হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পরে সৃষ্টি হয় একটি জাতিসত্তার। ধর্মীয় বিরোধ ও দখলদারিত্বের উন্মাদনা আরাকান বা মিয়ানমারে জাতিসত্তা সৃষ্টি হতে দেয়নি। একটি জনগোষ্ঠি খন্ডিত হয়ে গেলে তারা আর জাতি থাকে না। রাষ্ট্রীয় পরিচয় আর নৃতাত্তি¡ক পরিচয় এক নয়। আভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাত যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ। রাখাইনে এ সংঘাতের জন্ম দিয়েছে রাষ্ট্র স্বয়ং। সংঘাত যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের বসবাসের আলাদা ভূখন্ড, নিরাপত্তা বাহিনী অর্থাৎ আলাদা রাষ্ট্র গঠন ছাড়া কোন বিকল্প আছে বলে মনে হচ্ছেনা। অং সান সু চি গণতন্ত্রের মানস কন্যা হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি এখন জল্লাদে পরিণত হয়েছেন। ফলে গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বীরদর্পে যোগ দিলেও এবার তিনি যোগ দিতে পারেননি। কারণ তার কুকর্মে তিনি বিশ্বকে মুখ দেখানোর অবস্থা রাখেননি। তার নিরবতা বা উসকানি মিয়ানমারকে দ্বিখন্ডিত করে দিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৬তম অধিবেশনে নয়াদিল্লির সমালোচনা করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল হুসেইন। তিনি বলেন, ‘প্রথাগত আইন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী ভারত সমষ্টিগতভাবে রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করতে পারে না। নির্যাতনের শঙ্কা আছে বা গুরুতর সহিংস এলাকায় তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারে না।’ ভারত সরকার সম্প্রতি সে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সস্প্রতি এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশিকা বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজুও এ ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে ‘রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবেই’ বলে মন্তব্য করেছেন। ভারত নিশ্চয় সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ মুখে যাই বলুক না কেন, ভারত মুসলিম বিদ্বেষী। ভারতের এ বক্তব্যে গোটা বিশ্বে তার চেহারা উন্মোচিত হলো।
রোহিঙ্গারা আরাকানে বহিরাগত নয়, বরং বর্মি রাজারাই আরাকানের দখলদার। বর্মি রাজারাই বারবার প্রাচুর্যে ভরপুর আরাকান দখল করে লুটপাট করেছে। ১৭৮৪ সালে আরাকানের স্বাধীনতা লুপ্ত হয় বর্মি রাজা ভোদপায়ার আরাকান দখলের মাধ্যমে। এরপরের আরাকানের ইতিহাস বর্মি রাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর রক্তের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন বার্মা স্বাধীন হলেও আরাকানিদের ভাগ্যে এ স্বাধীনতা নিয়ে আসে নিদারুণ অভিশাপ, যা এখন গোটা বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত। আরাকান বলতে আজকের মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য বোঝানো হলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এক সময় রাখাইন রাজ্য ছাড়িয়েও বার্মার বিস্তৃত অঞ্চল আরাকান রাজাদের দখলে ছিল। ইতিহাসবিদদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন যে, এ অঞ্চলে মোগল সাম্রাজ্যের পরই আরাকান সাম্রাজ্যের নাম উল্লেখযোগ্য ছিল। দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আজকের মিয়ানমারের বিস্তৃত অঞ্চল আরাকান রাজাদের অধীনে ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায়। আরাকানের ইতিহাস বলে যে, আরাকান ছিল বরাবরই স্বাধীন এবং অতিশয় সমৃদ্ধ একটি দেশ। বাংলার প্রাচুর্যের কারণে যেমন ১৫শ সালের শুরুতে এখানে ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে, তেমনি ১৫শ ও ১৬শ সালে আরাকানে পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের আগমন ঘটে। ১৬শ সালে ওলন্দাজরা আরাকান থেকে দাস ও চাল ক্রয় করত। তারা এখানে নিয়ে আসত লোহা ও লৌহজাতসামগ্রী। মগ দস্যুরা বাংলার উপক‚ল থেকে লোকজন ধরে নিয়ে তাদের কাছে বিক্রি করত। মগ দস্যুরা প্রথম দিকে ছিল মূলত আরাকানের নৌ-সেনাসদস্য। মোগল থেকে আরাকানিদের রক্ষা করার জন্য ১৫৩১ সালে আরাকানের রাজা জেবুক শাহ পর্তুগিজ নৌসেনাদের সহায়তায় আরাকানে নৌবাহিনী গঠন করেন। নৌসেনা গঠনের উদ্দেশ্য ছিল যেহেতু মোগল মুসলিম সেনাদের মোকাবেলা, তাই জেবুক শাহ তার নৌবাহিনীতে আরাকানের মুসলমানদের পরিবর্তে মগদের স্থান দেন। কিন্তু পরে এরা মানবিকতা বিবর্জিত হিংস্র জলদস্যুতে পরিণত হয়। মধ্যযুগের কোনো কোনো পর্যটক এদেরকে সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত এক শ্রেণির মানুষ নামক প্রাণি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ফুলে ফলে সুশোভিত স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত আরাকানের পতনকাল শুরু হয় ১৬৬০ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্র সু ধর্মা কর্তৃক মোগল রাজপুত্র শাহসুজাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে আরাকানে বিরাজ করে অস্থিরতা। মাঝে শান্তি ফিরে এলেও আরাকানি সামন্ত রাজাদের মধ্যে কোন্দলের সুযোগে ১৭৮৪ সালে বর্মি রাজা ভোদপায়া আরাকান দখলে নেন। ভোদপায়ার অত্যাচারে আরাকানের রাজা ঘা থানবি পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে বর্মিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সিনপিয়ার নেতৃত্বে আরাকান বিদ্রোহ তুঙ্গে পৌঁছে। একপর্যায়ে ১৮১১ সালে সিনপিয়ার বাহিনী রাজধানী ছাড়া গোটা আরাকান দখলে নিলেও পরে পরাজিত হয় বর্মি রাজার সেনাদের কাছে। আরাকানের বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্মি রাজা ১৮১১ সালে সমগ্র বার্মায় প্রত্যেক পরিবার থেকে একজন যুবক অথবা ২৫০ টাকা, একটি বন্দুক, ১০টি চকমকি পাথর, দুই সের বারুদ, সম ওজনের সীসা, দুইটি কুঠার, ১০টি লম্বা পেরেক সরবরাহের নির্দেশ জারি করেন। এভাবে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন বর্মি রাজা সিনপিয়ার বাহিনী পরাজিত করে। ১৮১৫ সালে সিনপিয়ার মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয় আরাকানের স্বাধীনতা উদ্ধার আন্দোলন। এরপর ১৮২৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্মা দখল করার পর দীর্ঘ ১০০ বছর পর্যন্ত আরাকানিরা অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। কিন্তু ১৯৪২ সালে আরাকান জাপানিদের অধীনে যাওয়ার পর আরাকানের মুসলমানদের ওপর আবার গণহত্যায় মেতে ওঠে বর্মিরা। অবশেষে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে বার্মা। কিন্তু স্বাধীনতার মাধ্যমে বার্মা ব্রিটিশমুক্ত হওয়ার সাথে সাথে আবার আরাকানের ওপর হত্যা নির্যাতন আর উচ্ছেদে মেতে ওঠে বর্মিরা। তাদের বহিরাগত আখ্যায়িত করে শুরু হয় চরম হত্যাযজ্ঞ। তাই বার্মা স্বাধীনতা আরাকানের রোহিঙ্গাদের জন্য বয়ে আনে অভিশাপ।
হাজার বছরেরও অধিককাল ধরে বিদ্যমান স্বাধীন আরাকানের রাজত্বে ১৪০৬ সালে হানা দেয় বর্মি রাজা। আরাকানের তরুণ রাজা নরমিখলা পালিয়ে তখন আশ্রয় নেন বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের রাজধানী গৌড়ে। ১৪৩০ সালে বৃহত্তর বাংলার রাজধানী গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দীন শাহ নরমিখলাকে আবার আরাকানের ক্ষমতায় বসান। তিনি বর্মি রাজাদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ৫০ হাজার সৈন্য আরাকানে পাঠান এবং তারা সেখানে অবস্থান করেন। নরমিখলা সোলাইমান শাহ নাম ধারণ করে আরাকানের ক্ষমতায় বসেন এবং ম্রাউক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। আবার শুরু হয় শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে আরাকানের পথচলা। এ রাজবংশ ১০০ বছর পর্যন্ত গৌড়ের ইলিয়াস শাহী বংশের অনুগত থেকে একপ্রকার স্বাধীনভাবেই আরাকান শাসন করেছে। অপরদিকে আরাকানের প্রতি গৌড়ের সুলতানদের বদান্যতা ইতিহাসে বিরল ঘটনা হিসেবে স্থান পায়। তারা বর্মি রাজাকে হঠিয়ে আরাকান দখল করেও ফিরিয়ে দেন নরমিখলার হাতে। নরমিখলার রাজবংশের অধীনে ১০০ বছরে আরাকান খুবই শক্তিশালী একটি রাজ্যে পরিণত হয় এবং এরই ভিত্তি ধরে পরবর্তী শাসকেরা শক্তিশালী আরাকান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, যা বার্মার বিস্তৃত ভূ-ভাগ নিয়ে গঠিত হয়।
দিল্লির মোগলদের কারণে গৌড়ের ইলিয়াস শাহী রাজবংশের পতন ঘটলে ১৫৩০ সালে ম্রাউক রাজবংশের রাজা জেবুক শাহ আরাকানের পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ বংশেরই পরবর্তী রাজা সেলিম শাহ ১৫৯৩ সালে বার্মার মলমিল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-ভাগ আরাকান রাজ্যের অধীন করেন এবং নিজে বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ফরাসি পর্যটক ফাইয়ারড এ সময় অঞ্চল সফর করেন এবং তিনি মোগলদের পর আরাকানকে এ অঞ্চলের শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
এখন আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের সাথে কিছুটা নমনীয় আচরণ করেও তাতে দীর্ঘমেয়াদি বিষয়টি সুরাহা হবে বলে আশা করা যায় না। তাই সব হারানো নিঃস্ব রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী তা অনিশ্চিত। বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপরও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি অনুধাবন করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবগুলো হলো: ১. অবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে জাতিগত নিধন বন্ধ করতে হবে। ২. জাতিসংঘের অনুসন্ধানী দল পাঠাতে হবে। ৩. মিয়ানমারে সেফ জোন গড়ে তুলতে হবে। ৪. রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। ৫. কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই পাঁচটি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসতে পারে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। প্রশ্ন উঠতে পারে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি পূর্ণ দায়িত্ব ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবে? যদি না আসে তাহলে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ও ভবিষ্যত কী হবে?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।