Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে পারবে না

আল জাজিরা | প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কিছু করার দাবিতে গত দু’সপ্তাহ ধরে ব্যাপক বিবৃতি ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে পারবে না।
১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক রিপোর্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুরোধ করে যে যারা মিয়ানমারে চরম নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত তাদের উপর জরুরি ভিত্তিতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সামরিক সহযোগিতা ও সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে লেনদেন নিষিদ্ধসহ বার্মার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।
অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের সবচেয়ে কার্যকর দিক হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি লংঘনের ব্যাপারে তা কিছু একটা করা হচ্ছে বলে ধারণার সৃষ্টি করে। তবে যেখানে তাদের কার্যকারিতা থাকে না সেখানে তা অর্থহীন। অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপের লক্ষ্য হচ্ছে লক্ষ্যবস্তু দেশের ক্ষেত্রে নীতি পরিবর্তন ঘটানো। এ লক্ষ্য তখনি অর্জিত হয় যখন লক্ষ্যবস্তু দেশটি তার বর্তমান নীতির সুফল লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে অবরোধ তখনি ফলপ্রসূ হয় যখন অবরোধ আরোপকারী পক্ষগুলো ও তাদের মিত্ররা সহযোগিতা মূলক ভাবে কাজ করে। তা না হলে আরোপিত অবরোধ ভন্ডুল করার জন্য অনেক অনেক পথ খুলে যায়। আন্তর্জাতিক অনৈক্য সৃষ্টি করে চতুর দৃশ্যকল্প।
যুগোশ্লাভিয়ার দৃষ্টান্ত
সংঘাত রোধের হাতিয়ার হিসেবে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের বাধ্যকারী প্রমাণ হচ্ছে ১৯৯২-১৯৯৫ সালের যুগোশ্লাভ যুদ্ধ। ঠান্ডা যুদ্ধ অবসানের পর যুগোশ্লাভিয়া তার কৌশলগত গুরুত্ব হারায়। সে কারণে পশ্চিমা দেশগুলো বা রাশিয়ার কাছে যুগোশ্লাভ সংকট তাৎক্ষণিকভাবে কোনো গুরুত্ব পায়নি। অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে শেষপর্যন্ত তারা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসে। আজ রাখাইনের ব্যাপারেও আমরা নানা রকম বিবৃতি দেখতে পাচ্ছি। ঠান্ডা যুদ্ধোত্তরকালে যখন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উচ্চ মাত্রায় ছিল তখন কূটনৈতিক অস্ত্র হিসেবে অবরোধ আরোপের উপর বিপুল গুরুত্ব দেয়া হয়।
যুক্তরাজ্য বার্মার সাথে তার সামরিক সহযোগিতা হ্রাস করছে। তবে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করার কোনো চচ্ছে তার নেই। একটি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ ব্রিটিশদের জন্য সহজ বিষয়, তবে তারা এখন পর্যন্ত দাবি করতে পারে যে তারা কিছু করছে।
জার্মানির ক্ষেত্রে বলতে হয়, সাম্প্রতিক পুনঃঐক্যবদ্ধ সরকার যুগোশ্লাভিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি জাতিসংঘে তার মিত্রদের সমর্থন যোগাড়ের কৌশলগত লক্ষ্যে ব্যবহার করেছে। তারা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে শুুধু লিপ সার্ভিস দিয়েছে, অন্যদিকে বসনিয়ায় সার্বদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ক্রোট ও বসনিয়দের অস্ত্র দিয়েছে।
ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নীতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারে চীনের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে। মিয়ানমার সরকারের পক্ষে নিলে তার হারানোর কিছু নেই, বরং লাভের সকল সুযোগ রয়েছে।
রুশরা সে সময় যুগোশ্লাভিয়াতে যে রকম ঘটেছিল সে রকম তাদের দেশেও জাতিগোষ্ঠিগত ভাঙ্গনের আশংকায় শংকিত ছিল এবং সমসাময়িক পন্ডিতদের বিস্মিত করে অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাসহ যুগোশ্লাভিয়ার ঐক্য বহাল রাখার উদ্যোগকে সমর্থন করেছিল।
আমেরিকানরা উপলব্ধি করেছিল যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বসনিয় সার্বদের অনুকূলে ছিল যা দেশব্যাপী বিচ্ছিন্নতাপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বকে জোরদার করে। কিন্তু মার্কিন সরকার সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার বাগাড়ম্বর অব্যাহত রাখার বদলে কিছু করার জন্য অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হয়। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করলেও যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ক্রোটদের মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করে। তাদের আশা ছিল যে বসনিয়ায় সামরিক ভারসাম্য এমন এক পর্যায়ে আসবে যে তা বিবদমান পক্ষগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসবে যা তাদেরকে ব্যয়বহুল সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে তাকে রেহাই দেবে।
যুগোশ্লাভিয়ায় যে কায়দায় অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করা হয়েছিল ত কে বিপর্যয় বলাই সঙ্গত। মাঠে থাকা পক্ষগুলোর উপর তা প্রভাব ফেলে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি করে এবং সর্বোপরি সেখানকার যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করে। যাহোক, যুগোশ্লাভ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্র্ণ দিক হল যে তার বিকল্প হতে পারত শুধু সামরিক হস্তক্ষেপ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯০-র দশকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট একমত ছিল যে এটা একটি পন্থা হতে পারে।
চীনা ফ্যাক্টর
যুগোশ্লাভিয়া চীনের জন্য কোনো ফ্যাক্টর ছিল না যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে মিয়ানমার। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নীতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারে চীনের গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ চলমান। রাখাইন সংকটে চীন মিয়ানমারের পক্ষ নিলে অভ্যন্তরীন ভাবে নেতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হবে না। মিয়ানমারে বিদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদ যদি সহজে দমন করা যায় তা চীনের নিজের উইঘুর সমস্যার ক্ষেত্রে জোরালো দৃষ্টান্ত হবে। চীনকে ছাড়া অবরোধ বা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসবে না , বরং তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরো অনৈক্য সৃষ্টি করবে যার পরিণতি হবে এ সংকটের অন্য সমাধান খুঁজে বের করতে কম সহযোগিতা। মিয়ানমারে সামরিক হস্তক্ষেপ প্রশ্নাতীত বিষয়।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে আমরা কেন অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহবান জানাতে দেখছি? প্রথমত, বিশ^সংস্থা ও সহযোগীদের কিছ করা হচ্ছে দেখিয়ে মিয়ানমার সরকার সামরিক হস্তক্ষেপ দূরে সরিয়ে রাখতে পারে, দ্বিতীয়ত, দেশটি সরকারের উপর থেকে মিডিয়ার চাপ সরাতে পারে যদিও এটা সে দেশের জন্যই প্রযোজ্য যারা সে সংকটকে জাতীয় নিরাপত্তা সমস্যা বলে বিবেচনা করে। এটা প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে সম্পৃক্তÑ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের জন্য নয় যারা এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ভোট দিতে ও তা বলবত করতে পারে।
আমরা যখন কার্যকারিতার সম্ভাবনা বিবেচনা করব তখন মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের আহবান অযৌক্তিক ও আদর্শবাদী মনে হবে। যদি অল্প কিছু অস্ত্র সরবরাহকারী বাণিজ্য ও অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেয় সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের নীতি পরিবর্তনের আশা সামান্য।
আমরা নতুন ভূখন্ডে যেখানে প্রচলিত সংঘাত ব্যবস্থাপনা পন্থা অকার্যকর ও অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। যেহেতু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তিত প্রকৃতির সাথে সংঘাত ব্যবস্থাপনা তাল মিলাতে পারছে না তাই বহুমেরুকরণকৃত বিশে^ সংঘাত ব্যবস্থপনায় আমূল পরিবর্তিত নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দরকার। তাই, রুয়ান্ডার পর বসনিয়ায় ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ‘আর কখনো নয়’ দাবি সত্তে¡ও তা নিশ্চিত করার জন্য বিরোধী পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনতে আমাদের ভান্ডারে কিছুই নেই।
*নিবন্ধ লেখিকা ডেনিকা বø্যাকলক কানাডার নাগরিক। তিনি ব্যাংকক ভিত্তিক একজন উন্নয়ন ও সংঘাত বিশ্লেষক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ