পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য : পুরো মাসে দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা : আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের সঙ্ঘবদ্ধ চক্র চালায় ভিক্ষা বাণিজ্য
উমর ফারুক আলহাদী : ভিক্ষাবৃত্তি এখন লাভজনক এক বাণিজ্য। আর এ বাণিজ্যের নেপথ্যে কাজ করছে বেশ কটি শক্তিশালী চক্র বা সিন্ডিকেট। রাজধানীতে এ ভিক্ষাবৃত্তির আড়ালে চলছে বাণিজ্য। দেশের ভিভিন্ন এলাকা থেকে বিকালাঙ্গ, প্রতিবন্ধী, শিশু কিশোরসহ হতদরিদ্র ও বয়োঃবৃদ্ধ নারী-পুরুষ রাজধানীতে এনে ভিক্ষা করাছে কয়েকটি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের সদস্য না হয়ে কেউ ভিক্ষাও করতে পারে না। সিন্ডিকেটের সদস্যরা অবুঝ শিশু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কাজে লাগিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এমনকি সুস্থ মানুষকেও কৃত্রিম উপায়ে প্রতিবন্ধিত্বের কবলে ফেলে এ বাণিজ্য করছে তারা। প্রায় ৩ লাখ ভিক্ষুক এখন রাজধানীর অলি গলিসহ ব্যস্ততম প্রধান সড়ক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিক্ষার নামে অসাধু সিন্ডিকেট প্রতি মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে ৬শ’ কোটি টাকা। রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক অবৈধ ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি। এসব সমিতি পরিচালনা করেন প্রভাবশালী চাঁদাবাজ চক্র। তাদের সাথে আইন শৃংখলা বাহিনীর এক শ্রেণীর অসাধু সদস্যেরও রয়েছে গোপন আঁতাত। রাজধানীতে ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতি নামে সংস্থা আছে কমপক্ষে ২০০টি। এসব সমিতিতে ভিক্ষুকদের প্রতিদিন ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে চাঁদা জমা দিতে হয়। আর ভিক্ষা শুরুর আগে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। একেকটি চক্রের আওতায় রয়েছে ৪শ’ থেকে দুই হাজার ভিক্ষুক। রেজিস্ট্রেশনের পর এসব সমিতির সদস্যরাই নির্ধারণ করে দেয় কোন ভিক্ষুক বা কারা কোন এলাকায় ভিক্ষা করবে।
গত বছর রাজধানীতে এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত দু’জন গডফাদার র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের স্বীকারোক্তিতে প্রকাশ পেয়েছে ভয়ঙ্কর এসব ঘটনা।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় নিয়মিত ভিক্ষুক রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। তবে বিভিন্ন সূত্র মতে রাজধানীতে বর্তমানে এ সংখ্যা অন্তত ৩ লাখ। গত কয়েক দিন সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং ভিক্ষুকদের কথিত নেতা, সদস্য ও ভিক্ষুকদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিদিন রাজধানীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ভিক্ষা বাণিজ্য হচ্ছে। পুরো মাসে এই ভিক্ষার টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০০ কোটি টাকা। ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের সংঘবদ্ধ চক্রগুলো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও এলাকাভিত্তিক প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে চালায় এ ভিক্ষা বাণিজ্য।
একটি সংস্থার নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিয়মিত ভিক্ষা করে কিছু অন্ধ ভিক্ষুক। প্রতিটি ভিক্ষুক দলের সঙ্গে থাকে একজন ম্যানেজার। এদের নেপথ্যে রয়েছেন টঙ্গীর বাবুল নামের এক ব্যক্তি। যিনি ভিক্ষুকদের ম্যানেজার বলে পরিচিত। ভিক্ষুকদের নেতা নামে পরিচিত বাবুলের নেতৃত্বে ৩ শতাধিক ভিক্ষুক রয়েছে। এ ভিক্ষুকদের ভাগ করে ছোট বড় দল তৈরী করে ভিক্ষা করানো হয়। তার নেতৃত্বে থাকা ভিক্ষুকেরা গুলশান, বনানী, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত, টঙ্গী এবং বিমানবন্দর এলাকায় ভিক্ষা করে।
গুলশানের ছালাম ও বাকি মিয়া নামের দু’জন ভিক্ষুক প্রতিদিন ভিক্ষার টাকা জমা রাখে একটি দোকানে। ছালাম প্রতিদিন ৭শ’ থেকে এক হাজার টাকা জমিয়ে মাস শেষে প্রায় ২৫ হাজার টাকা তার গ্রামের বাড়ি মাগুরায় পাঠাত। এখন সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে প্রায় ৯ হাজার টাকা দিতে হয়।
রাজধানীর খিলক্ষেতে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভিক্ষুকদের একজন দালাল গত বৃহস্পতিবার জানায়, ১৫ বছর আগে চাকরির সন্ধানে রাজধানীতে আসে সে। তারপর আজিমপুরের জামালের মাধ্যমে ভিক্ষুকদের দালালিতে যোগ দেয়। ১০০ টাকা রোজে কাজ শুরু করে এখন তার আয় প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৭শ’ টাকা। সে আরো জানায়, প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এসব সিন্ডিকেটের পেছনে রয়েছে। নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাম কখনোই বলা যাবে না। তাহলে আমার আয় রোজগার তো বন্ধ হবেই, প্রাণে বাঁচাও দায় হবে। তিনি বলেন, ওদের পুলিশেও কিছু করে না। কারণ পুলিশের সাথে তাদের ভাল যোগাযোগ রয়েছে।
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কয়েকজন ভিক্ষুক জানান, ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে চলে চাঁদাবাজিও। অন্তত ৩০০ পয়েন্টে একজন করে লাইনম্যান ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ভিক্ষুক জানায়, খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট এলাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভিক্ষুকদের একটি সিন্ডিকেট। টুন্ডা আমান উল্লাহ ও কানা ফজলুর নেতৃত্বে ২০ জন এসব দলের প্রধান। বাড়তি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে তারা নানা প্রলোভনে দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে নারী-পুরুষ ও শিশুদের অগ্রীম টাকা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসে। ভিক্ষার অর্ধেক টাকা দিতে হয় এ চক্রের তহবিলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে। তবে অঙ্গহানির কাজটি যারা করছে তাদের ধরতে বিশেষভাবে কাজ করছে র্যাব।
কয়েকটি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, একেকজন ভিক্ষুক দিনে গড়ে আয় করে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা। প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে শুরু করে বড় সমিতিতে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা হয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। টাকা জমা দেওয়ার পর তাদের ৬০ থেকে ১২০ টাকা দেওয়া হয় খাওয়ার খরচ বাবদ। বিপরীতে তাদের এককালীন বড় অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। এলাকাভিত্তিক ২০ থেকে ৩০ জনের কমিটি এসব ভিক্ষুককে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে ভিক্ষুকদের সারা দিনের আয়ের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা হয় রাতে। আবার বিকালাঙ্গ ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা সর্বাধিক আয় করে থাকে। প্রতিবন্ধী ও হাত পা নেই, নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না, এ ধরনের ভিক্ষুকের জন্য রয়েছে আলাদা থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। এদের একজন ভিক্ষুককে থাকা খাওয়াসহ মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা দেয়া হয়। বাকী টাকা সিন্ডিকেট সদস্যদের পকেটে যায়। রংপুর এলাকার জহির নামের একজন ভিক্ষুক জানান, তার মাসিক আয় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। তবে তাকে মাত্র ৬ হাজার টাকা দেয়া হয়। গত শুক্রবার বিকালে উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় জহিরের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
গতকাল সকাল ১১টায় রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে কথা হয় মনির নামের এক ভিক্ষুকের সাথে। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে। মনিরের দুই পা ও একটি হাত নেই। নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। সে জানায়, রাজধানীতে সিন্ডিকেটের অধীনে না এসে ভিক্ষা করে জীবন বাঁচানো অনেক কঠিন এখন। ভিক্ষুক হতে হলে তাকে যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার মতো শুধু যোগ্যতা থাকলেই সে একজন যোগ্য ভিক্ষুক হতে পারবে না, এ জন্য সিন্ডিকেটের সদস্যও হতে হবে। তাহলেই ভিক্ষুকের বাজারে তার অনেক কদর। তারাই ভিক্ষার জন্য সহানভূতি পায় অনেক বেশি। সে জানায়, ৫ বছর আগে তার এলাকার রতন মিয়া নামের একজন পোষাক কারখানার শ্রমিকের মাধ্যমে ঢাকায় আসে। প্রতি শুক্রবার সকাল ১০টায় উত্তরা ১১ নং সেক্টরের মসজিদের সামনে রেখে দেয়া হয়। বিকালে আবার গুলশান নিয়ে যায় সুমন নামের একজন দালাল। সুমন গুলশান ভিক্ষুক কল্যাণ সমিতির সদস্য।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর অলি-গলি থেকে শুরু করে ব্যস্ততম প্রধান সড়ক সব জায়গাতেই এখন ভিক্ষাবৃত্তির ভিড়ের দৃশ্য চোখে পড়বে। রাস্তায় ট্র্যাফিক সিগন্যাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় প্রতিটি পয়েন্টে গাড়ির উপর হামলে পড়ে এসব ভিক্ষুকের দল। বাচ্চা কোলে নিয়ে শিশু ও মহিলা, শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশু, অসুস্থতাসহ যে যেভাবে পারছেন সেভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করছেন সাহায্যোর জন্য। অল্প বয়সী ও সুস্থ-সবল মানুষও নেমেছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। এ ভিক্ষুকদের নানারকম উৎপাত ও বিরক্তিকর আচরণে ক্ষুব্ধ অনেকেই। এ বিষয়ে ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ভিক্ষা ফেলে রাস্তার মধ্যেই ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। কারো কারো আবার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ভিক্ষুক দেখা যায় অভিজাত এলাকা গুলশান-১ ও গুলশান-২ গোলচত্বর, কাকরাইল মসজিদ, মহাখালী রেলগেট মসজিদ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, হাইকোর্ট মাজার ও মসজিদ, মিরপুর শাহ আলী মাজার ও মসজিদ, গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার, চকবাজার মসজিদ, আজিমপুর কবরস্থান, মতিঝিল, গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ, উত্তরা ও বনানীর মসজিদগুলোর কাছে এবং রাস্তার মোড়ে মোড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, মাদারিপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা হয়েছে বেশিরভাগ ভিক্ষুক। তাদের থাকার জন্য রাজধানীর মিরপুর বেড়িবাঁধ ও দিয়াবাড়ি বেড়িবাঁধ, বাউনিয়া বাঁধ, উত্তর খান, দক্ষিণখান, হাজারিবাগ বেড়িবাঁধ, কামরাঙ্গীর চর, মোহম্মদপুর বেড়িবাঁধ, শনির আখড়া, আব্দুল্লাহপুর ও টঙ্গীর বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট খুপরি ঘর ভাড়া নেয়া হয়েছে। ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটই এদের থাকার জন্য ঘর ভাড়া করে দেয়। পাশাপাশি রাজধানীর রামপুরা, বাড্ডা, বেইলী রোড, ফার্মগেট, আজিমপুর, হাইকোর্ট মাজার, মতিঝিল, কমলাপুর, ওয়ারী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, শ্যামলী, গাবতলী ও উত্তরাসহ অন্তত ২০টি পয়েন্টে কাজ করছে এ চক্র। তাদের বিভিন্ন নামে রয়েছে নিজস্ব অফিস।
হাইকোর্ট মাজার এলাকার ভিক্ষুক নেতা আরিফুল ইসলাম বলেন, শবে বরাত, রমজান, শবে কদর আর ঈদের সময় আওরা (মৌসুমী) ভিক্ষুকগো লেইগ্যা আমরা কোনো টাকা-পয়সা পাই না। এখন বেশিরভাগই আওরা ভিক্ষুক।
সমাজকল্যাণ অধিদফতরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারাদেশে সাড়ে ৭ লাখ বেশি ভিক্ষুক রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।
এদিকে, রাজধানীর ভিআইপি এলাকাসহ ৭টি এলাকায় গত বছর ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। আবারও এসব এলাকায় ভিক্ষা বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।