Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রামে জঞ্জালমুুক্ত ফুটপাথে স্বস্তিমেয়র নাছিরের আরও একটি সাফল্য!

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

চারিদিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ফুটপাতে নেই কোন জঞ্জাল। পথচারীরা স্বস্তিতে চলাফেরা করছেন। সড়কের দু’পাশে দৃষ্টিনন্দন মার্কেট বিপনী কেন্দ্র চোখে পড়ছে। স্বাচ্ছন্দ্যে আসা-যাওয়া করছেন ক্রেতারা। রাতে বর্ণিল আলোয় ঝলমল করছে পুরো এলাকা। এ চিত্র এখন চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্র নিউমার্কেট এলাকার।
কয়েকদিন আগেও পুরো এলাকায় সড়ক ফুটপাত জুড়ে ছিল নানা জঞ্জাল। সড়কে দোকান খুলে ফুটপাত দখল করে চলছিল ব্যবসা। যানজট ছিল নিত্যদিনের, ফুটপাত তো দূরের কথা সড়কেও হেঁটে চলার উপায় ছিলনা। ফুটপাতের জটলায় জনজটের ভিড়ে ছিল পকেটমার আর টানা পার্টির উৎপাত। সড়কের দুইপাশে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য ডাকা পড়েছিল হকারদের ত্রিপল আর পণ্যের আড়ালে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রের ওই কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা হকারদের দখলে ছিল।
নিউমার্কেট এলাকাকে ঘিরে তীব্র যানজট ছড়িয়ে পড়ত আশপাশের প্রতিটি সড়কে। হকারদের শৃঙ্খলায় এনে ফুটপাত উন্মুক্ত করতে বিগত দিনে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হকার উচ্ছেদে গিয়ে দফায় দফায় সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়েছে পুলিশ। হকারদের সাথে রয়েছে রাজনীতির শক্ত যোগাযোগ। ফুটপাতের বাণিজ্যকে ঘিরে কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তার ভাগ পেয়েছে পুলিশ, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তান আর স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। ফলে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এ সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি। জঞ্জাল মুক্ত হয়নি নগরীর প্রাণকেন্দ্রের বিশাল এলাকার ফুটপাত।
তবে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় এখন জঞ্জালমুক্ত হয়েছে নিউমার্কেট এলাকা। হকার উচ্ছেদ নয়, তাদের শৃঙ্খলায় এনে এ অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে নিউমার্কেট থেকে শুরু করে আমতলা, স্টেশন রোড, জিপিও হয়ে কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত সড়কের দুইপাশ পুরোপুরি জঞ্জাল মুক্ত হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত স্থানে পণ্যের পসরা নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে ব্যবসা করছেন ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা। ফলে সড়ক এবং ফুটপাত জঞ্জাল মুক্ত হয়েছে, এলাকার পুরো দৃশ্যপটও পাল্টে গেছে। পর্যায়ক্রমে মহানগরীর প্রতিটি এলাকায় হকারদের শৃঙ্খলায় এনে সড়ক ও ফুটপাত চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে সিটি কর্পোরেশন।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর মহানগরীকে বিলবোর্ডের দৈত্য দানবের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তার দৃঢ়তায় এক বছরের মধ্যে পুরো মহানগরী বিলবোর্ড মুক্ত হয়েছে। পাহাড়, নদী, সাগর আর সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা চট্টগ্রাম নগরীর আকাশ এখন মুক্ত। মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে মহানগরীর বাসিন্দারা। এরপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে গৃহস্থালির বর্জ্য অপসারণের উদ্যোগ নেন সিটি মেয়র। সেই সাথে দিনের বদলে রাতের বেলা নগরীতে ঝাড়– দেয়া থেকে শুরু করে আবর্জনা অপসারণের কাজ শুরু হয়। এক্ষেত্রেও মেয়রের উদ্যোগ সফল হয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী মহানগরীর সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করেন মেয়র। ঈদের পর এ উদ্যোগের সুফল দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকার হকারদের তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের দেয়া হয় পরিচয়পত্র। বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পণ্যের পসরা নিয়ে নির্ধারিত স্থানে হকারদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। আগে হকাররা ফুটপাত দখল করে সেখানে রীতিমত দোকান বসিয়ে ব্যবসা করত। কিন্তু এখন তারা নির্ধারিত স্থানে শৃঙ্খলার সাথে ব্যবসা করছেন। বেচাকেনা শেষে নিজ নিজ পসরা গুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাসায়। ফলে দিনের বেশিরভাগ সময় ফুটপাত থাকছে পুরোপুরি উন্মুক্ত।
এ প্রসঙ্গে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আমি হকারদের উচ্ছেদ করিনি। তাদের শৃঙ্খলায় এনে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছি। ফুটপাতে শৃঙ্খলা আনতে যতবারই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ততবারই গুজব রটেছে হকারদের উচ্ছেদ করা হবে। আমি হকার নেতাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, এখন তারা যেভাবে ব্যবসা করছে শৃঙ্খলায় আসলে তাদের ব্যবসা আরও ভাল হবে। এটি তারা বুঝতে পেরেছে। আর এ কারণেই মহানগরীর ফুটপাত উন্মুক্ত করা সহজ হয়েছে। মেয়র বলেন, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। প্রতিদিন দেশী-বিদেশী অনেক পর্যটক এ মহানগরীতে আসছে। বিশৃঙ্খল সড়ক ফুটপাত দেখে চট্টগ্রাম সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। আমরা চাই এ মহানগরী মর্যাদার সাথে মাথা তুলে দাঁড়াক। আমার এ উদ্যোগে হকাররা সহযোগী হয়েছেন, নগরবাসীও সহযোগিতা করেছে। আশা করি মহানগরীর অন্যান্য এলাকায়ও হকারদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে পারব। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অন্যরকম এক মহানগরী দেখতে পাবে নগরবাসী।
নিউমার্কেটের মত অন্য এলাকায় হকারদের শৃঙ্খলায় আনতে কাজ চলছে। নগরীর জিইসি মোড়, বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, চকবাজার, আগ্রাবাদ, বড়পোল, অলংকার, সাগরিকা, ইপিজেড, বন্দরটিলা, স্টীল মিল বাজার, কাটগড় মোড়, কর্ণফুলী সেতু, কালামিয়া বাজার এলাকায় হকারদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে। এসব এলাকার হকারদেরও বেলা ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নির্ধারিত ছাতার নিচে বসে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়া হবে।
নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শৃঙ্খলার মধ্যে আসায় তাদের কেনাবেচা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ এলাকার বাসিন্দা মোঃ আজাদ দীর্ঘ ৯ বছর ধরে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের পাশের ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, আগে যা বেচাকেনা হত এখন তার চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তিনি বলেন, আগে পুরো ফুটপাতজুড়ে দোকান থাকায় চরম বিশৃঙ্খলা হতো। ক্রেতারা স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা কিংবা চলাফেরা করতে পারতেন না। ভিড়ের মধ্যে অনেকের পকেটমার হয়ে যেত। বিশেষ করে নারী ক্রেতারা ফুটপাতের ঝামেলা এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু এখন শৃঙ্খলায় আসায় সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা সারতে পারছেন।
ফুটপাত উন্মুক্ত হওয়ায় খুশি আশপাশের ব্যবসায়ীরা। দারুল ফজল মার্কেটের বাটা শো-রুমের কর্মকর্তা আবদুল আজিজ বলেন, এখানে যে আমাদের শো-রুম ছিল তা বাইর থেকে বোঝার কোন উপায় ছিলনা। কারণ হকারদের ত্রিপল আর পণ্যের পসরায় পুরো এলাকা ছিল ঢাকা। কিন্তু এখন ফুটপাত উন্মুক্ত হওয়ায় শো-রুমটি অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ক্রেতারাও আরামে দোকানে আসতে পারছেন। নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে হকার উচ্ছেদের দাবি করে আসছেন। তাদের অভিযোগ, ফুটপাতের জঞ্জালের কারণে তাদের মার্কেট ঢাকা পড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা আসতে পারতনা। ফুটপাত জঞ্জাল মুক্ত হওয়ায় আশপাশের ব্যবসায়ীরাও এখন দারুণ খুশি। শৃঙ্খলায় আসতে পেরে খুশি হকারেরাও। তারা বলেন, আগে পুলিশকে প্রতিদিনই চাঁদা দিতে হত। মাস্তানরা এসেও চাঁদাবাজি করত। কিন্তু এখন কাউকেই চাঁদা দিতে হয় না। সিটি কর্পোরেশন তাদের বৈধতা দিয়েছে।
এদিকে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মহানগরীর নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত ও সড়কে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হচ্ছে। কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, ফুটপাত এবং ফুটওভার ব্রিজ দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হবে। মহানগরীর যেসব এলাকায় হকারদের শৃঙ্খলায় আনার কাজ শেষ হবে সেসব এলাকায় শুরু হবে সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। উল্লেখ্য, মহানগরীর ৬০ লাখ বাসিন্দাদের বিরাট একটি অংশ স্বল্প আয়ের। তারা বেশিরভাগ কেনাকাটা সারেন ফুটপাতের দোকান থেকে। ফুটপাতে মধ্যবিত্তদের প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যও পাওয়া যায়। ফুটপাতে ব্যবসার সাথে জড়িত লক্ষাধিক হকার বা ক্ষুদে ব্যবসায়ী। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ফুটপাতে ব্যবসা করার ব্যবস্থা আছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই হকার উচ্ছেদ নয়, তাদের শৃঙ্খলায় এনে জনদুর্ভোগ কমানোর উদ্যোগ নেয় সিটি কর্পোরেশন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ