Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আ’লীগ নেতা মুজিবুল হক জনপ্রিয় জোটের মনোনয়ন চায় জামায়াত

কুমিল্লা-১১ : চৌদ্দগ্রামে বইছে নির্বাচনী হাওয়া

| প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাদিক মামুন, কুমিল্লা থেকে : কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিভেদ থাকলেও এখানকার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে নেই গ্রæপিং, দলাদলি, মান-অভিমান। দলের স্বার্থে সবাই উদার নীতিতে অটল। অনেক চড়াই-উৎরাই, ঘাত-প্রতিঘাতের পিচ্চিল পথ পেরিয়ে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে জামায়াত-শিবিরের দূর্গ ভেঙ্গে দিয়ে আজকের সময়ে আওয়ামীলীগের ঘাঁটি চৌদ্দগ্রাম। আওয়ামীলীগের এ শক্ত অবস্থান তৈরির হিরো হলেন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিব। দলের ও সাধারণ মানুষের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। আসন্ন একাদশ নির্বাচনে চৌদ্দগ্রাম থেকে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে মুজিবুল হকই লড়বেন এমন আভাস মিলছে মাঠ পর্যায়ের জরিপে।
অন্যদিকে বিএনপি প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছরেও চৌদ্দগ্রামে দলটির শক্ত অবস্থান তৈরি হয়নি। দূর্বল নেতৃত্বের কারণে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে দেখা দেয় প্রার্থী সংকট। ফলে জোট করেই জামায়াতের প্রার্থী দিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে বিএনপিকে। আসন্ন একাদশ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মানোনয়ন নিতে জোর দিয়েই মাঠে নেমেছেন চৌদ্দগ্রাম উপজেলা আহŸায়ক কামরুল হুদা। কিন্তু কামরুল হুদার জন্য বড় অন্তরায় সাবেক এমপি জামায়াত নেতা ডা. আবদুল্লাহ মো: তাহের। বিএনপি জোটে থাকা এ দলটি চৌদ্দগ্রাম আসনে সৈয়দ তাহেরের মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চায় ধানের শীষের প্রতীকে। এ কৌশলের পথ ধরে চৌদ্দগ্রাম বিএনপিকে বগলদাবা করার চেষ্টা চলছে জামায়াতের ভেতরে। তবে চৌদ্দগ্রামে জামায়াত ঘরানার কেউ মনোনয়ন পেলে বিএনপি পুরোদমে বেঁকে বসবে এমন হুশিয়ারি রয়েছে দলের নেতাকর্মীদের।
ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের বিস্তৃীর্ণ এলাকার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-১১ সংসদীয় আসন। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে চৌদ্দগ্রামে আওয়ামীলীগের কাজী জহিরুল কাইয়ুম বাচ্চু ও জয়নাল আবেদীন ভূইয়া এমপি নির্বাচিত হন। তারপর এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৬ এবং ৮৮ সালে জাতীয় পার্টির এমপি নির্বাচিত হন কাজী জাফর আহমেদ। ওই সময় তিনি শিক্ষামন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয়পার্টির দু:সময়েও চৌদ্দগ্রাম আসনে কাজী জাফর আহমেদ এমপি নির্বাচিত হন। ৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী মুজিবুল হক মুজিবের কাছে হেরে যান জামায়াত প্রার্থী আবদুল্লাহ মো: তাহের ও জাতীয়পার্টির কাজী জাফর আহমেদ। ওই সময় আওয়ামীলীগ সরকার করলে মুজিবুল হক মুজিব জাতীয় সংসদের হুইপ মনোনিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট প্রার্থী জামাতের আবদুল্লাহ মো: তাহেরের কাছে পরাজিত হন মুজিবুল হক। ওই নির্বাচনে জাপা নেতা কাজী জাফর অংশ নেননি। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে চৌদ্দগ্রাম আসন থেকে নির্বাচিত এমপি মুজিবুল হক দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদের হুইপ মনোনিত হন এবং পরে রেলপথ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও মুজিবুল হক এমপি নির্বাচিত হোন এবং আবার রেলপথ মন্ত্রী হোন।
নব্বইয়ের পট পবিরবর্তনের পরই চৌদ্দগ্রামে জেঁকে বসে জামায়াত শিবির। এরপর থেকেই গোটা কুমিল্লায় জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকা হয়ে ওঠে চৌদ্দগ্রাম। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের দাপুটে ভূমিকার কাছে চৌদ্দগ্রামের আওয়ামীলীগ-বিএনপি ছিল অনেকটাই অসহায়। ৯৬ সালে জামায়াতকে স্তব্ধ করে দেয় আওয়ামীলীগ। চৌদ্দগ্রামের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করেন আওয়ামী লীগ নেতা কৃষকপুত্র মুজিবুল হক মুজিব। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে চৌদ্দগ্রামের রাজনীতিতে চারদলীয় জোটের হয়ে জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ তাহের এমপি নির্বাচিত হলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থকদের ওপর নেমে আসে জামায়াতি নির্যাতনের খড়গ। ২০০৭ সালে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে চৌদ্দগ্রামবাসী। ২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে চৌদ্দগ্রামে পতন ঘটে জামায়াত রাজত্বের। মুজিবুল হকের হাত ধরে চৌদ্দগ্রামে বইতে শুরু করে রাজনীতির সুবাতাস। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক রেলপথ মন্ত্রী মুজিবুল হক চৌদ্দগ্রাম আওয়ামীলীগকে সাজিয়েছেন শক্ত সাংগঠনিক কাঠামোতে। চৌদ্দগ্রাম আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা জানান, মুজিবুল হক এখন গোটা চৌদ্দগ্রামের প্রাণ। তিনি অপ্রতিদ্ব›িদ্ব রাজনীতিবিদ। আগামী নির্বাচন চৌদ্দগ্রামে মুজিবুল হকই আওয়ামীলীগের প্রার্থী হবেন এবং তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন।
এদিকে চৌদ্দগ্রাম আসনে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মাত্র তিনমাসের জন্য এমপি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল সামসুদ্দিন আহমেদ নামে এক নেতার। এরপর থেকে জাতীয় নির্বাচনগুলোতে চৌদ্দগ্রামে বিএনপি কোন প্রার্থীই দিতে পারেনি। বিশেষ করে ২০০১ সালে জামায়াতকে নিয়ে চারদলীয় জোট গড়ে তুললে চৌদ্দগ্রামে কোনঠাসা হয়ে পড়ে বিএনপি। ওই সময়ে জামায়াতের সৈয়দ তাহের চারদলীয় জোটের এমপি হওয়ার পরও চৌদ্দগ্রামে বিএনপি ছিল উপেক্ষিত। খালেদা জিয়ার সরকার, এরপরও চৌদ্দগ্রামে জামায়াতের কারণে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি। আবার জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় চৌদ্দগ্রাম বিএনপি সাংগঠনিকভাবে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এমনিভাবে গত ১৭ বছর চৌদ্দগ্রামে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত-শিবির। চৌদ্দগ্রামে জামায়াতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক আগ থেকেই ভালো নেই। আবার বর্তমানে জামায়াতের দু:সময় কাটছে চৌদ্দগ্রামে। সময়ের ব্যবধানে চৌদ্দগ্রামে মাঠ পর্যায়ের দৃশ্যমান রাজনীতিতে বর্তমানে বিএনপির চেয়েও খারাপ অবস্থানে রয়েছে জামায়াত-শিবির। চৌদ্দগ্রামে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী সমর্থক রয়েছে। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব না থাকায় দলটি সামনে এগুতে পারেনি। আসন্ন একাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে চৌদ্দগ্রামে বিএনপিকে শক্ত অবস্থানে আনার জন্যে মাঠ পর্যায়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন দলটির উপজেলা আহŸায়ক কামরুল হুদা। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাহস যোগাচ্ছেন, প্রেরণা দিচ্ছেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার। বর্তমানে তার নেতৃত্বে চৌদ্দগ্রাম বিএনপি আগের চেয়ে অনেকটা গতিশীল। আগামী নির্বাচনে বিএনপি থেকে কামরুল হুদা মনোনয়ন চাইবেন। দলের নেতাকর্মীরাও চাইছে কামরুল হুদাকে যেনো মনোনয়ন দেয়া হয়। চৌদ্দগ্রাম বিএনপির অনেকেই জানান, জামায়াতের ওপর ভর করলে চৌদ্দগ্রামে বিএনপির মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। আগামী নির্বাচনে চৌদ্দগ্রামে বিএনপি থেকেই প্রার্থী দেয়ার জন্য দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা দাবী তুলেছেন।
অপরদিকে জামায়াতের নিবন্ধন না থাকায় আগামীতে দলটির নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতি হলে জামায়াতের কেন্দ্রিয় নেতা সাবেক এমপি আবদুল্লাহ তাহের ধানের শীষ নিয়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখছেন। আবার জোটগত নির্বাচনের সুযোগ থাকলে সেখানেও আবদুল্লাহ তাহের বিএনপিকে বগলদাবা করার চেষ্টা চালাবেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা জামায়াতের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, জামায়াত বিএনপি জোটের শরীক দল। তাই আগামীতে কুমিল্লায় একটি মাত্র আসনে জামায়াত প্রার্থী চাইবে। আর এটি হচ্ছে কুমিল্লা-১১ চৌদ্দগ্রাম। এখানে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারনে জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুটা শিথিল হলেও আগের চেয়ে অনেক ভোট বেড়েছে। এদিকে বিএনপি জোটে রয়েছে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) অংশ। দুই বছর আগে কাজী জাফর মারা যান। দলের নেতাকর্মীরা মরহুম কাজী জাফরের আদর্শকে ধারণ করে এখনো চৌদ্দগ্রামে পার্টির অবস্থান সুসংহত রেখেছেন। কাজী জাফরের কন্যা জয়া আহমেদ তার পিতার হাতে গড়া দলের হাল ধরেছেন। আগামী নির্বাচনে তিনিও চৌদ্দগ্রাম আসনে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চাইবেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ