Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা লতাপাতা খেয়ে বেঁচে আছে

ইনকিলাব ডেস্ক: | প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সহিংসতায় যে এলাকাগুলো পুড়ে গেছে মংডু তারই একটি। মংডু শহরের উত্তর দিকে প্রধান সড়কের প্রায় ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় কয়েক হাজার মানুষের বাস ছিল। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানে সবগুলো গ্রাম পুড়ে গেছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মংডুর যেসব জায়গায় জনবসতি ছিল সেসব জায়গায় ক্ষুধার্ত কুকুর ছোট ছোট ছাগল খাচ্ছে। এই গ্রামগুলোর মসজিদ, মার্কেট ও স্কুল একসময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের পদচারণায় সরগরম থাকতো, কিন্তু এখন সেখানে সুনসান নিরবতা।
রাখাইনে সেনা অভিযানে সেখান থেকে পালিয়ে সাড়ে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনে সহিংসতায় নিহত হয়েছে অন্তত পাঁচশ’। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ঘটনাকে ইতোমধ্যেই ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ। যদিও মিয়ানমার সরকার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যাচার নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
মংডুর ইয়ে খাট চোং গোয়া সোন গ্রামের বাসিন্দা ৩২ বছর বয়সী সুয়াইদ ইসলাম বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। বার্তা সংস্থাকে তিনি জানান, গত বছরও তার গ্রামের বাসিন্দারা সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। যারা তখন পালিয়ে আসেননি তখন অস্থায়ী কুঁড়েঘর বানিয়ে, অনেকটা পালিয়ে বেঁচেছিলেন, সাহায্য সংস্থাগুলোর দেয়া ত্রাণের ওপর বেঁচে ছিলেন। এবারও সেনাবাহিনীর হামলা হবার পর তারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ‘আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, সেনা সদস্য আর পুলিশ যদি আমাদের খুঁজে পায় আর গুলি করে মেরে ফেলে...তাই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসেছি’ টেলিফোনে বলেন তিনি।
নিউইয়র্ক-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ২১৪টি গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। স্যাটেলাইটের ছবি পর্যালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার বলেছে, রাখাইনে ছয় হাজার আটশ’র বেশি ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে গেছে। এর জন্য তারা রোহিঙ্গা গ্রামবাসী ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ী করছে।
‘সন্ত্রাসীরা ঘরবাড়িগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে, এমন তথ্য আমাদের কাছে আছে’ বলেন অং সান সু চি’র মুখপাত্র।
রাখাইনে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও স¤প্রতি সেখানে কয়েকজন দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের এক দলকে মংডুতে যাবার অনুমতি দেয় কর্তৃপক্ষ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কয়েকজন সংবাদদাতা রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে মংডু, বুথিডং, এবং রাথেডং এলাকায় গেছেন। তারা মংডু থেকে সবচেয়ে কিয়েইন চাউং এলাকায় সড়ক পথে গাড়ি চালিয়ে গেছেন। সেনাবাহিনীর অভিযানে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই এলাকা। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে খুব কম কথা বলতে পেরেছেন সাংবাদিকরা। কারণ বহিরাগত কারও সঙ্গে কথা বলতে তারা ভয় পাচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বেশির ভাগেরই সাক্ষাৎকারই তারা নিয়েছেন ফোনের মাধ্যমে এবং যেখানে সেনাবাহিনীর অভিযান চলছে না সেই এলাকাগুলো থেকে নেয়া হয়েছে।
রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে জাতিসংঘ সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করছে- মিয়ানমার সরকারের এমন অভিযোগের মুখে বিশ্বসংস্থাটি সেখানে ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দেয়। আর জাতিসংঘ ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ ঘোষণার পর থেকে খুব কম ত্রাণ ও সহযোগিতা রাখাইনে পৌঁছেছে। রাজধানী সিতওয়েতে দুইবার রেডক্রসের ত্রাণবহর আটকে দিয়েছে স্থানীয় রাখাইনরা।
গত অক্টোবর মাসে রাখাইনের ইন উ শে কিয়া গ্রামের বাসিন্দারা অভিযোগ করে যে, সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে হামলা চালিয়েছে এবং গ্রামের নারীদের ধর্ষণ করেছে।
ওই গ্রামের একজন শিক্ষক ফোনে বার্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘ওই গ্রামে মোট আটশ’টি পরিবার ছিল। কিন্তু এখন সেখানে মাত্র একশ’র মতো পরিবার আছে। আর যারা সেখানে রয়ে গেছে তাদেরকে সেনাদের সঙ্গে অনেক লুকোচুরি করেই থাকতে হচ্ছে। কারণ সেনা সদস্যরারা সকালে গ্রামে তাদের খুঁজতে আসে। সে সময় বাসিন্দারা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে এবং রাতে তারা বাড়িতে ফিরে আসে’।
‘আজ সন্ধ্যায় খাওয়ার মতো কোনও খাবার নেই আমাদের, আর কীবা করার আছে? আমরা জঙ্গলের কাছাকাছি থাকি। সেখানে অনেক লতাপাতা আছে; আমরা তাই খাচ্ছি। এরপর একটু পানি সংগ্রহ করছি খাবার জন্য। এভাবেই বেঁচে আছি আমরা’ বলেন ওই শিক্ষক। কিন্তু ওই ওই শিক্ষকের নাম প্রকাশ করেনি রয়টার্স। কারণ তাদের ওপর নির্দেশনা জারি করা আছে যেন কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলে।
তিনি জানান, গর্ভবতী স্ত্রী, ছয় সন্তান আর বুড়ো বাবা-মাকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার মতো অবস্থা তার নেই।
কারা এই রোহিঙ্গা মুসলিম?
এদিকে অং সান সু চির মুখপাত্র বলছেন, রাখাইনে মানবিক সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়াকে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ‘কোনো এলাকায় যদি ত্রাণ না পৌঁছে থাকে আমাদের সেটা জানানো উচিত। জানা মাত্রই যত দ্রুত সম্ভব আমরা সেখানে ত্রাণ পৌঁছে দেব’ -বলেন তিনি। রাখাইনে চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে প্রায় ৩০ হাজার অমুসলিম বাসিন্দাও গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
মিয়ানমারের রাখাইনে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের বসবাস ছিল। যদিও সা¤প্রতিক সহিংসতায় সাড়ে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগেও কয়েক দফায় প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে বাস করছিল।
‘তারা চলে গেছে তাই খুশি’
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, স্থানীয় রাখাইনরা সেখান থেকে মুসলিমদের উচ্ছেদ করতে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করছে। মংডুর দক্ষিণাঞ্চলের আলেল থান কিয়াউ এলাকার বাসিন্দা ২২ বছর বয়সী কামাল হুসেইন রয়টার্সের সঙ্গে আলাপকালে জানান, ‘রাখাইন স¤প্রদায়ের লোকেরা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে চলে যায়। এরপর তারা যখন বের হয়ে আসে সেনা সদস্যরা এসে গ্রেনেড ছুড়ে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাড়ি আগুনে পুড়ে যাবার পর তারা পালিয়ে ছিলেন, সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তবে সু চির মুখপাত্র দাবি করছেন, কিছু খালি বাড়িতে রাখাইনরা আগুন লাগিয়েছে। আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সেনাবাহিনীর অভিযানে সহযোগিতাকারী দুই রাখাইন বৌদ্ধ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে রয়টার্সের প্রতিনিধি দল। এদের একজন টিন টুন সয়ে।
তিনি জানান, ‘সেনাবাহিনীর দ্রুত অভিযানের রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। হামলার পরদিনই প্রায় এক হাজার ৬০০ বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তারা (রোহিঙ্গারা) সংখ্যায় অনেক বেশি। তারা এখানে থাকলে আমাদের বেঁচে থাকা মুশকিল। তারা সবাই চলে গেছে তাই আমি খুব খুশি’। সূত্র : রয়টার্স।



 

Show all comments
  • Muhammad Oli Al-islam ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:৩২ পিএম says : 0
    ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের সামনে মুসলিম বিশ্ব!!!
    Total Reply(0) Reply
  • Harun Patwary ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১:৪৮ পিএম says : 0
    পৃথিবীর সব চেয়ে নির্মম ,নিষ্ঠুর ,মানবাধিকার লংঘন করেও বার্মার মত একটি দেশ যদি জাতিসংঘ কে পাত্তা না দেয় এবং জাতিসংঘ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে ভবিষ্যতে এই সংস্হার গুরুত্ব অনেকটা উপহাস্য হয়ে যাবে
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Mashud ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:০৬ পিএম says : 0
    Oh Allah only you can help muslims, rather than you no one help muslims.
    Total Reply(0) Reply
  • Sabbir Ahmmed ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:১২ পিএম says : 0
    আল্লাহ তাদেরকে হেফাজত করুন।
    Total Reply(0) Reply
  • আজিজ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪৬ পিএম says : 0
    আধুনিক যুগে এই ধরনের নির্যাতন, হত্যা কান্ড মেনে নেয়া যায় না । লাথি আজ বিশ্ব মুখোশধারী মানবতাবাদী দের মুখে ....
    Total Reply(0) Reply
  • Ansar Uddin ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৪৮ পিএম says : 0
    আহ! কি নির্মম! কঠিন মনের মানুষের মনও কষ্টে ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে, এসব শুনলে
    Total Reply(0) Reply
  • নুরুল হুদা ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৫১ পিএম says : 0
    More than Rohingya 200 villages have been burnt down by Burmese Government
    Total Reply(0) Reply
  • Shahidul Islam Shahid ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৫২ পিএম says : 0
    হায় রে,মানবতা আজ কোথায় গেলো?বিশ্ব বিবেক নিরব কেন?আধুনিক যুগে এই বর্বরতা মেনে নেওয়া যায়না।সভ্যতার যুগে মিয়ানমারের এই অসভ্যতার কি কোন প্রতিকার নেই?অসহায় এই মানুষ গুলো কি তাদের অধিকার কখনও ফিরে পাবেনা,মিয়ানমারের অসুর বাহিনী বৌদ্ধ সন্ত্রসীদের কি বিচার হবেনা??
    Total Reply(0) Reply
  • M A. Mustafiz Mamun ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৫৪ পিএম says : 0
    এগুলো কি বিশ্ব মানবতা দেখেনা, না শুধু মুখেই চিৎকার করবে গাছের লতা পাতা খেয়ে বেচে আছে কত অনাহারি মানুষ
    Total Reply(0) Reply
  • M Shahadat Hossain Shahed ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ২:৫৪ পিএম says : 0
    আন্তজাতিক মিডিয়া এবং মানবাধিকার কর্মীদের জোর করে রাখাইনে প্রেরণ করা উচিত। না হলে প্রকৃত ঘটনা , ঘটনার ভয়াবহতা জানা যাবে না। এখনো লক্ষ লক্ষ লোক জংগলে আছে তারা মারা যাবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ