নজরুল সাহিত্যে মহররম
একনজরুল সাহিত্যে মোহররম, এই বিষয়টার ওপর যদি লিখতে হয় তা হলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, ইসলাম কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ছিল একটা আশ্রয়।
ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দটি আরবী ভাষায় ব্যবহার অনুসারে নাম বাচক বিশেষ্য নয়, বরং গুণবাচক বিশেষণ। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে প্রাচীন মক্কার বছরের প্রথম দু’টি মাস ছিল প্রথম সফর ও দ্বিতীয় সফর। প্রাচীন আরবী ভাষায় সাফারাইলি এই দ্বিবাচনিক রূপ দেখে তা’ স্পষ্টতই বুঝা যায়।
প্রাচীন আরব বছরের প্রথম অর্ধ বছরে তিনটি মাস ছিল এবং এই তিনটি মাসের প্রত্যেকটিতে দু’টি করে মাস ছিল। অর্থাৎ দুই সফর, দুই রবী ও দুই জুমাদা। দুই সফরের প্রথমটি অলঙ্ঘনীয় পবিত্র মাসগুলোর (আশহুরে হুরুম) অন্যতম ছিল বলে এর গুণবাচক আখ্যা দেয়া হয়ে ছিল ‘মহররম’। ধীরে ধীরে তা-ই মাসের নাম হয়ে গেছে। এভাবেই প্রথম সফর মাসটি ‘মহররম’ মাস নামে এবং অলঙ্খনীয় মাসগুলোর প্রথম মাস হিসেবে কালের খাতায়, ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
মহান রাব্বুল আলামীন বছর ও সময় গণনার রীতি-পদ্ধতী চিরদিনের জন্য বিধিবদ্ধ করার লক্ষ্যে কুরআনুল কারীমের ৯নং সূরা তাওবাহ-এর ৩৬ ও ৩৭ নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন : আকাশ মÐলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় বারটি মাস রয়েছে। তন্মধ্যে চারটি হলো অলঙ্খনীয়। নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুুলুম করো না এবং তোমরা মুশরিকদের সাথে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রেখো, আল্লাহ মোত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। এই যে (অলস্থনীয়) মাসকে পিছিয়ে দেয়া কেবল কুফুরীকে বৃদ্ধি করা মাত্র। যা দ্বারা কাফেরগণকে বিভ্রান্ত করা হয়। তারা উহাকে কোন বছরে বৈধ করে এবং কোন বছরে অবৈধ করে, যাতে তারা আল্লাহপাক যেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছেন, সে গুলোর গণনা পূর্ণ করতে পারে। অনন্তর আল্লাহপাক যা নিষিদ্ধ করেছেন, তা হালাল করতে পারে। তাদের মন্দ কাজগুলোকে তাদের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে; আল্লাহপাক অবশ্যই কাফির সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সূরা তাওবাহ: আয়াত নং ৩৬,৩৭, পারা ১০, রুকু-৫)।
পবিত্র মাসগুলোতে মুসলমানদের কর্তব্য নির্ধারণ করে আল কুরআনের ২নং সূরা বাকারাহ-এর ১৯৪নং আয়াতে ও ২১৭নং আয়াতে এবং ৫নং সূরা মায়িদাহ এর ২নং আয়াতে ও ৫৭ নং আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন : পবিত্র মাস পবিত্র মাসের বিনিময়ে, সমস্ত পবিত্র বিষয় যার অবমাননা নিষিদ্ধ তার জন্য রয়েছে কিসাসের ব্যবস্থা। সুতরাং যে কেউ তোমাদেরকে আক্রমণ করবে তোমরাও তাকে অনুরূপ আক্রমণ করবে এবং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং জেনে রেখো, আল্লাহ মোত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। আরও ইরশাদ হয়েছে : পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, বলুন, এতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাঁধা দান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা মসজিদুল হারামে বাধা দান করা এবং এর বাসিন্দাকে উহা হতে বের করে দেয়া, আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা অধিক অন্যায়, ফিতনা, হত্যা অপেক্ষা অধিক অন্যায়, তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে সে পর্যন্ত তোমাদেরকে ধর্ম হতে ফিরিয়ে না দেয়া, যদি তারা সক্ষম হয়। আরও ইরশাদ হয়েছে : তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর। আরও ইরশাদ হয়েছে: যদি তোমরা মুমিন হও তবে আল্লাহকেই ভয় কর। মহররম ইসলামী আরবী সনের প্রথম মাস। এই মাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বরকতময়, ও ফযিলতের মাস। এই মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে মহান রাব্বুল আলামীন আল কুরআনের ৯ নং সূরা তাওবাহ এর ৩৬ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই আকাশমÐল ও ভূমÐল সৃষ্টির দিন হতে আল্লাহপাকের বিধানে মাসের সংখ্যা বারটি। তারমধ্যে চারটি মাস সম্মানীত ও অলঙ্খনীয় (যথা : জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব)। এই চারটি মাসের মধ্যে মহররম হলো অন্যতম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই মাস যেমন বছরের প্রারম্ভ তেমনি সৃষ্টি জগতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই মাসে সম্পন্ন হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই মাসে বেদনা ও শোকের মাস, শোকরিয়া জ্ঞাপন ও নাজাত লাভের মাস, রহমত ও বরকতের মাস।
হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: সর্বোত্মম রোজা হলো রমযান মাসের রোজা। তারপর আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোজা। (মিসকাত শরীফ এর/১৭৮ পৃ:)। হযরত আবু কাতাদাহ (রা:) হতে বর্ণিত আছে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার ওসিলায় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অতীতের এক বছরের সগীরা গোনাহ মাফ করে দেবেন। (মিশকাত শরীফ : ১/১৭৯)।
হাদীস শরীফে আরও বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি মহররম মাসের যে কোন তারিখে রোজা রাখবে, সে রোজার বিনিময়ে আল্লাহপাক তাকে একমাস রোজা রাখার সওয়াব দান করবেন। (তারীখ-ই কারবালা : ৯০ পৃ:)।
সুতরাং এ কথা খুবই প্রণিধানযোগ্য যে, নফল এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহপাকের নৈকট্য লাভ করা সহজতর হয় এবং রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর অনুকরণ ও অনুসরণ পরিপূর্ণতা লাভ করে। এ প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) বর্ণিত হাদীস খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : আমি রাসূলুল্লাহ (সা:) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহপাক ও তাঁর রাসূলের অনুকরণ করা হতে হাত সরিয়ে নেবে, কিয়ামতের দিন নাজাতের জন্য তার সপক্ষে কোন দলিল থাকবে না। আর সে ব্যক্তি উপযুক্ত মোর্শেদের শিষ্য হওয়া ছাড়া মৃত্যু বরণ করবে, তার মৃত্যু হবে জাহেলী যুগের বেঈমান লোকদের মত। (সহীহ মুসলিম শরীফ : ২/১২৮ পৃ:)।
মহররম মাসে করণীয় নফল ইবাদতের গুরুত্ব অপরিসীম। তন্মেধ্যে রয়েছে প্রথম দশদিন রোজা রাখা, প্রত্যেহ সামর্থÑ অনুসারে নফল নামাজ আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকির-আজকার ও মোরাকাবা ও মোশাহাদায় নিমগ্ন থাকা। আশুরার দিন রোজা রাখার বিষয়টি সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা (রা:) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা:) মদীনা মুনাওয়ারায় একদিন কতিপয় ইহুদীদের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন তারা আশুরার দিবসের রোজা রেখেছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কিসের রোজা? তারা উত্তর করল, এটা ঐদিন, যে দিন আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত হযরত মূসা (আ:) ও বনী-ইস্রাঈলকে নীল নদে নিমজ্জিত হওয়া থেকে উদ্ধার করেছেন। আর ফেরাউন ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে ডুবিয়ে মেরে ছিলেন। আর ঐ দিনে হযরত নূহ (আ:) এর নৌকা জুগী পর্বতে স্থিত হয়েছিল। ফলে হযরত মূসা (আ:) ও হযরত নূহ (আ:) আল্লাহপাকের অনুগ্রহের শোকরিয়া স্বরূপ রোজা রেখেছিলেন। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন : হযরত মূসা (আ:)-এর ওপর আমার হকই বেশি এবং এইদিনে রোজা রাখার আমিই বেশি হকদার। আর সাহাবীদের বললেন : তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখ। আমিও রেখেছি। (মিশকাত শরীফ: ১/১৮০ পৃ:)।
ইসলামী আরবী সনের প্রথম মাস মহররম। এই মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। এই মাসের দশ তারিখে সংঘটিত হয়েছে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। সে ঘটনা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে আশুরার দিন শহীদ হয়েছিলেন বলেই সে আশুরার মর্যাদা ইসলামী শরীয়তে সমধিক তা নয়। বরং আশুরার দিনের মর্যাদার আরও কারণ আছে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত এমন অনেক মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা রয়েছে যেগুলোর সাথে আশুরার দিবসটি ওতপ্রোতভাবে বিজড়িত। নিম্নে আমরা সেগুলোর পরিচয় তুলে ধরতে প্রয়াস পাব। ইনশাআল্লাহ।
(১) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কলিজার টুকরা, জান্নাতী যুবকদের মর্যাদার সাইয়্যেদেনা ইমাম হুসাইন (রা.) ৬১ হিজরির ১০ই মহররম শুক্রবার আশুরার দিনে কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম হুসাইন (রা.)-এর সঙ্গীদের মধ্যে ঐদিন ৭২ জন সত্যের নির্ভীক সৈনিক ও শাহাদাত বরণ করেন। তখন ইমাম হুসাইন (রা.)এর বয়স হয়েছিল ৫৪ বছর ৬ মাস ১৫ দিন। (আল বিদায়া ওয়ান নেহায়া : ১/১৩২ পৃষ্ঠা)।
(২) মহররম মাসের ১০ তারিখে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত হযরত আদম (আ.) ও বিবি হাওয়া (আ.)-এর তাওবাহ কবুল করেছিলেন। এই দম্পতি যুগল আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের নিকট বিনীতভাবে আরজ করেছিলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের উপর অন্যায়-অত্যাচার করেছি। আপনি যদি ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো। (সুরা আ’রাফ : ক্রমিক নং-৭, আয়াত ২৩, পারা ৮, রুকু-২)।
(৩) আশুরার দিবসে হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদী পাহাড়ে অবস্থান করেছিল এবং তাঁর সাথীগণ জমিনে অবতরণ করেছিলেন এবং অবিশ্বাসী কাফেররা চিরতরে ধ্বংস হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে হযরত কাতাদাহ (রা.) হতে বর্ণিত আছে : রজব মাসের ১০ তারিখে হযরত নূহ (আ.) নৌকায় আরোহণ করেছিলেন এবং ১৫০ দিন ভ্রমণ করার পর নৌকাটি জুদী পর্বতের ওপর স্থিতিলাভ করে। সেখানে নৌকাটি একমাস অবস্থান করে। আশুরা দিবসে হযরত নূহ (আ.) দলবলসহ নৌকা থেকে জমিনে অবতরণ করেছিলেন। (সুরা হুদ : ক্রমিক নং-১১, আয়াত- ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, পারা-১২, রুকু-৪) এবং সুরা মুমিনুন : ক্রমিক নং-২৩, আয়াত ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, পারা-১২, রুকু-২)।
(৪) হযরত ইব্রাহীম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুÐ হতে আশুরার দিবসেই মুক্তিলাভ করেছিলেন। জ্বলন্ত আগুন ফুলবাগানে পরিণত হয়েছিল। মহান রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন : আমি হুকুম করলাম, হে আগুন! তুমি ইব্রাহীমের ওপর শীতল ও শান্তিদায়ক হয়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে এই অনল কুÐটি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জান্নাতে পরিণত হয়ে গেল। (সুরা আম্বিয়া, ক্রমিক নং-২১, আয়াত-৬৮, ৬৯, ৭০, পারা-১৭, রুকু-৫)।
(৫) হযরত মুসা (আ.) আশুরার দিন সদলবলে নীল নদ অতিক্রম করেছিলেন এবং আল্লাহদ্রোহী ফেরাউন ও তার সেনা বাহিনী নীলনদে নিমজ্জিত হয়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেছিল। আর হযরত মুসা সর্বপ্রথম সেদিন আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সাথে কথা বলেছিলেন, সে দিনটি ছিল আশুরার দিন। (সুরা ত্বাহা, ক্রমিক নং-২০, আয়াত-৭৭, ৭৮, পারা-১৬, রুকু-৪ এবং সুরা যুখরুফ, ক্রমিক নং-৪৩, আয়াত-৫৫, ৫৬, পারা-২৫, রুকু-৫)।
(৬) হযরত আইয়্যুব (আ:) দীর্ঘ ১৮ বছর যাবত কঠিন রোগ ভোগের পর আশুরার দিবসে আরোগ্য লাভ করেন। হযরত আইয়্যুব (আ:) ছিলেন হযরত ইসহাক (আ:) এর পৌত্র। তিনি ছিলেন সম্পদশালী, মস্তবড় ইবাদতকারী ও ধৈর্যশীল বান্দাহ। তাঁর এক হাজার ঘোড়া, দুই হাজার উট, এক হাজার ভারবাহী গাধা, এক হাজার গবাদি পশু, দশ হাজার বকরী এবং খেদমতগার হিসেবে পাঁচ শত দাস-দাসী ছিল। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। এক সময় তাঁর সকল ছেলে-মেয়ে মারা গেল। স্ত্রীগণ যার যার বাবার বাড়ীতে পাড়ি জমালেন, বিবি রহিমা ছাড়া। এ সময় তিনি কঠিন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হলেন। বিবি রহিমা তাঁর খেদমত করতে লাগলেন। আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত হযরত আইয়্যুব (আ:) এর প্রতি সুপ্রসন্ন হলেন এবং তাকে পরিপূর্ণ সুস্থ করে ছিলেন এবং সকল ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দিলেন। সে দিনটি ছিল মহররমের দশ তাখির, আশুরার দিন। (সূরা সোয়াদ:) ক্রমিক নং-৩৮, আয়াত-৪১, ৪২, ৪৩ পারা-২৩, রুকু-৪, সূরা আম্বিয়া: ক্রমিক নং ২১, আয়াত ৮৩, ৮৪, পারা ১৭, রুকু ৬)। (৭) হযরত ইয়াকুব (আ:) তাঁর অতি আদবের সন্তান হযরত ইউসুফ (আ:) কে হারিয়ে বহুকাল ধরে যাতনা ভোগ করেছিলেন। হযরত ইউসুফ (আ:) আশুরার দিনেই অন্ধকার কূপ হতে উদ্ধার লাভ করেছিলেন এবং হযরত ইয়াকুব (আ:) আশুরার দিনেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। অবশেষে আশুরার দিনেই পিতা ও পুত্রের মিলন ঘটেছিল। (সূরা ইউসুফ : ক্রমিক নং ১২, আয়াত ১৫-১০০, পারা-১২-১৩, রুকু-২-১১)।
(৮) হযরত দাউদ (আ:)-এর দোয়া আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আশুরার দিনে কবুল করেছিলেন এবং তার প্রতি রহমত বর্ষণ করেছিলেন। (সূরা সোয়াদ: ক্রমিক নং ৩৮, আয়াত ২৪, ২৫,পারা-২৩ রুকু-২)।
(৯) হযরত মরিয়ম (আ:) এর গর্ভ হতে হযরত ঈসা রুহুল্লাহ (আ:) এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন আশুরার দিনেই। (সূরা আলে ইমরান: ক্রমিক নং ৩, আয়াত ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, পারা ৩, রুকু-৫)।
(১০) হযরত ইউনুস (আ:) চল্লিশ দিন মাছের পেটে অবস্থান করার পর আশুরার দিনেই মুক্তিলাভ করেছিলেন। (সূরা আম্বিয়া: ক্রমিক নং ২১, আয়াত ৮৭, ৮৮, পারা ১৭, রুকু-৬)।
(১১) হযরত ইদ্রিস (আ:) কে জান্নাত হতে দুনিয়ায় পাঠানোর পর কান্নাকাটি করলে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তাকে চতুর্থ আকাশে তুলে নেন আশুরার দিনেই। (সূরা মারয়াম : ক্রমিক নং ১৯, আয়াত ৫৬, ৬৭, ৫৮; পারা ১৬, রুকু-৪)।
(১২) হযরত সুলায়মান (আ:) আশুরার দিনেই সিংহাসন লাভ করেন এবং মানববসতী পূর্ণ গোটা বিশ্বের সম্রাট পদে আসীন হন। হযরত সুলায়মান (আ:) হাতের আংটি হারিয়ে সাময়িকভাবে সাম্রাজ্য হারা হলে মহান রাব্বুল ইজ্জত পুনরায় আশুরার দিনেই তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেন। (সূরা নামল: ক্রমিক নং-২৭, আয়াত ১৫-৪৪, পারা-১৯, রুকু-২, ৩)।
(১৩) আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত সাগর, পাহাড়, প্রাণীকুল, আসমান, জমিন, তন্মদ্যস্থ সকল বস্তু আশুরার দিনেই সৃষ্টি করেছেন। (সূরা- নামল: ক্রমিক নং ২৭, আয়াত ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩, ৬৪, পারা-২০, রুকু-৫)।
(১৪) হযরত ঈসা (আ:)কে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বহু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী করে দুনিয়ার প্রেরণ করেছিলেন। হযরত ঈসা (আ:) জন্ম লাভের পর হতে দীর্ঘ তেত্রিশটি বছর ধরে দুনিয়ার মানুষকে হেদায়েতের পথে আহŸান করেছিলেন। কিন্তু দুনিয়ার মানুষ তাঁর আহŸানে সাড়া দেয়নি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে আশুরায় দিনেই আসমানে তুলে নেন। (সূরা আলে ইমরান: ক্রমিক নং ৩, আয়াত ৫৫, ৫৬, পারা-৩, রুকু-৬)।
(১৫) মহররমের দশ তারিখ আশুরার দিনেই কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে। সৃষ্টি জগতের সব কিছু ভেঙ্গে চুড়ে একাকার হয়ে যাবে। এক আল্লাহ ছাড়া সকল বস্তুর বিলুপ্তি সাধিত হবে। (সূরা-ইয়াসীন, ক্রমিক নং ৩৬, আয়াত ৫১, ৫২, ৫৩, পারা-২৩, রুকু-৪)।
উপর্যুক্ত আলোচনার নিরিখে এ কথা স্পষ্টই বলা যায় যে, মহররম মাসের দশ তারিখ আশুরার দিবসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহিমামÐিত। এই দিন বিশ্বাসী বান্দাহদের উচিত বেশি বেশি করে নফল নামায আদায় করা, আশুরার রোজা রাখা এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তব জীবনের সর্বত্র তা আমলে পরিণত করা। কেননা সময়ের পরিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেলেও এমন বহু বিষয় আছে, যা কালের খাতায়, ইতিহাসের পাতায় চিরকাল ভাস্বর হয়ে ফুটতে থাকে। মহররম ও আশুরা এরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ব্যত্যয় হওয়ার জো নেই।
লেখক : গবেষক, ইসলাম বিশেষজ্ঞ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।