর্তা সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজ যথা সময়ে শুরু ও শেষ করার ক্ষেত্রে তত্ত¡াবধান, পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্ব পালনে সীমাহীন অবহেলার কারণে বন্যার পানি ঢুকে এবার হাওরে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। নিয়ম অনুযায়ী পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টি শুরুর আগেই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার কথা ছিল। বাস্তবে তা করা হয়নি। এতে হাওরের ফসল, মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী সিনিয়র সচিব মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান, অধস্তন কার্যালয়গুলোর প্রধান হিসাবদানকারী কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তরের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথা সময়ে সুষ্ঠুভাবে ব্যয় হয় তা নিশ্চিত করবেন। এ ক্ষেত্রে পাউবোর ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে ৫৬ দিন পর। একই সঙ্গে পাউবোর আওতাধীন প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট কমিটি নিবিড়ভাবে তদারক করেনি। সময়মতো বাঁধ নির্মাণ না করার কারণেই দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলে মন্ত্রণালয় তাদের অভিযোগনামা চেয়েছেন। আমাদের তদন্ত টিম মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুসারে অভিযোগনামা তৈরি করছে। যা এখনো তৈরি হয়নি। বর্তমানে তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুদক

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
৪ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ