পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
স্টালিন সরকার নাইক্ষ্যাংছড়ি-উখিয়া-টেকনাফ শরণার্থী শিবির থেকে ফিরে : ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাঠের পথ/ আমার মন ভুলায় রে’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। না! টেকনাফের রাস্তার একদিকে সবুজ ধানের ক্ষেত; অন্যদিকে পাহাড় দশনার্থীর মন ভুলায় না। বরং বিরক্তি বাড়ায় বৃষ্টির কদমাক্ত কাদা। চলতে গেলে কাদায় পা আটকে যায়। টেকনাফের হোয়াইক্যাং শরণার্থী শিবিরে যাওয়া সত্যিই কঠিন। কক্সবাজার টু টেকনাফ মূল সড়ক থেকে দুই কিলোমিটার ভিতরে পাহাড়ি পথ। বৃষ্টিতে কদমাক্ত পায়ে হাটা সে পথ কেউ মারাতে চায় না। দেশি-বিদেশী সাংবাদিক, দর্শণার্থী, ত্রাণ দিতে আসা সংগঠন-মানুষ এমনকি প্রশাসনের লোকজনও হোয়াইক্যাং শিবিরে যেতে আগ্রহ দেখায় না। ফলে অন্য সব শরণার্থী শিবিরে বাইরের মানুষের যে আনাগোনা হোয়াইক্যাং শিবিরে সেটা কম। দিনভর বৃষ্টির মধ্যেই সেদিকে পা দিতে হলো। কয়েকদিন সঙ্গী ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক; হোয়াইক্যাং এ একাই যেতে হলো। পথেই চোখে পড়লো বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শরণার্থীদের ত্রাণ দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড় করাচ্ছেন। ত্রাণ নিতে আসা রোহিঙ্গাদের অর্ধেকই খালি গায়ে দাঁড়িয়েছেন। বৃষ্টি পড়ছে তাই কারো কারো হাতে ছাড়া। এক সঙ্গে হাজার হাজার ছাতা এমন দৃশ্য দেখা যায় না। হোয়াইক্যাং শরণার্থী শিবিরে কথা হলো বেশ কয়েকজন শরণার্থীর সঙ্গে। কথা বলে বোঝা গেল রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা এই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয় পেলেও তাদের তাড়া করছে দুঃসহ স্মৃতি। পৈচাসিক-ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখা এবং স্বজন-সহায়সম্বল হারা রোহিঙ্গাদের প্রায় সকলেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কেউ কেউ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছেন। গত কয়েক দিনে নাইক্ষ্যাংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পগুলো ঘুরে প্রায় অভিন্ন চিত্র দেখা গেছে।
সহায়-সম্বল হারিয়ে রাতারাতি শরণার্থীতে পরিণত হওয়ার বিষয়টি পর্যুদস্ত করে দিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। কিন্তু সীমিত পরিসরে শারীরিক চিকিৎসা পেলেও সবকিছু হারানোর যন্ত্রণা-অশান্তি-ভীতি তাড়া করছে তাদের। কেউ কেউ হারিয়ে ফেলেছেন মানসিক ভারসাম্য। আগের দিন কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া অসুস্থ নারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় মৌলুভী মোঃ হাছান নামের পঞ্চাশোর্দ্ধ এক রোহিঙ্গা উপযাচক হয়ে নিজের পরিচয় দেন। তিনি রাখাইনের আকিয়াব জেলার একটি মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। মাদ্রাসাটি পুরিয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রামে প্রভাবশালী ছিলেন। তার জমি-জমা টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। গ্রামের বাড়িঘরে আগুন দেয়ার পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তিনি যখন পালিয়ে আসেন; তখনো তার সঙ্গে ছিল ৩০ ভরি সোনা। মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াট ছিল প্রায় দশ লাখ। কিন্তু পাহাড়ি পথে আসার সময় তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেয় মগ দস্যুরা। স্ত্রীর কাছে যা ছিল তা দিয়েই নাফ নদী পাড় হন। কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে যখন আশ্রয় পান তখন তার পকেট একেবারে শুন্য। অথচ এক সাপ্তাহ আগেও তিনি প্রচুর ধন সম্পদের মালিক ছিলেন। তার কষ্টের কথা শুনে মনে পড়ে গেল নবাব সিরাজ উদ দ্দৌলা সিনেমার মাঝির কণ্ঠে আবদুল আলিমের গান ‘এই তো নদীর খেলা/ রে ভাই এক তো নদীর খেলা/ সকাল বেলায় আমীর রে ভাই/ ফকির সন্ধ্যে বেলা’। দুঃখ করে মৌলুভী মোঃ হাছান বললেন, ‘স্যার জীবনে কারো কাছে হাত পাতিনি। মানুষ-জন আমাদের বাড়িতে সারাজীবন খেয়েছে। এখন এক মুঠো ভাতের জন্য স্ত্রী-সন্তানদের মুখের দিতে তাকিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে হয়। এটা কি মানা যায় স্যার! আমরা মুসলমান তাই আমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিম হওয়া কি অপরাধ!’ শুধু মৌলুভী হাছান নয়; শত শত রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবার রয়েছে যারা রাখাইনে আর্থিকভাবে অবস্থা সম্পন্ন সম্পদশালী ছিলেন। ভাগ্যের নির্মম বাস্তবতায় তারা সবকিছু হারিয়ে পথের ফকির হয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। শিবিরে অনেক পরিবার রয়েছে যারা আত্মসম্মনবোধের কারণেই লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে লজ্জা পান। উখিয়ার পালংখালি বাজারে চায়ের দোকানে জসিম উদ্দিন চৌধুরী নামের একজন জানান, পালংখালি ইউনিয়নের বালুখালি, জুমের পাড়া, তাজনিমার কোলা, হাকিম পাড়া, থাইনখালি শরণার্থী শিবিরে যারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই রাখাইনে সম্পদশালী ছিলেন। তারা শরণার্থী হওয়ার পরও জমি ভাড়া নিয়ে পলিথিনের খুপড়িঘর তোলেন। এসব শরণার্থী শিবিরের অর্ধেকই ত্রাণ নিতে লাইনে দাঁড়াতে লাজ্জাবোধ করছেন। অথচ লাইনে দাঁড়াতে হয়। মোহাম্মদ সেলিম নামের এক শরণার্থী জানিয়েছেন, আকিবার জেলা থেকে যে অবস্থা সম্পন্ন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের অনেকের অসুস্থ। চোখের সামনে মা-বোনদের ধর্ষণ করে খ্যান্ত হয়নি; সুচির সেনাবাহিনী; অনেক রোহিঙ্গাকে শারীরিক ভাবে জখম করেছে। উখিয়ার পালংখালি ইউনিয়নের আমবাগান শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, আমাদের বাড়ি ছিল রাখাইনের কচিদং গ্রামে। ঈদের আগের দিন হঠাৎ বর্মী সেনারা আমাদের গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি ও জবাই করে চোখের সামনে ১০ প্রতিবেশীকে হত্যা করে। চোখের সামনে এ দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। এক আত্মীয়ের পরামর্শে জীবন বাঁচাতে বাচ্চাদের নিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিই। এরপর গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে রওয়ানা দিই। দিনে জঙ্গলে পালিয়ে থেকে রাতে হাটতে শুরু করি। পথে কত যে মানুষের মৃত্যু দেহ পড়ে থাকতে দেখেছি তার ইয়াত্তা নেই। কারো গলাকাটা, কারো শরীর ক্ষতবিক্ষত, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন রাস্তার পাশে পড়ে রয়েছে। দুর্গন্ধযুক্ত লাশগুলোর ওপর মাছি ভন ভন করছে। আমি নিজেই অন্তত ৫০ নারী-পুরুষ-শিশুর লাশ দেখেছি। পথে কিয়াম্মাই এবং কুমিরখালীতে ক্ষত-বিক্ষত লাশ পুতে রাখতে দেখেছি। এভাবে প্রায় এক সাপ্তাহ হাটার পর আমরা হোয়াইক্যাং সীমান্ত পাড় হয়ে বাংলাদেশে ঢুকি। বিভৎস ওইসব দৃশ্য দেখার পর থেকে স্ত্রী দিল আফরোজ বেগম, ছেলে নুর মোহাম্মদ ও মেয়ে জুলিয়া পাগলামী করছে। মাঝে মাঝেই প্রলাপ বকছে। কাউকে ঘুপরিতে রাখতে পারছি না। ওই ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর দূর্বিসহ স্মৃতি মনে পড়লে আমি নিজেও অস্বাভাবিক হয়ে পড়ি। কি করবো তার কিনারা করতে পারছি না।
ঘুমধুম সীমান্তের তমরু খলিফাপাড়া ক্যাম্পে ত্রিপলের তাবুর ভিতরে এক যুবতীকে কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করতে দেখেছি। রসনা নামের ওই যুবতী ঝুপড়ি ঘরের ভিতরেই ‘আগুন, আগুন; মিলিটারি, মিলিটারি; গুলি করছে; জবাই করছে’ বলেই চিৎকার করছে। পাশে বসা মা ময়মুনা তাকে সান্তনা দিচ্ছেন ‘আমরা এখন বাংলাদেশে। আমি তোমাদের ডাক্তার দেখাব। চিকিৎসা করবো তুমি ভাল হয়ে যাবে’। ময়মুনা জানান, তার মেয়ের সামনেই পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছে বর্মী মগরা। তার উপরও কয়েকজন মগদস্যু পশুত্বের মতোই পৈচাসিকতা চালিয়েছে। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারানো মেয়ে রসনার পাগলামোতে মা দিশেহারা।
৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে টেকনাফে নাফ নদের পাড়ে বসে রয়েছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী শিশু। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষন করে টাকা চাচ্ছেন। বøাউজবিহীন শরীরে ছেঁড়া শাড়ি পরিহিত এক মধ্যবয়স্ক নারী একশ টাকার নোট হাতে পেয়ে কেঁদে ফেললেন। তার বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে জানান, শাহপরী দ্বীপ হয়ে তারা টেকনাফে এসেছেন। এখন কোথায় যাবেন এখনো ঠিক করেননি। তিনি চোখের সামনে পরিবারের তিনজনকে মরতে দেখেছেন। পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্য ভাতিজা বাকরুদ্ধ। মাঝে মাঝেই বুকের ভেতর জ্বলছে জ্বলছে বলে কেঁদে উঠে। আবোল তাবোল বকছে, পাগলামী করছে। বললেন, কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছি না। ৫দিন রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো ঘুরে মনে হয়েছে আশ্রয় পেলেও অধিকাংশ রোহিঙ্গা এখনো আতঙ্কগ্রস্থ। মিয়ানমারে বর্মী সেনার বীভৎসতা দেখে ও নিজেদের স্বজন হারিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন অধিকাংশ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু। বর্বর হত্যাকাÐ, ক্ষত-বিক্ষত লাশ, আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য, স্বজন হারানো, এক রাতে নিঃস্ব শরণার্থীতে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শিশু-নারী-পুরুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। রাতে অনেকেই ঘুমাতে পারছেন না। চোখ বুজলেই তাড়া করছে সেই দুঃস্বপ্ন, দূর্বিসহ স্মৃতি-পৈচাসিক দৃশ্য। এলোমেলো হয়ে পড়েছে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবন।
পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত পাঠ করে মৌলুভী মোঃ হাছান বলেছিলেন, একটি অন্যায় হত্যাকে কোরআনে বিশ্বমানবতাকে হত্যার সমতুল্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই কোথাও কোনো হত্যাকাÐ ঘটতে দেখলে অন্যদের উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা। আলাহ বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল; সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল (সুরা ঃ মাঈদা, আয়াত ঃ ৩২)।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যেদের অধিকাংশ জন্মসুত্রে গৌতম বুদ্ধের অনুসারী। মহামতি গৌতম বুদ্ধের বাণী ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। যাপিতজীবনে তিনি সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সেনাবাহিনীর আচরণে মনে হয় না তারা বৌদ্ধে দীক্ষায় দীক্ষিত। যদি তারা ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-আচরণে অভ্যস্ত হতেন তাহলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর এ ধরনের নিষ্ঠুরতা-বর্বরোতা-অসভ্যতা-পৈচাসিকতা করতে পারতেন না। এখনো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর বর্বর নির্যাতন চলছে। সুচির সেনাবাহিনী জাতীসংঘ, আন্তর্জাতিক মহল, মানবাধিকার সংস্থা, প্রতিবেশি রাষ্ট্র কারো কথাই কর্ণপাত করছেন না। এখন বিপন্ন রোহিঙ্গাদের ওপর আল্লাহর রহমত ছাড়া তাদের সামনে বাঁচার কোনো পথ নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।