হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহাকে জড়িয়ে যে ধূ¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছিল তা আরো ঘনিভ‚ত হয় তার এক মাসের ছুটি গ্রহণের মধ্যে দিয়ে। তারপর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায় ঘোষণার পর সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বা আওয়ামী ঘরনার লোকেরা প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যেসব কথা প্রকাশ্যে বলেছেন তারপর ‘আদালত অবমাননার’ আইন কার্যকর থাকার কোন যুক্তি থাকে না।
প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা আওয়ামী ঘরনার বলে মানুষের ধারণা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত অনুগত বলে তিনি বার বার তার বক্তব্যে নিষ্কটকভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। তারপরও বিচারপতি সিনহাকে এভাবে অপমান-অপদস্থ করার অর্থ কী? অং সাং সূচি নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছেন। আর আমাদের সরকার কূটকৌশল করে বিচারপতি সিনহাকে ভিন্নপন্থায় সরিয়ে দিয়ে শুধু বিচার বিভাগ নয়, বরং নিজের উপর কালিমা লেপন করে নিজেকেই প্রশ্ন বিদ্ধ করছে।
ইন্টারনেট, লোকমুখে প্রচার-প্রপাগান্ডা, আইনজীবীদের বক্তব্য সব মিলিয়ে এটাই ধারণা হয় যে, বিচারপতি সিনহা ছুটি নেননি, বরং তাকে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে দেশের প্রধান বিচারপতির যদি এ অবস্থা হয় তবে বাকী ১৬ কোটি মানুষের স্বাধীনভাবে কাজ করার নিরাপত্তা কোথায়? বিষয়টি নিরপেক্ষ ও নিখুঁত তদন্তের দাবি রাখে।
সেপ্টেম্বর প্রথম সপ্তাহে টক শোতে অংশ নেয়ার জন্য একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যাই। সেখানে প্রথিতযশা এক দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও আওয়ামী ঘরনার সাংবাদিক নেতার মুখেই শুনলাম যে, ‘শেষ পর্যন্ত সরকার সব কিছুর উপরই নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলো, বিচার বিভাগ বাকী ছিল এটার উপরও সরকার এখন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছে।’ এ মর্মে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘প্রধান বিচারপতি ১০ দিনের ছুটিতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন, বিচারপতি সিনহা অবসরে যাওয়ার পূর্বে এ ছুটি ঘড়হ-ঝঃড়ঢ় বর্ধিত হতেই থাকবে।’ এ বিষয়টি ইঙ্গিত করে ইতোপূর্বে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ খবর হলো, প্রধান বিচারপতি দেশের বাইরে গেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে এতো মরিয়া হয়ে উঠলো কেন? এটি গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার বিষয়।
আর কেউ জানুক বা না জানুক, সরকার জানে যে, তারা অনির্বাচিত। বিগত কয়েকটি সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট ইতোপূর্বে অবৈধ বলেছে। ১৫৩ জন বিনা ভোট ও প্রতিদ্ব›দ্বী-প্রার্থীবিহীন নির্বাচিত হওয়ায় যে তামাশা দেখিয়েছেন তাদেরকেও ‘অনির্বাচিত’ বা অবৈধ ঘোষণা হওয়ার একটা আতঙ্ক সব সময়ই সরকারের মধ্যে বিরাজমান। যাই বলুক সত্য এই যে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে এ সরকার নির্বাচিত হয়নি। বরং ৫ জানুয়ারি ২০১৪ নির্বাচন যে একটি হককারী তামাশার নির্বাচন, এটা সকলেই উপলব্ধি করেন। মানুষ মনে করে যে, প্রধান বিচারপতির এ ছুটি স্বেচ্ছায় নয়, বরং ১৫৩ জন অনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের পদ বাঁচাতেই এ নাটকীয়তা, যা সাংবিধানিক অবস্থানকে আরো জটিল করে তুলবে।
প্রধান বিচারপতির ছুটি নিয়ে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে আরো জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা জনগণ বিশ্বাস করতে পারেনি। আইনমন্ত্রী বলেছেন, বিচারপতি সিনহার ক্যান্সার হয়েছে যা দেশবাসী ইতোপূর্বে কোনদিন শোনেনি। রোগ কাউকে বলে-কয়ে আসে না, এটা সত্য হলেও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের ‘সত্যতার’ মধ্যেও ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এখন জনগণের সামনে ক্যান্সারের দালিলিক প্রমাণ আইনমন্ত্রীকেই করতে হবে। কারণ তিনি সত্য বা সঠিক তথ্য প্রদানের জন্য শপথে আবদ্ধ। এ ক্যান্সার কি বিচারপতির দেহে না আইনমন্ত্রীর মনে তা খতিয়ে দেখতে হবে। অবশেষে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে লিখিত এক বিবৃতিতে বলেছেন, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। ক্যান্সার প্রসঙ্গে কোনো কথাই তিনি বলেননি। ভিন্নপথে প্রধান বিচারপতিকে নির্বাসনে দেয়ার জন্য সরকার যে প্রক্রিয়া অবলম্বন করলো তা গোটা বিশ্বে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিসহ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের উপরে সরকারের যে খোলাখুলি নিয়ন্ত্রণ তাও পরিষ্কার হয়ে গেলো।
স্বৈরশাসকদের প্রধান টার্গেট থাকে বিচার বিভাগ। সে কারণে এ বিভাগের টুঁটি চেপে ধরা স্বৈরাচারের সহজাত প্রবৃত্তি। অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলে ১/১১ নামক সেনাসমর্থিত স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় বসেই বিচার বিভাগের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। জাতীয় সংসদে ক্যাঙ্গারু কোর্ট স্থাপনের মাধ্যমে কোর্টকে (ক্যাঙ্গারু কোর্ট) ব্যবহার করেছিল এবং ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলি আদিষ্ট হয়ে নির্ধারিত ব্যক্তিদের সাজা প্রদান করেছিল। ক্যাঙ্গারু কোর্টগুলির নির্বিচারের প্রতি উচ্চ আদালতে তখন কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। দু’-একজন বিচারপতি ছাড়া সকলেই কাক্সিক্ষত রায় প্রদানে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কারণ, বিচারপতিদের বঙ্গভবনে চায়ের দাওয়াত দেয়া হয়েছিল স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য। কিন্তু তখন বিচারপতিরা পদত্যাগ না করার জন্যই ‘ইয়েস উদ্দিন’ নামে পরিচিত প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দিনের দাওয়াত গ্রহণ করেননি।
বিচারপতি সিনহা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন যে, সংসদের ৩০০ এমপিও যদি সংবিধান সংশোধন করে এবং তা যদি সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী হয় তবুও তা বাতিল করে দেবো। তিনি আরো বলেছিলেন যে, জীবন দিয়ে হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করবো, কোন প্রকার আপোস করব না (উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ‘লগোর’ পরিবর্তে ‘মূর্তি’ বসানোর মতো বিতর্কিত কিছু কাজ ছাড়া বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষাসহ আমলাতান্ত্রিক প্রভাব থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষা করার জন্য মি. সিনহা দৃশ্যমান ভ‚মিকা রেখেছেন)। কিন্তু ছুটির দরখাস্তে যদি মি. সিনহা স্বাক্ষর দিয়ে থাকেন তবে তিনি নিশ্চয় আপোস করেছেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি ছুটির দরখাস্তে স্বাক্ষর করেছেন তা বিবেচ্য নয়, বরং প্রাণের বিনিময়ে হলেও তিনি বিচার বিভাগের সম্মান রক্ষা করবেন- এ ঘোষণা দেয়ার পরও এ ছুটির দরখাস্ত স্বাক্ষর করে তার সম্মান অক্ষুণœ রাখতে পারেননি। তবে তিনি স্বাক্ষর দিয়েছেন কি না এ সম্পর্কেও জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। জনগণের এ প্রশ্ন দূর করার দায়িত্ব সরকারের। প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করার দায়িত্বও সরকারের। কারণ শপথে আবদ্ধ একজন কেবিনেট মন্ত্রী কোনো কারণেই নিজের খেয়ালের বশিভ‚ত হয়ে এমন কথা বলতে পারেন না যাতে কোনো ‘সত্যতা’ নেই।
কিছু কিছু ঘটনায় মনে হয় যে, বাংলাদেশে কিছু ব্যক্তি রয়েছেন যাদের কোন জবাবদিহিতা নেই। অথচ রাষ্ট্রীয় কলকাঠি নাড়ায় তাদের নিকট অনেক ক্ষমতা রয়েছে। এ ক্ষমতার অপব্যবহার শুধু ‘ক্ষমতা’র জন্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নিকট থাকলেও অনুচ্ছেদ-৪৮(৩) মোতাবেক তিনি ‘ট্রাফিক জ্যামে’ আটকে রয়েছেন। বিচারপতি সাহাবউদ্দিনের ভাষায়, কবর জিয়ারত ও মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত থাকা ছাড়া প্রেসিডেন্টের অন্য কোন কাজ নেই; এমন কি জাতীয় সংসদে তিনি কী ভাষণ দিবেন তাও মন্ত্রিপরিষদ তথা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষ। প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে দেশে বা আন্তর্জতিকভাবে সরকারের ভ‚মিকা নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তার দায়-দায়িত্ব সরকার এড়াতে পারবে না।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ‘অনির্বাচিত সরকার’ একটি রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক সংকটে রয়েছে। এ সংকট নিরসন করার দায়িত্ব সংবিধান কার উপরে ন্যস্ত করেছে? এ বিষয়টি সাংবিধানিকভাবেই নিষ্পত্তি হতে হবে। নতুবা এ সংকট থেকে জাতি মুক্তি পাবে না, বরং ফায়দা লুটবে সুবিধাভোগীরা। কোনো কথা কখনো গোপন থাকে না। যেমন- গোপন থাকেনি বিচারপতি সিনহার ব্যক্তিগত বিষয় (যদিও এ বিষয় উবভবহফ করার সুযোগ তিনি এখনো পাননি)। এ জন্য জাতিকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ক্ষতি যা হয়েছে, তাহলো ব্যক্তির চেয়ে প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
লেখক: কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।