Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ইলিশশূন্য বাজারে কদর বেড়েছে রাজশাহীর পাঁচ মিশালি মাছের

| প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম


রেজাউল করিম রাজু
মাছের রাজা ইলিশ প্রবাদটি একেবারে সত্যি। যার প্রমাণ মিলছে এখন ইলিশ বিহীন বাজারে। গত ক’মাস ধরে মাছ বাজারে বেশ দাপট দেখাচ্ছিল। ফলে অন্য মাছের চাহিদা ও দাম কমে গিয়েছিল। তার সাথে কোরবানীর সময় হওয়ায় ফ্রিজে রান্না ঘরে সর্বত্র ছিল কোরবানীর মাংশ আর ইলিশের। এখনো বিত্তবান ও মধ্যবিত্তদের ফ্রীজে দখল করে রেখেছে ইলিশ ও মাংস। ইলিশ ধরা নিষিদ্ধের দু’দিন আগ পর্যন্ত ইলিশ নিয়ে ছিল কড়াকড়ি। সরবরাহ বেশী হওয়ায় দামও বেশ কিছুটা অসহনীয় হয়েছিল ইলিশের। ফলে মাছের খামারীরা নিজেদের খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিল। খামার থেকে অল্প অল্প করে মাছ সরবরাহ করছিল। কারণ বাজার চাহিদা ও দর কমে যাওয়া। ইলিশ আর কোরবানীর মাংস শুধু অন্য মাছের কদর কমায়নি। প্রভাব ফেলে মাংসের বাজার ও মুরগীর বাজারে। ডিমের দামও কমে যায়।
রাজশাহী অঞ্চলে ব্রয়লার মুরগীর পাইকারী দর কেজি প্রতি নেমে আসে একশো টাকার নীচে। খোলা বাজারে বিক্রি হয়েছে একশ’ দশ টাকার মধ্যে। এরপর সোনালী মুরগী ইলিশের দাপটে দুইশ’ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা কমে প্রতি কেজিতে দাঁড়ায় দেড়শ’ টাকায়। ডিমের হালিও চলে আসে কুড়ি টাকায়। খামারের রুই কাতলা, বোয়াল, ট্যাংরা, পুটি, সিলভারকাপ, লাইলোনটিকা আর কৈ মাছের দামও ছিল কম। এবার বন্যায় খাল বিল খামার পুকুর দিঘী নদী সব একাকার হয়ে যাওয়ায় সর্বত্র রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ। খাল বিলের মাছের দাম পাচ্ছিলনা বলে কোথাও কোথাও জেলেরা পচা মাছ ফেলে দিচ্ছিল।
গত ১ অক্টোবর থেকে ইলিশ মাছ ধরা বাজারজাত বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে। বাজার থেকে ইলিশ উধাও। জেলেরা নামছেনা নদীতে। দাপট দেখানো ইলিশ বাজারে না থাকায় বাড়ছে অন্য মাছের দাম। তিন চার দিনের ব্যবধানে মাছের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পরিবর্তনের হাওয়া মাছের বাজারে। সব ধরনের মাছের দাম গত মাসের চেয়ে এ মাসের শুরুতেই কেজিপ্রতি বেড়েছে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। খামারীরা বাজার নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে। দিন যত যাবে তত বাড়বে মাছের দাম। তবে রাজশাহীতে তা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে এমন আশ্বাস দেন মৎস্য ব্যবসায়ীরা। কারণ এখানে যা মাছ উৎপাদন হয় তা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশী। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলায় যায়। এখানকার জ্যান্ত মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এখানে ফরমালিন দিয়ে তরতাজা রাখার দিন শেষ।
এদিকে রাজশাহী অঞ্চলে মাছ চাষে বিল্পব ঘটে গেছে। লাভজনক হওয়ায় ঝুঁকে পড়েছে মাছ চাষে। আবাদি জমি রুপান্তর হয়েছে বড় বড় দিঘীতে। মাছ চাষে প্রয়োগ হচ্ছে আধুনিক কলা কৌশল। মাছের খাবারেও এসেছে পরিবর্তন। মাছের খামারীরা জানান, এখানকার রুই কাতল মৃগেল কার্প জাতীয় মাছ যাচ্ছে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সিলেটে। রাজধানীর মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে তাজা মাছের চাহিদা বেশী। ক্রেতারাও একটু বেশী দাম দিয়ে হলেও তাজা মাছ পেতে চান। তাছাড়া তাজা মাছে ফরমালিনের বালাই নেই। তাজা মাছের স্বাদের ব্যাপারটিও আলাদা। তাজা মাছের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লাভবান হচ্ছে খামারী ও ব্যবসায়ীরা। সর্বত্র তাজা মাছের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খামারী ও ব্যবসায়ীরা সচেষ্ট তাজা মাছ সরবরাহে। ট্রাকের উপর বাঁশের ফ্রেমের সাথে মোটা পলিথিন দিয়ে কৃতিম পুকুর তৈরী করা হচ্ছে। সেই পুকুরে পানি ভরে পুকুর খামার থেকে তাজা মাছ ধরে সাথে সাথে ছাড়া হচ্ছে। এভাবেই সকাল বেলা ঢাকার কারওয়ান বাজারে পৌছে যাচ্ছে রাজশাহীর জ্যান্ত রুই কাতল।
ব্যবসায়ীরা জানান, তারা প্রতিদিন ২০/২৫ ট্রাকে ঢাকায় আড়াই থেকে তিনশ’ মণ তাজা মাছ পাঠাচ্ছেন। আগে যেখানে বরফ দিয়ে মাছ পাঠিয়ে যা দাম পেতেন এখন জ্যান্ত মাছ পাঠিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশী দাম পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, তাজা মাছ পাঠানো শুরু হয় ২০১১ সালে। দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। খামারী ও পুকুর মালিকরাও মাছের বাজার খুঁজে পেয়েছে। ট্রাক প্রতি মরা মাছের চেয়ে জ্যান্ত মাছ পাঠিয়ে সব খরচ বাদ দিয়ে ট্রাকপ্রতি অন্তত চার পাঁচ হাজার টাকা বেশী পাচ্ছেন। খামারে উৎপাদিত মাছের বাজার নিয়ে ভাবতে হয় না।
মৎস্য বিভাগ সুত্র জানায়, এ অঞ্চলে এখন মাছের বার্ষিক উৎপাদন ৬৬ হাজার ৮৮২ টন। চাহিদা ৫১ হাজার ১৫১ টন। বাড়তি উৎপাদিত হচ্ছে ১৫ হাজার ৭৩১ টন। সরকারী হিসাবে দেখা গেছে, জেলার ৮ হাজার ৫৭২ জন মৎস্যজীবী মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরার কাজ করে। এছাড়া রয়েছে ১৩ হাজার ৬৯৫ জন মৎস্য চাষি যারা বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করেন। মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ২১৮টি মৎস্যজীবী এবং ৩৬টি মৎস্য চাষি সমিতি। জেলায় মোট দীঘির সংখ্যা ৪৭ হাজার ৯৮৪টি। এখান থেকে মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে ৪৮ হাজার ২৭২ টন মাছ। সরকারী পুকুর আছে ৪ হাজার ৯০৫টি। এখান থেকে আসে ৪ হাজার ৩০৬ দশমিক ৩৪ টন। বেসরকারী দীঘি রয়েছে ৩৬ হাজার ৯৬১টি। বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশী। প্রতিনিয়তই খনন হচ্ছে দিঘী।
রাজশাহীতে সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে বাণ্যিজ্যিক মাছের খামার। এর সংখ্যা ৬ হাজার ১০৮টি। আয়তন ৩ হাজার ৪২১ দশমিক ৬৮ হেক্টর। এখানে উৎপাদন করা হয় ১৯ হাজার ৪৬৪ দশমিক ৩০ টন মাছ। এছাড়া ৭৩টি বিল থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ৫ হাজার ৮৫১ টন। প্লাবন ভুমি থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে ৪ হাজার ৯২ দশমিক ৫০ টন মাছ। ৬৬টি খাল থেকে ২১৯ দশমিক ১৫ টন। ধানক্ষেতে উৎপাদিত করা হচ্ছে ৪ হাজার ৬৩০ দশমিক ২৬ টন মাছ। অপ্রচলিত জলাশয় থেকে আসছে ৮০ দশমিক ৫০ টন মাছ। ২১টি নদ নদী থেকে আসছে ৩ হাজার ৫৪১ দশমিক ৮৪ টন মাছ। এছাড়া গলদা চিংড়ী চাষ করছেন সাতজন মৎস্যজীবী। তারা উৎপাদন করছেন দশমিক ৫ টন মাছ। ৬৫ জন পাঙ্গাশ চাষি ১৯০ দশমিক ৫ টন পাঙ্গাশ উৎপাদন করছেন। মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ করছেন ৬৫ জন চাষি। তারা ৪০৮ দশমিক ৫টন মাছ উৎপাদন করেন। এ বছর সরকারী দুটি হ্যাচারি থেকে ৪৫৬ কেজি রেনু পোনা, ২ লাখ ৯২টি পোনা ও ১ হাজার ৮৫০ কেজি ব্রান্ড পোনা উৎপাদন করা হয়। বেসরকারী ১২টি হ্যাচারি থেকে ৯ হাজার ৯৫কেজি রেণু পোনা উৎপাদন করা হয়। পোনা উৎপাদিত হয়েছে ১৪ লাখ ৮ হাজারটি। জেলায় বেসরকারী ১৪২টি মৎস্য নার্সারি রয়েছে যেখানে পোনা উৎপাদিত হয় ৯৪১ দশমিক ৩১ টন। সব মিলিয়ে মাছ উৎপাদনে এ অঞ্চলে নিরব বিপ্লব ঘটছে।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইলিশ

২০ নভেম্বর, ২০২২
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ